২০১১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক জনমত প্রতিষ্ঠান গ্যালপ এশিয়ার ২১টি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের ওপর সে দেশের মানুষের কেমন আস্থা আছে, তা জানার জন্য একটি জরিপ চালিয়ে তালিকা প্রকাশ করে। দেখা যায়, এই ২১টি দেশের মধ্যে শেখ হাসিনার অবস্থান সপ্তম। তিনি তখন ভারত, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীদের ওপরে অবস্থান করছিলেন। জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছিল, শেখ হাসিনার ওপর ৭৭ ভাগ মানুষের আস্থা আছে। যখন এই জরিপ চালানো হয়, তখন শেখ হাসিনার সামনে অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্তের বেপরোয়া দুর্বৃত্তপনা। তখন আমি একটা দৈনিকে ‘লাভের গুড় যেন পিঁপড়ায় না খায়’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম। তাতে লাভ হয়নি কিছু।
২০১৩ সালে এই ছাত্রলীগ নামধারী দুর্বৃত্তদের নিয়ে প্রথম আলোয় আমার আরেকটি লেখা প্রকাশিত হলে ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা আমাকে আমার এই আগের কর্মক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এমনিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যাওয়ার তেমন একটা প্রয়োজন নেই। তার পরও যেতে হয়, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ও সিনেটে আমি আচার্য তথা রাষ্ট্রপতির একজন প্রতিনিধি।
আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার পর ভেবেছি, এই কর্মী বা ছাত্রনেতারা কি জানেন নব্বইয়ের দশকে যখন ক্যাম্পাস থেকে সব প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছাত্রশিবির কর্তৃক বিতাড়িত, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকেরাই অনেকটা এককভাবে এর বিরুদ্ধে নানাভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন? তাঁরা কি জানেন, আমার সহকর্মীদের নিয়ে আমরা শহরের একটি বেসরকারি কলেজে প্রতীকী ক্লাস নিয়েছি এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে এখনো তা নজিরবিহীন? সেই প্রতীকী ক্লাসে হাজার হাজার শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। সেসব ইতিহাস তাঁরা জানেন না অথবা জানার চেষ্টা করেন না বলে বর্তমানে সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগ এখন একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। পত্রিকার পৃষ্ঠা খুললেই সারা দেশে ছাত্রলীগ নামধারীদের এই দুর্বৃত্তপনার সংবাদ প্রতিদিন পাঠকদের পড়তে হয়, রামদা, চাপাতি, পিস্তল হাতে তাঁদের ছবি দেখতে হয়। যারা শেখ হাসিনার সাফল্য কামনা করেন অথবা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থন করেন, তাঁদের এসব দৃশ্য মারাত্মকভাবে বিব্রত করে। এই মুহূর্তে গ্যালপ যদি ২০১১ সালের মতো একটি জরিপ করে, তাহলে ফলাফল কেমন হবে জানি না। তার যদি অবনতি হয়, তাহলে তার সিংহভাগ দায়দায়িত্ব তো যারা এই দুর্বৃত্তপনার সঙ্গে জড়িত, তাদেরই নিতে হবে।
যে ছাত্রলীগ একদা দেশের সব রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের এমন অবস্থা কেমন করে হলো? তার কারণ নানাবিধ। প্রধান কারণ হচ্ছে, কিছু অপরিণামদর্শী স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতার ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা। ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগ ‘মুজিববাদ’ আর ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ আদর্শের ভিত্তিতে ভাগ হয়। প্রথমটার নেতৃত্বে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখেরা। অন্য দলের নেতৃত্বে ছিলেন আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আ ফ ম মাহবুব উল হক। কিন্তু ছাত্রলীগের ব্র্যাকেটে লেখা হতো ‘মুজিববাদ’ অথবা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’। কোনো নেতার নামে কিন্তু ছাত্রলীগ তখনো পর্যন্ত ব্র্যাকেটবন্দী হয়নি। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নামে পরিচিতি পাচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়াল, এসব ছাত্রলীগ এখন আর তাদের সংগঠনের মূল আদর্শ ধারণ করে না, তারা মূল দলের নেতার ভাড়াটে কামলা হিসেবে নিজেদের পরিচিত করে তুলতে পছন্দ করে। তবে এটাও সত্য, ছাত্রলীগের আদর্শ কী, তা কজন ছাত্রলীগ নেতা জানেন, তা গবেষণার বিষয়।
ছাত্রলীগের বেহাল অবস্থা দেখে এখন তাদের দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগের কেউ নিতে চান না। কেউ কেউ বলবেন, ছাত্রলীগের দায়দায়িত্ব তো ছাত্রলীগকেই নিতে হবে, আওয়ামী লীগ কেন নেবে? আদর্শাবস্থায় পর্যবেক্ষণটা সঠিক। কিন্তু বর্তমানে যাঁরা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আছেন, তাঁদের কজনের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা আছে? যখন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ হানাহানি করে, নিজেদের কর্মী হত্যা করে, প্রথমে ছাত্রলীগের নেতারা ত্বরিতগতিতে ঘোষণা করেন, ছাত্রলীগের সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক নেই। এটি বলা খুব সহজ, যেমনটি সম্প্রতি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় দেখা গেল। সেই সংঘর্ষে ছাত্রলীগের এক কর্মী খুন হলেন, প্রক্টর গুলিবিদ্ধ হলেন, অনেক ছাত্র গুরুতর আহত হলেন। তার পরও নেতারা বললেন, যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা ছাত্রলীগের কেউ নয় এবং যিনি নিহত হয়েছেন, তিনি বহিরাগত। ভালো কথা, বহিরাগত। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁকে সেখানে নিয়ে গেল কারা?
যারা দিনদুপুরে এই ঘটনার সূত্রপাত করেছে, তাদের তো সবাই দেখেছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের ছবি ছাপা হয়েছে। তার পরও কেন এই অস্বীকার? নেতারা কি বুঝতে পারেন না দেশের মানুষ এত বোকা নয় এবং তাঁদের কথা কেউ বিশ্বাস করে না?
২৩ নভেম্বর বিশ্বখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগ নামধারীদের দুর্বৃত্তপনা নিয়ে এক উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে এবং সেখানে প্রসঙ্গক্রমে আওয়ামী লীগের নামও এসেছে। নেতারা এখন বলতে পারবেন না দেশের কোনো কোনো মাধ্যম তাঁদের ‘সুনাম’ ক্ষুণ্ন করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। শাহজালাল ঘটনায় পুলিশ যাঁদের আটক করেছে, সেখানে তো অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের সদস্য নেই। এর জবাবে নেতারা কী বলবেন?
কোনো কোনো সময় আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতাকে বলতে শোনা যায়, ছাত্রলীগের মধ্যে শিবিরের লোকজন ঢুকে গেছেন, তাঁরাই এই কাজ করছেন। প্রশ্ন, কীভাবে তা হয়? ২২ নভেম্বর ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগে শিবিরের কোন কোন নেতা ঢুকেছেন, তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দিয়েছে। এই সম্পর্কে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য জানতে ইচ্ছা করছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করার তৎপরতা বহুদিনের। মাঝখানে প্রায় দেড় মাস বন্ধ বা অচল ছিল। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি চট্টগ্রাম সফরের সময় অনেকটা বিরক্ত হয়ে চট্টগ্রাম মহানগরের প্রভাবশালী নেতাদের ডেকে বললেন, তিনি একমুহূর্তও আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ বা অচল দেখতে চান না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের নেতাদের নামে ব্র্যাকেটবন্দী। একজন নেতা প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, তাঁর গ্রুপ কোনো সমস্যা করে না, অন্যজনের গ্রুপ করে। প্রধানমন্ত্রীর সাফ জবাব, তিনি কোনো কথা শুনতে চান না, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা দেখতে চান।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আওয়ামী লীগের নেতাদ্বয় এক বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন আর নয় কোনো বিভেদ। তাঁরা এখন থেকে একযোগে কাজ করবেন। ঠিক এক দিন পরেই এক নেতার অনুসারীদের মিছিল বের হলো, তাঁর নামে স্লোগান দিল, তখন অন্য নেতার অনুসারীরা বাইরে অবস্থান করছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন ধরে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। ঘোষিত হলে পরিস্থিতি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে খারাপ হতে পারে বলে অনেকেরই ধারণা। গত মঙ্গলবার ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবার সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় আবার অচল হওয়ার এটি পূর্ব লক্ষণ। চট্টগ্রামের একজন বড় মাপের নেতার ধারণা, ৭০ ভাগ ছাত্রছাত্রী ছাত্রলীগকে সমর্থন করেন। সুতরাং হলের ৭০ ভাগ আসন তাদের বরাদ্দ দেওয়া উচিত! এমন অযৌক্তিক কথা এর আগে কখনো শুনিনি।
বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পাঁচ ভাগ শিক্ষার্থীও ছাত্ররাজনীতির নামে সন্ত্রাস আর দুর্বৃত্তপনা সমর্থন করেন না। ছাত্রসংগঠনগুলো সন্ত্রাসনির্ভর, নেতাদের কামলা হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত এই দুর্বৃত্তপনা বজায় রাখছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই দেশে কোনো সুষ্ঠু ছাত্ররাজনীতি গড়ে উঠবে না আর জাতি বঞ্চিত হবে সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে। ছাত্রসংগঠনগুলোর সংস্কার দ্রুত প্রয়োজন। শুরুটা করতে হবে সত্যিকারের ছাত্রদের ওপর ছাত্ররাজনীতি ছেড়ে দিয়ে। লেজুড়বৃত্তি বন্ধ না হলে এই ছাত্ররাজনীতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। ফলে ছাত্রসংগঠনগুলোয় নেতার জন্ম হচ্ছে না, দুর্বৃত্তের জন্ম হচ্ছে।
শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে যে মনোভাব দেখিয়েছেন, তাতে এটি পরিষ্কার, তিনি এ ধরনের ছাত্ররাজনীতি দেখতে চান না। সিলেট পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন কারও দিকে না তাকিয়ে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এই মুহূর্তে তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ছাত্রলীগ নামধারীদের বেপরোয়া দুর্বৃত্তপনার অবসান ঘটানো।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।