সন্তানদের নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করার আগে ভাবুন

সন্তানের মুহূর্তগুলোর স্মৃতি ধরে রাখতে ছবি তুললে বা ভিডিও করলেও ফেসবুকে দেওয়ার আগে একটু ভেবে নিন। মডেল: তাথৈ ও দিলারা ইয়াসমীন।
 ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ইদানীং অনেক মা-বাবা সন্তানদের জীবনের নানা বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। তার মধ্যে আছে শিশুদের পছন্দ-অপছন্দ, পড়াশোনা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অর্জন, সমস্যা ইত্যাদি। শিশুরা ভয় পাচ্ছে বা কাঁদছে—এমন ভিডিও শেয়ার করা হয়। কোভিড-১৯-এর সময় বাংলাদেশসহ বেশির ভাগ স্থানেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে। শিশুদের নিয়ে মা-বাবার পোস্ট করাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

মার্কিন যুক্তরা ভোটস ফর স্কুল নামে সংস্থা ১৬ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রীর ওপর একটি জরিপ চালায়। ৫৫ শতাংশের বেশি শিশু জানিয়েছে, তারা ভবিষ্যতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সন্তানদের নিয়ে কোনো কিছু প্রকাশ করবে না। মা-বাবার করা পোস্টগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য অনলাইনে থেকে যায় এবং তাদের জন্য বিব্রতকর হতে পারে—এ নিয়েই শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন। কারও আশঙ্কা, এতে তাদের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হবে। এক শিশুর মতে, ‘মা-বাবা ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই পোস্ট করেন, তবে কখনো কখনো তার পরিণতি ভয়াবহ হয়।’

শিশুদের অবস্থান, নাম, জন্মতারিখ, বিদ্যালয়ের নামসহ ব্যক্তিগত তথ্যের প্রকাশ তাদের ঝুঁকির মুখে ফেলে। খারাপ উদ্দেশ্য আছে—এমন কেউ এ তথ্য অপব্যবহার করে নানা ধরনের ক্ষতি করতে পারে। শিশুদের স্বল্পবসনের ছবি পোস্ট করার কারণে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার ই-সেফটি কমিশনার জানান, পেডোফাইল ইমেজ শেয়ারিং সাইটে তিনি যেসব ছবি পর্যালোচনা করেছেন, তার প্রায় অর্ধেকই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং পারিবারিক ব্লগে মা-বাবার পোস্ট করা। যাদের শিশুদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে প্রবণতা আছে, তারা এ সাইটগুলোয় ছবি আদান-প্রদান করে। পোস্ট করা তথ্য বা ছবির সাহায্যে শিশুর পরিবারকে ফাঁদে ফেলে প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় জানা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের অর্ধেকের বেশি অনলাইনে শিশুদের নিয়ে বিব্রতকর কিছু প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে অনুপযুক্ত ছবি পোস্ট করেছে ২৭ শতাংশ। এর ফলে স্কুলে শিশুদের উপহাসের শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। তা ছাড়া পরবর্তী সময়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা নিয়োগদাতারা এ ধরনের পোস্ট দেখে ফেললে প্রার্থী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে।

শিশুদের সব ধরনের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে, যার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মা-বাবার আচরণের ফলে ক্ষতিও অন্তর্ভুক্ত। মা-বাবার পোস্টের কারণে অনলাইনে শিশুদের একধরনের ভাবমূর্তি তৈরি হয়, যার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এর থেকে বেরিয়ে এসে পরবর্তী সময়ে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব নিজের মতো করে তুলে ধরা সহজ নয়।

মা-বাবা সন্তানদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করবেন, তা আশা করা অবাস্তব। পরিবারের সদস্যরা যখন পরস্পরের থেকে দূরে বাস করেন, তখন শেয়ার করার মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। মা-বাবা নির্দিষ্ট কোনো সমস্যা নিয়ে পোস্ট করার পর অন্যদের পরামর্শ ও সহায়তা পেতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিমিত ব্যবহারের সুফল আছে।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সামাজিক মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ‘প্রিপেয়ারিং ফর আ ডিজিটাল ফিউচার’ প্রকল্পের অন্যতম গবেষক সোনিয়া লিভিংস্টোন বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি পরিবারের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, যেখানে অল্পবয়সী শিশুরাও আশা করে যে মা-বাবা তাদের ছবি কম শেয়ার করবেন এবং তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আরও পরামর্শ করবেন। কীভাবে মা-বাবাকে পোস্ট করা বন্ধ করতে বলা যায়, তা শিশুরা শিখছে। শিশুদের অনুভব করতে হবে যে তাদের সম্মান, মর্যাদা এবং নিজেদের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে, যা গোপনীয়তাসংক্রান্ত ধারণার কেন্দ্রবিন্দুতে এবং শিশুদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের নিয়ে পোস্ট করার আগে এ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করতে হবে।’

শিশুদের সব ধরনের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে, যার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মা-বাবার আচরণের ফলে ক্ষতিও অন্তর্ভুক্ত। মা-বাবার পোস্টের কারণে অনলাইনে শিশুদের একধরনের ভাবমূর্তি তৈরি হয়, যার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এর থেকে বেরিয়ে এসে পরবর্তী সময়ে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব নিজের মতো করে তুলে ধরা সহজ নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখনো বিকশিত হচ্ছে এবং এর ব্যবহারের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে এসবে সন্তানদের নিয়ে কিছু প্রকাশের আগে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। প্রথমত, শিশুদের নিয়ে যতটা সম্ভব কম পোস্ট করা উচিত। সবকিছুর ছবি তোলা এবং শেয়ার করার প্রলোভন এড়ানো দরকার। মা-বাবাকে ভাবতে হবে যে তাঁদের পোস্টের কারণে সন্তানেরা ভবিষ্যতে লজ্জিত, বিব্রত, উদ্বিগ্ন বা বিরক্ত হবে কি না। এতে সন্তানের কোনো ক্ষতি হতে পারে কি? মা-বাবা ও সন্তানের সম্পর্কে কি কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে?

দ্বিতীয়ত, শিশুদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তথ্য প্রকাশ করা এড়িয়ে চলতে হবে। পোস্ট দেখে যাতে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার রুটিন সম্পর্কে কেউ জানতে না পারে, তা খেয়াল রাখাটা জরুরি। জিওট্যাগিং (যার মাধ্যমে ইন্টারনেটে একজন ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়) বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। তৃতীয়ত, এমন কোনো ছবি প্রকাশ করা উচিত নয়, যেখানে শিশুরা পর্যাপ্ত কাপড়চোপড় পরে নেই (যেমন: সাঁতারের সময় পরিধেয় পোশাক)। চতুর্থত, গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি সেটিংস এমন হবে, যাতে পোস্টগুলো শুধু বিশ্বস্ত বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যরা দেখতে পারে। তারা যাতে এই পোস্ট শেয়ার না করে, তা বলে দিতে হবে। পঞ্চমত, চার বছর বয়সেই শিশুরা আত্মসচেতন হয়ে ওঠে। শিশুদের নিয়ে পোস্ট করার আগে তাদের মতামত জানতে চাইতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিশুদের ‘না’ বলার অধিকার আছে এবং মা-বাবার উচিত তাদের মতকে সম্মান করা।

শিশুদের নিয়ে কোনো কিছু প্রকাশ করা, যাতে তাদের ক্ষতির কারণ না হয়, সে বিষয়ে বাংলাদেশের মা-বাবার সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সন্তানদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মা-বাবার আচরণ এবং এ নিয়ে শিশুদের মতামত জানার জন্য গবেষণা দরকার। এতে শিশুদের সুরক্ষায় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা শিখতে পারি।

মা-বাবা যদি শুধু ‘লাইক’ পাওয়ার জন্য পোস্ট করেন, তাহলে শিশুরাও শিখবে যে অন্যের অনুমোদন ও প্রশংসাই জীবনের সবকিছু। এটি তাদের সুষ্ঠু বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে। মা-বাবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিষ্টাচার বজায় রাখলে সন্তানদের সামনে তাঁরা ভালো দৃষ্টান্ত তুলে ধরবেন এবং অনলাইনের জগতে বিচরণ শিশুদের জন্য ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হবে।

লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী

laila.khondkar@gmail.com