হোলি আর্টিজানের আট সন্ত্রাসীর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রায় শোনার পর দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে অনুশোচনার বদলে জিহাদি চেতনা জ্বলে উঠতে দেখা গেছে। আইএসের টুপি মাথায় এক যুবক আঙুল তুলে জিহাদ চালিয়ে যাওয়ারই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এই যুবকেরা অধিকাংশই শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের, ইংরেজি বোলচালে অভ্যস্ত, কেউ কেউ গিটার বাজিয়ে গান করতেন, কারও কারও ফ্যাশনদুরস্ত গার্লফ্রেন্ড ছিল। এরা কেউ আশৈশব ধর্মাচারী, এ কথা ভাবারও কোনো কারণ নেই।
তাহলে ঠিক কোন কারণে ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যায় এঁরা উৎসাহী হন, এই শিক্ষাই বা কী করে পান? এই প্রশ্নের উত্তরটি এখনো স্পষ্ট নয়। বলা হয়েছে, এঁদের মগজধোলাই হয়েছে। কারা করল এই মগজধোলাই, কীভাবে? সে প্রশ্নের উত্তর এখনো অনেকটাই ধোঁয়াটে। যদি জানি
কারা সে কাজে দায়ী, তাদেরই বা কেন বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে না?
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই আপাতশিক্ষিত ও আর্থিক সংগতিসম্পন্ন যুবক-যুবতীদের মধ্যে ইসলামি জিহাদে যোগ দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। কয়েক বছর আগে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সুযোগে সেখানে ইসলামি স্টেট নামে যে তথাকথিত খিলাফত গড়ে তোলা হয়, ইউরোপ-আমেরিকা থেকেও তাতে অনেক যুবক-যুবতী ভিড় জমান। এঁদের মধ্যে ১৫-১৬ বছর বয়সের মেয়েরাও রয়েছে। জিহাদের নামে আসলে এদের অধিকাংশ ‘যৌন দাসী’ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।
আইএসের পতনের পর এরা এখন সিরিয়ায় আটকা পড়েছে, কেউ কেউ ইতিমধ্যে এক বা দুই সন্তানের মা হয়েছে। এই সব আইএস ‘যোদ্ধা’দের মধ্যে বাংলাদেশ-উদ্ভূত কয়েকজন তরুণ-তরুণীও রয়েছেন, কোনো দেশই এঁদের আর ফেরত নিতে চাইছে না।
মগজধোলাইয়ের কাজটা মুখ্যত হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জিহাদি আমন্ত্রণ। এই কাজে বড় ভূমিকা রেখেছেন মাদ্রাসা-মক্তবের কোনো কোনো জাদুকরি বক্তা। বাংলাদেশ এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। আপনারা কেউ কি এই সব জাদুকরি বক্তা ঠিক কী বলে যুবকদের দলে ভেড়ান, তা শুনেছেন? ইন্টারনেটের কল্যাণে এঁদের ভিডিও এখন এন্তার পাওয়া যাচ্ছে। আমি সম্প্রতি এই রকম এক বক্তার ভাষণ শুনে হতবাক হয়ে গেছি। বাংলাদেশের কোনো এক অজ্ঞাত শহর বা গ্রামে, কয়েক হাজার উল্লসিত, উত্তেজিত যুবকের সামনে তিনি জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছেন। সবই প্রকাশ্যে, কোনো রাখঢাকের ব্যাপার নেই।
এই ভাষণে চরম উসকানি ও প্রতিবেশী দেশের প্রতি বিদ্বেষ আছে, জিহাদের ডাক ও শহীদ হওয়ার আহ্বান আছে, বেহেশতের প্রলোভন আছে। বক্তা অসাধারণ বাগ্মী, উপস্থিত যুবকেরা তাঁর কথা শুনে হাত ছুড়ে, উচ্চকণ্ঠে জিহাদে যাওয়ার প্রস্তুতি ঘোষণা করছেন। যুবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই তাঁর ভাষণ, এমন জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে এঁদের কেউ কেউ যদি আকৃষ্ট হন, বিন্দুমাত্র বিস্মিত হব না। মগজধোলাইয়ের ব্যাপারটা আমরা হেসে উড়িয়ে দিতে পারি, কিন্তু এই ভিডিও ভাষণ শোনার পর তেমন কিছু করা যে নেহাতই মূর্খতা, তাতে আমার সন্দেহ নেই।
এই ভাষণের কোথাও যুবকদের প্রকৃত ধর্মের বিষয়ে কোনো জ্ঞান দান করা হয়নি। পুরো ভিডিওটি শোনার পরেও আমি কোথাও ধর্মশিক্ষার কোনো সদুপদেশ পাইনি। শিক্ষিত হওয়ার, সৎ পথে চলার, কর্মঠ হওয়ার কোনো নসিহত আমার কানে আসেনি। এর পুরোটাই ধর্মকে ব্যবহার করে যুবকদের সহিংসতায় উসকে দেওয়ার চেষ্টা। নিজের ঘরে ল্যাপটপের সামনে, অথবা মাহফিলে সবান্ধব তা শোনা হোক, কারও কারও মনে এ কথার প্রভাব পড়বেই।
শুধু জ্বালাময়ী ভাষণ শুনেই যে ছেলেমেয়েরা জিহাদে উৎসাহী হচ্ছেন, তা হয়তো নয়। আপাতসুস্থ তরুণ-তরুণীরা কেন ঘর ছেড়ে সিরিয়ামুখী হচ্ছেন, এই নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় বিস্তর গবেষণা হয়েছে। লেবাননভিত্তিক গবেষণা সংস্থা কোয়ান্টাম কমিউনিকেশনস মাঠপর্যায়ে ইউরোপীয় জিহাদিদের সঙ্গে কথা বলে গুটিকয়েক লক্ষণ চিহ্নিত করেছে। আমাদের দেশে এখনো এই ধরনের কোনো গবেষণা হয়নি, অনুমান করি আমাদের দেশ থেকে যাঁরা জিহাদে শামিল হচ্ছেন, তাঁদের ভেতরেও এই লক্ষণগুলোর উপস্থিতি রয়েছে। কোয়ান্টাম বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
১। সমাজে ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে নিজেদের ‘স্ট্যাটাস’ বৃদ্ধি। অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনাও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। মেয়েদের ক্ষেত্রে বিবাহের সুযোগ একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে থাকে।
২। এই সব যুবক-যুবতীর অধিকাংশই সমাজে থেকেও নিজেদের ‘বহিরাগত’ (আউটসাইডার) মনে করে। ধর্মের মোড়কে তারা নিজেদের হীনম্মন্যতা দূর করতে একটি ‘আন্তর্জাতিক’ সম্প্রদায়ের অংশ হয়ে নতুন আত্মপরিচয় গঠনে প্রয়াসী হয়।
৩। পশ্চিমের প্রতি ঘৃণাবোধ থেকে উদ্ভূত হয় একধরনের প্রতিশোধস্পৃহা।
৪। জিহাদে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পূর্বের ব্যর্থতা ও অপূর্ণতা পূরণের অভিলাষ।
৫। জিহাদে অংশগ্রহণ অনেকের চোখে একটি ‘অ্যাডভেঞ্চার’। কারও কারও কাছে তা দায়িত্ব পূরণের সুযোগ। আদর্শ বা আইডিওলজিও কারও কারও জন্য একটি বিবেচনা।
তবে প্রধান অনুঘটক যে জিহাদি প্রচার, তাতে সন্দেহ নেই। ইংল্যান্ডের জিহাদি যুবক-যুবতীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—এমন একজন ব্রিটিশ গবেষকের চোখে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আইএসের প্রচার-প্রচারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তাঁরা সিরিয়ায় যেতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এই অনুপ্রেরণা কখনো এসেছে পাড়ার বা শহরের কোনো প্রণোদনাদায়ী ধর্মীয় নেতার কাছ থেকে, অথবা ইন্টারনেট থেকে। বিজ্ঞানবিরোধী হলেও ইন্টারনেটের মতো আধুনিক তথ্যমাধ্যম ব্যবহারে আইএস অত্যন্ত পারঙ্গম। যে ভাষা অথবা যে কথা এদের কাছে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য, অত্যন্ত দক্ষতায় আইএস তা পৌঁছে দিচ্ছে। ইতিহাসের এক জটিল সন্ধিক্ষণে এই জিহাদে তাঁরা শামিল হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, এর ফলে যদি মৃত্যুও হয়, পৃথিবী বদলের কাজে তাঁদের ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়। আর মৃত্যুর পর তাঁদের জন্য রয়েছে অনন্ত সুখ।
হোলি আর্টিজানে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের জন্য যে আট যুবকের ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হলো, অনুমান করি, আইএসের এই প্রচার-প্রচারণা তাঁদেরও প্রভাবিত করেছে। অন্যথায় মাথায় আইএসের টুপি জড়িয়ে তাঁরা সে দণ্ডাদেশ শুনতে যেতেন না। এই প্রচারণা কেবল যে কয়েক মহাদেশ পেরিয়ে ইথারে ভেসে আসা বাণী নয়, মহল্লার অতি পারঙ্গম ও দক্ষ বক্তার কাছ থেকে পাওয়া সরাসরি নির্দেশ, তেমন অনুমান অযৌক্তিক নয়। যে ভিডিও-ভাষণটির কথা আমি বলছি, তাতে বক্তা বারবার ‘হে যুবক’ বলে উপস্থিত দর্শকদের সম্বোধন করছেন। এতেই স্পষ্ট হয় সে ভাষণের প্রকৃত লক্ষ্য কে, কী তাঁর উদ্দেশ্য।
শুধু আইন-আদালত বা নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে এই বিপদ ঠেকানো যাবে না। এই কাজ একা সরকারেরও নয়। অতি দ্রুত যে কাজটা করা দরকার তা হলো, এ–জাতীয় বাগ্মিতায় রাশ টেনে ধরা। যাঁরা ধর্মের নামে মানুষের মধ্যে ঘৃণা ছড়ান, তাঁদের চেহারাটা তুলে ধরা।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক