২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় সেনাবাহিনীর অভিযান।
২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় সেনাবাহিনীর অভিযান।

সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হয়নি, নতুন ঝুঁকি বাড়ছে

আজ ১ জুলাই এবং বাংলাদেশের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ইতিহাসে একটি কালো এবং বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ২০১৬ সালের এই দিনে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঘন্যতম এবং ভয়ানক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ১৭ বিদেশি এবং ৫ বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু ঘটে। ২০১৬-এর পর পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব এখনো বাংলাদেশে রয়ে গেছে। তাই আজ বাংলাদেশের জঙ্গি পরিস্থিতি এবং এর অবস্থান নিয়ে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। খুব সংক্ষেপে যদি আমরা এই যাত্রাকে চিহ্নিত করতে চাই, তাহলে দেখা যায় যে ১৯৭৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত প্রথম প্রজন্মের বাংলাদেশি ধর্মীয় উগ্রবাদীরা আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী জিহাদে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের উগ্রবাদীরা ১৯৯৬ সালে ‘কিতাল ফি সাব্বিল্লাহ’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করে। ১৯৯৮ সালে এই সংগঠন রূপান্তরিত হয়ে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নাম ধারণ করে। ২০০১ সালে হিযবুত-তাহ্‌রীরের ধর্মীয় উগ্রবাদের তৃতীয় প্রজন্মের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ২০০৭ সালে জামাআতুল মুসলেমিনের হাত ধরে চতুর্থ প্রজন্মের যাত্রা শুরু হয় এবং পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনের হাত ধরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কার্যক্রম শুরু হয়। তারা আনোয়ার আল-আওলাকির মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং তারা দাবি করে যে তারা আল-কায়েদার একটি শাখা হিসেবে বাংলাদেশে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। পঞ্চম প্রজন্মের যাত্রা শুরু হয় কিছু শিক্ষিত উগ্রবাদীকে নিয়ে, যারা আইএস দ্বারা প্রভাবিত। তারা বাংলাদেশকে একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ২০১৫ সালে নিউ জেএমবি তাদের আইএসের বাংলাদেশি শাখা হিসেবে দাবি করে। ( সূত্র: হু আর দ্যা বাংলাদেশি ইসলামি মিলিট্যান্টস?, আলী রীয়াজ)

হোলি আর্টিজান বেকারি আক্রমণের ঘটনার পর বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্ত্রাস দমনের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাদের কঠোর ও বিভিন্নমুখী তৎপরতার মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। তবে এই সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রধানত ‘কাইনেটিক’ বা শক্তি প্রয়োগভিত্তিক ছিল এবং যার ফলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে এবং স্তিমিত হয়ে যায়। তবে কোনোভাবেই এর অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করা গেছে। আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিয়মিত জঙ্গি মতাদর্শে দীক্ষিতরা তাদের কর্মপরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের বিভিন্ন স্তরে গ্রেপ্তার হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর গোপন আস্তানা এবং সেখানে মজুত অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদি উদ্ধার হচ্ছে। বোঝা যায়, সন্ত্রাসী হামলার মতো ঘটনা না ঘটলেও তাদের কর্মকাণ্ড, নতুন কৌশল গ্রহণ, সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা ও প্রস্তুতি থেমে নেই।

বর্তমানে অতিমারির কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্ব একটি কঠিন সময় পার করছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ওপর এর প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কোনো বড় কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। তবে নিজেদের মতাদর্শ বিস্তার ও সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই সময়কে কাজে লাগানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান কোভিডকালীন বাস্তবতায় আমাদের জীবনের একটা বড় সময় কাটছে কম্পিউটার পর্দার সামনে। এই ‘পর্দার সময়’ বা স্ক্রিন টাইম সাধারণভাবে ৬০ ভাগ বেড়েছে। তরুণদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি হতে পারে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের উগ্র মতবাদ ছড়ানোর কাজে এই পরিস্থিতির সুযোগ সম্পূর্ণভাবে নিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা অনলাইনে সদস্য সংগ্রহের প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ৯ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পুলিশের এক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গ্রেপ্তার ২৫০ ধর্মীয় সন্ত্রাসীর মধ্যে ৮২ শতাংশই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাথমিকভাবে উগ্র মতবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। বর্তমান কোভিডকালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে দীক্ষিত হওয়ার যে বাড়তি সুযোগ ও পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার ফলাফল আমরা হয়তো সামনে দেখতে পেতে পারি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা এবং ইতিমধ্যে সেই কার্যক্রম শুরু করেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, একই সঙ্গে আফগান নিরাপত্তা পরিস্থিতি আবার অস্থিতিশীল হয়ে যাচ্ছে। তালেবান বাহিনী তাদের অভিযানের মাত্রা ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দ্রুত তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী আফগানিস্তানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল এখন তালেবানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। আমরা জানি যে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের গোড়াপত্তনের সঙ্গে সোভিয়েতবিরোধী আফগান জিহাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আফগানিস্তানে গিয়ে জিহাদে যোগ দেওয়া বাংলাদেশিরাই ফিরে এসে দেশে জঙ্গিবাদের বীজ রোপণ করে। তাদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং আফগানফেরত যোদ্ধারা সেগুলোর নেতৃস্থানীয় পদগুলো গ্রহণ করে।

বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে স্তিমিত হলেও এতে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। আমরা বরং দেখতে পাচ্ছি যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন হুমকি ও ঝুঁকির পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। সাইবার উগ্রবাদ, নবীন উগ্রবাদ, নারী উগ্রবাদের মতো বিপদ বাড়ছে। কোভিড পরিস্থিতি মধ্যে নতুন করে জৈব সন্ত্রাসবাদের জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

আফগানফেরত এই যোদ্ধাদের অনেকেই তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং আল-কায়েদার জন্মলগ্নে নেতৃস্থানীয় পদেও তাদের অবস্থান ছিল। ‘দুটি পবিত্র স্থানের জমি দখল করা আমেরিকানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা’-সংক্রান্ত আল-কায়েদার ৩০ পৃষ্ঠার ফতোয়ায় যে চার নেতা সই করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে হুজি নেতা ফজলুর রহমানও ছিলেন। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে তালেবানের উত্থানের যে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসীরা উজ্জীবিত হতে পারে এবং জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এরই মধ্যে দেখা গেল যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের চার যুবক এই নতুন আফগান যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য যাত্রা করার প্রস্তুতি নেওয়ার পর্যায়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে।

ইরাক ও সিরিয়া থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর দায়েশ বা আইএস বিশ্বে নতুন ঘাঁটির সন্ধান করছিল। আইএস জঙ্গিদের অনেকেরই লক্ষ্য এখন আফগানিস্তান। আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে এরই মধ্যে আইএসের কর্মতৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমান ও নতুন এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছে। আমরা জানি যে আইএস বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে তার অবস্থান জোরদার করার চেষ্টা চালিয়েছে। আফগানিস্তানে যদি তারা নতুন করে তাদের অবস্থান শক্ত করতে পারে, তবে বাংলাদেশের জন্য তা হবে ঝুঁকিপূর্ণ।

বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে স্তিমিত হলেও এতে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। আমরা বরং দেখতে পাচ্ছি যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন হুমকি ও ঝুঁকির পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। সাইবার উগ্রবাদ, নবীন উগ্রবাদ, নারী উগ্রবাদের মতো বিপদ বাড়ছে। কারাগারে আটক জঙ্গিদের উগ্র মতাদর্শ বিস্তারের নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে। তা ছাড়া কোভিড পরিস্থিতি মধ্যে নতুন করে জৈব সন্ত্রাসবাদের জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও বিভিন্ন তৎপরতা দেখা গেছে। এই জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্বকে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কাজে লাগাতে পারে। বর্তমানে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে অস্থিতিশীলতা ও গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া এই জনগোষ্ঠীর ওপর পড়ার আশঙ্কা আছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে উগ্র মতবাদ ছড়িয়ে পড়া এবং আঞ্চলিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হওয়ার আশঙ্কাটা বড় আকারে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশে জঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি শুধু ‘কাইনেটিক’ অপারেশন বা শক্তি প্রয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে এখনই পাল্টা উগ্রবাদ কৌশল প্রণয়নের প্রয়োজন আছে। পুরো সমাজ ও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে যুক্ত করে এবং সরকারের সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে উগ্রবাদ মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে। ডির‌্যাডিক্যালাইজেশনের মতো বিশেষায়িত জাতীয় কৌশলনীতি প্রণয়ন করতে হবে। জঙ্গিদের পুনর্বাসনের কর্মসূচি নিতে হবে, কারাগার যেন জঙ্গিবাদ ছড়ানোর ক্ষেত্র না হয়, সেই লক্ষ্যে কর্মসূচি নিতে হবে। তরুণসমাজকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের এখনই প্রযুক্তিগতভাবে পাল্টা উগ্রবাদবিরোধী কৌশল নিতে হবে। অ্যাডহক বা অস্থায়ী কৌশলের পথ পরিহার করে সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে দেখতে হবে। তাহলেই সন্ত্রাসবাদকে শুধু সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং জাতীয় পর্যায়েই নির্মূল করার পথে অগ্রসর হতে পারব।

মেজর জেনারেল এ এন এম মুনিরুজ্জামান এনডিসি, পিএসসি, (অব.), প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ