ভারত সরকার ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণার ঠিক পরপরই দিল্লির লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের ঢল নামল গাজিয়াবাদের রাস্তায়। ট্রেন বন্ধ, বাস বন্ধ, কিন্তু সবাই বাড়ি ফিরতে চায়। কাঁধে, মাথায় বস্তা নিয়ে শত শত মাইল হেঁটে রওনা দিল মানুষ। কী নিদারুণ কষ্ট!
ইউরোপে-আমেরিকায় লকডাউন মানে খাবার মজুত করে বাড়িতে বসে থাকো। দিল্লিতে বা ঢাকায় গাদা গাদা খাবার কিনে ঘরে বসে রইল না কেন বেশির ভাগ মানুষ? এই যে ঢাকার কয়েক লাখ মানুষ ছুটির ঘোষণায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে, ট্রেনে, বাসে গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরল, সারা দেশের পথে-ঘাটে ছড়িয়ে ছিল ভাইরাসের জীবাণু, এ কি শুধুই তার অশিক্ষা? তারা বেআক্কেলিপনা? বারবার 'স্টে হোম' বলার পরেও শুনল না? আহারে 'স্টে হোম'! দুদিন আগেও মাস্ক পরে আন্দোলন করেছে ইপিজেডের ৮০০ শ্রমিক, ঝর্ণা নিটওয়্যারের কয়েক শ শ্রমিক। ২ থেকে ৩ মাস ধরে বেতন পাননি। খুব মূর্খ তারা? নিজেদের জীবন কেবল ঘরে বসে থাকা আপনি-আমিই ভালোবাসি। জীবনকে তারা ভালোবাসেনি কখনো?
একটা আড়াই কোটি মানুষের শহর, হাজারখানেক বস্তি। ভাসমান মানুষের সংখ্যা কত কে জানে। কুলি, মজুর, নির্মাণশ্রমিক। নাপিত, মুচি, ভ্যানওয়ালা, বাদামওয়ালা, বাসের হেলপার। পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রিকশাচালক, কাঠের কারিগর, দোকানি, সবজিওয়ালা। ফুটপাতের হকার, ঠিকা বুয়া, গার্মেন্টসকর্মী। পেপারওয়ালা, প্লাম্বার, নছিমনচালক। একটা গোটা শহরকে সচল রাখা হাজার খানেক পেশার মানুষ।
গ্রামে-গঞ্জে-বন্দরে কাজ নেই, ধানের দাম নেই, মেগা প্রকল্প জমি নিয়ে গেছে, এনজিওগুলো টিনের চাল খুলে নিয়ে গেছে। এসব মানুষ শখ করে এসেছিল এই নির্মম শহরে?
আমাদের না ৮ পার্সেন্ট জিডিপি? দেশ না রোল মডেল? ইউরোপেকেও ছাড়াবে খুব শিগগির? তাহলে পথে পথে আজ মলিন মানুষের হাহাকার কেন? লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে মানুষকে বাড়িতে আটকে রাখা গেল না কেন? 'স্টে হোম' বললেই হয়ে গেল? স্পেন নয়, ব্রিটেন নয়, এটা বাংলাদেশ। এখানে ৮০ বছরের বৃদ্ধ রিকশা চালায়। এখানে শিল্পমালিক বছর বছর প্রণোদনা পায়, আর শিল্পশ্রমিক সারা বছর বাকিতে চাল কেনে। এখানে পেটের দায় জীবনের সবচেয়ে বড় দায়। এখানে পশ্চিমের মতো 'সোশ্যাল সিকিউরিটি' বা রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বলে কোনো বস্তু নেই।
ভুলের পরে ভুল, দুর্নীতির পরে দুর্নীতি, আর বছর বছর জনগণের ট্যাক্সের টাকার কী নিদারুণ অপচয়ের পর তৈরি হয়েছে আজকের 'রোল মডেল' বাংলাদেশ। এখানে 'সামাজিক দূরত্বের' চর্চা করতে গেলে হাজারটা চালাকির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ভুলভাল সিস্টেমগুলোর ব্যাখ্যা দিতে হবে রাষ্ট্রকে।
গণপরিবহনগুলোর এমন বেহাল অবস্থা কেন? ৪০ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টস শিল্প, অথচ মিরপুর, গাজীপুর, আশুলিয়ার হাজারো শ্রমিক পশুর মতো গাদাগাদি করে বাঁচে। শত শত শ্রমিকের জন্য মাত্র একটা টয়লেট। স্যাটেলাইট সাবমেরিনের দেশে কয়েক হাজার বস্তি। ৬ ফুট বাই ৬ ফুট ভাগাড়ে 'সোশ্যাল ডিস্টেনসিং' হয়? ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে বহু কষ্টে এক বালতি পানি জোটে! বেশি বেশি হাত ধুলে খাওয়ার পানিতে টান পড়ে না? আগে জানা ছিল না এসব?
গায়ের সঙ্গে গা লাগানো বাসস্টপ, বাজারঘাট, লঞ্চ টার্মিনাল, ফুটপাত। প্রতিদিন ট্রেনের ছাদে, বাসের হাতলে ঝুলে কাফেলার মতো মানুষ জড়ো হচ্ছে ঢাকায়। গ্রামে কাজ নেই, জেলা-উপজেলাগুলোয় কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি, ৮ পার্সেন্ট জিডিপির দেশে ৪ কোটি বেকার! 'গ্রোথ' আছে, 'জব' নেই! ব্যাখ্যা দিক রাষ্ট্র?
শেষ পর্যন্ত মানুষ গাদাগাদি করে বাসে চড়ল, লঞ্চে উঠল, গায়ে গা লাগিয়ে টিকিট কাটল? সত্যি উপায় ছিল তার? এই রাষ্ট্র তাকে স্রেফ একটা সপ্তাহ খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার গ্যারান্টি দেয়নি তো। এই শহরের মানুষ দেনাগ্রস্ত, কোনোমতে ঠেকনা দিয়ে বেঁচে থাকা মানুষ। কাজকর্ম ছাড়া স্রেফ একটা সপ্তাহ বাঁচতে হলেও গ্রামে তাকে ফিরতেই হতো। আর যারা ফেরেনি, তারাও আজ শয়ে শয়ে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছে। রেশনের চালের গাড়ি খুঁজছে। কেউ কেউ ময়লা লুঙ্গির কোনা দিয়ে চোখ মুছছে।
বড় নির্মম এই রাজধানী শহর। জমানো টাকা, জমানো চাল এখানে স্বপ্নের মতো। এখানে মৃত্যুর চেয়ে ক্ষুধার ভয় বেশি। এই সমস্যার তাহলে সমাধান কী ছিল? সমাধান আসলে ছিলই না। সবকিছু ঠিক এমনি করেই ভেঙে পড়ার কথা ছিল। ঠেকনা দিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের মলিনতার বিস্ফোরণ হতোই।
অরুন্ধতী রায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিকল্প কী? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, বরাবরই বিকল্প ছিল। প্রতিটি বাজে প্রকল্প, প্রতিটি বাজে পলিসি, প্রতিটি মেগা বাঁধ, প্রতিটি কয়লা প্ল্যান্ট, এবং প্রতিটি ইউরেনিয়াম খনির বিপরীতে একাধিক যৌক্তিক এবং সহজ বিকল্প ছিল। কিন্তু বহু বছর ধরে চলেছে ভুলের পরে ভুল, দুর্নীতির পরে দুর্নীতি, অপচয়ের পর অপচয়। এখন হঠাৎ করে বিকল্প চাইলে বিকল্প আকাশ থেকে পড়বে না। পেছনের ঐতিহাসিক ভুলগুলোকে আগে শোধরাতে হবে।
আমাদের ঐতিহাসিক ভুলগুলোর দায় নিতে হবে। যে উন্নয়ন শুধু জিডিপি বাড়ায়, কাগজে-কলমে 'মাথাপিছু আয়'ও বাড়ায়, অথচ মানুষকে একটা সপ্তাহ খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মতো সঞ্চয় করতে দেয় না, সেই ভ্রান্ত উন্নয়নের দায় নিতে হবে।
আমাদের বিকল্প আছে, বরাবরই ছিল। প্রতিটি খারাপ নীতির বিকল্প ছিল একটি ভালো নীতি। প্রতিটি খারাপ প্রকল্পের বিকল্প ছিল একটি ভালো প্রকল্প। বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচে তৈরি হওয়া সর্বোচ্চ ফুটাফাটাওয়ালা রাস্তাগুলোর বিকল্প ছিল। অস্বাভাবিক খরচে নির্মিত সম্পূর্ণ অদরকারি পায়রা বন্দরটির বিকল্প ছিল। বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে অর্ধলক্ষ কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকির বিকল্প ছিল। ৫ টাকার গ্যাস ৭০ টাকায় কেনার বিকল্প ছিল। দেশের অমূল্য গ্যাস বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিকল্প ছিল। মারাত্মক খরচবহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিকল্প ছিল। অবিশ্বাস্য মাত্রায় টাকা পাচার, লুটপাট এবং খেলাপি ঋণের বিকল্প ছিল।
আর কত বলব? এই গল্পের শেষ নেই। অবিশ্বাস্য খরচ! অবিশ্বাস্য লুটপাট, অবিশ্বাস্য টেন্ডারবাজি। বিকল্প ছিল। বিকল্প ছিল লোকাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ, অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রণোদনা এবং লাখে লাখে টেকসই কর্মসংস্থান তৈরি। বিকল্প ছিল জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি। নিজেদের গ্যাস নিজেরা তোলা। সৌর ও বায়ুবিদ্যুতে বিপুল বিনিয়োগ। ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। গ্রামগুলোকে স্বনির্ভর করা। নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচের বিকল্প ছিল হাসপাতাল এবং ভেন্টিলেটর। টাকার অভাব ছিল না।
করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে শক্ত হাতে অনেকগুলো কাজ করতে হবে আমাদের। এই ভয়ংকর পরীক্ষায় খুব বেশি পথ খোলা নেই আমাদের সামনে। পরিবেশ নষ্ট করা বৈষম্য তৈরি করা প্রতিটি পলিসি, প্রতিটি প্রকল্পকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। বৈষম্যের উন্নয়ন, কংক্রিটের ফাঁপা উন্নয়ন থেকে বাঁচাতে হবে আমাদের অমূল্য কৃষিজমি, আমাদের নদীনালা-মাঠ-বনভূমি, আমাদের কৃষক-শ্রমিক, আমাদের পোলট্রি শিল্প-পাটশিল্প-ডেইরি শিল্প, আমাদের খাদ্যব্যবস্থা, আমাদের সরবরাহ চেইন, আমাদের গ্রামে-গঞ্জে গড়ে ওঠা প্রতিটি ছোট-বড় শিল্পকে।
একটি শক্তিশালী স্থানীয় অর্থনীতির বিকল্প নেই। একটি মানবিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকল্প নেই। একটি টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। বাঁচতে হলে সীমাহীন অপচয় ও দুর্বিনীত বৈষম্য কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। করোনার ঝুঁকির মুখেও হাজারো মলিন মানুষের ঢল দেখে আমরা কি বুঝতে পারিনি নগর পুড়লে যে দেবালয় বাঁচে না? 'ওরা' না বাঁচলে বাঁচবে তো আপনার সাধের জীবন? সাধের অর্থনীতি? পরিবেশবাদী হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাম্যবাদী হওয়ারও প্রয়োজন নেই। নিজের প্রাণ বাঁচাতেই কাজে নেমে পড়ুন।
নিজের প্রাণ বাঁচাতেই ভাবুন আরেকবার।
মাহা মির্জা: উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক