বাঘা তেঁতুল

সত্য, শুভ ও সুন্দরের প্রত্যাশায়

.

কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের যাঁরা উদ্ভাবক, তাঁরা যদি জানতেন এ জিনিস বাংলার মাটিতে যাবে, তাহলে কস্মিনকালেও তাঁরা তা আবিষ্কার করতেন না। যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যকীয় জিনিসটির এমন অপব্যবহার তাঁদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভবপর হতো না। এবং এখন তাঁদের আত্মা মহাজগতের যেখানেই থাকুক না কেন, সে আত্মা অনুশোচনায় হাহাকার করছে, আর বলছে: হায়, একটি জনগোষ্ঠীর কী সর্বনাশটাই না আমরা ঘটিয়েছি।
বিদেহী মানবাত্মার বিরুদ্ধে যদি ফৌজদারি মামলা করার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে মোবাইল আবিষ্কারকদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার হাকিমদের আদালতে ৩০২ ধারায় এত দিনে বহু মামলা রুজু হয়ে যেত। রেললাইন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলে তুমুল গল্প জুড়ে দিয়ে অথবা ব্যস্ততম রাস্তা পারাপারের সময় দিগ্বিদিক না তাকিয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে যারা ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে বা গাড়ি চাপায় মারা যাচ্ছে, তাদের খুনের দায় রেলগাড়ি বা বাস-ট্রাকের চালকের ওপর চাপানো যাবে না। তাদের অপমৃত্যুর দায় মোবাইল ফোনের আবিষ্কারকদেরই নিতে হবে। এই বস্তুটি যদি দুনিয়ায় না থাকত, তাহলে তা বাংলাদেশেও আসত না, ওই লোকগুলোও মারা যেত না।
কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট প্রভৃতির উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু সেই মোবাইল ফোন ভেঙে দিয়েছে কত নর-নারীর সংসার, কত মেয়ের জীবন গেছে নষ্ট হয়ে, কত কিশোরীর শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেছে শুরু করার সময়ই। আর কম্পিউটার ইন্টারনেট? মানবজাতির ইতিহাসে যা এক বিস্ময়কর প্রযুক্তি। যা হওয়ার কথা এ যুগের মানুষের জন্য আশীর্বাদ, তা-ই আজ বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের কাছে অভিশাপের মতো আবির্ভূত হয়েছে। এবং তা হয়েছে এই যন্ত্রগুলোর দোষে নয়, এই প্রযুক্তির গুণের কারণে এবং যে মানুষগুলো এসব ব্যবহার করছে, তাদের স্বভাবের কারণে। আগুন জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয়, বস্তুত আগুন ছাড়া মানুষের জীবন অকল্পনীয়। কিন্তু সেই আগুনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সবকিছু ছারখার করে দিতে পারে।

গত সপ্তায় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ‘স্কুলগামী শিশুদের প্রায় ৭৭ শতাংশ পর্নোগ্রাফি দেখে। বাণিজ্যিকভাবে তৈরি পর্নোগ্রাফির চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ঘিরে তৈরি পর্নো ভিডিও মানুষ বেশি দেখছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশে তৈরি এই পর্নোগ্রাফিগুলোতে যাদের ভিডিও দেখানো হচ্ছে, তাদের বয়স ১৮-এর কম। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবেই পর্নোগ্রাফির ঝুঁকি বাড়ছে।...ঢাকার ৫০০ স্কুলগামী শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৭৭ শতাংশ শিশু নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখছে। তারা সুস্থ যৌনশিক্ষার বিপরীতে বিকৃত যৌনশিক্ষার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে।’ [সমকাল, ২ অক্টোবর]

সমীক্ষাটি করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামক একটি বেসরকারি সংস্থা। কোনো জরিপ বা সমীক্ষাই শতভাগ নির্ভুল নয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তা ভুল। এই সংস্থার সমীক্ষাটি বলেছে, ৭৭ শতাংশ শিশু পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। আর একটি সমীক্ষা করলে দেখা যাবে ৭৫ বা ৭৮ শতাংশ কিংবা এ রকমই কোনো একটি সংখ্যা। স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে পর্নোগ্রাফি এভাবে ছড়িয়ে পড়া যে জিকা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার চেয়ে কম ভয়াবহ নয়, তা আমাদের সমাজপতি ও রাষ্ট্রনেতাদের বিবেচনায় আসেনি।

উল্লেখিত গবেষণা সমীক্ষায় আরও উল্লেখ করা হয়, ‘চারটি পদ্ধতিতে অশ্লীল ভিডিও তৈরি হচ্ছে। তাতে ১৮ বছরের কম বয়সী স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দেখা যাচ্ছে। ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ঘিরে তরুণ-তরুণীরা বিভিন্ন ধরনের পর্নো ভিডিও তৈরি করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তরুণ-তরুণী কেউই জানে না, তৃতীয় কোনো ব্যক্তি লুকিয়ে ভিডিও করছে। মোবাইল ফোনের সঙ্গে ভিডিও রেকর্ডিং-সুবিধা থাকায় এ ধরনের পর্নো ভিডিও তৈরি হচ্ছে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে, তাদের হাতে মোবাইল ফোন গেল কীভাবে? জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া সিম নিবন্ধন করা নিষিদ্ধ। ১৮ বছরের কম যাদের বয়স, তারা যদি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে চায়, তাহলে তাদের অভিভাবকদের নামে নিবন্ধন করা সিম ব্যবহার করতে হবে। ওই সমীক্ষা নিয়ে রিপোর্ট হওয়ার পর আমি ধানমন্ডি এলাকার কয়েকটি স্কুলের কাছে ছুটির সময় গিয়ে দাঁড়াই। দেখতে পাই ১০-১২ বছরের কম বয়সী ছয়-সাতটি শিশু স্কুলের গেট দিয়ে বেরিয়ে ফোনে কথা বলছে। কেউ দৌড়ে তার মা বা বাবার কাছে যাচ্ছে, কিন্তু কানে ফোন। যার বাবা-মার টাকা আছে, সে দামি মোবাইল ফোন, ট্যাব ও সেগুলোর ইন্টারনেট সংযোগ পাবে, তা তাদের ফান্ডামেন্টাল রাইট। তাতে আপত্তি করার আমরা কেউ নই।

গত ১০০ বছরে বাঙালি জাতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজন্মকে পেয়েছিল। সেই দুই প্রজন্মের অর্জন অপরিমেয়। একটি প্রজন্ম ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটায় ১৯৪৭-এ। আ​েরকটি প্রজন্ম, যেটা আমাদের প্রজন্ম, পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করে। দুই যুগের মানুষের প্রচুর অর্থবিত্ত ছিল না, উন্নত প্রযুক্তি ছিল না, কম্পিউটার-মোবাইল ছিল না। ইন্টারনেট কী তা তারা জানত না। তারা বেড়ে উঠেছিল শুধু বই পড়ে।

ইংরেজ আমলের বিপ্লবী ও রাজনৈতিক সমাজকর্মীরা জীবন গড়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন বই পড়ে। তখন প্রতিটি পাড়ায় এমনকি বহু বাড়িতে পাঠাগার ছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেও ঢাকাতেই বহু গণপাঠাগার ছিল। শুধু আজিমপুর-লালবাগেই ছিল কয়েকটি গণগ্রন্থাগার। পুরানা পল্টন, শান্তিনগর, ফরাশগঞ্জ ও গেন্ডারিয়ার পাঠাগারগুলোতে আমিও পড়তে গিয়েছি।

পঞ্চাশের দশকে এমনকি মধ্য ষাটেও ঢাকা নগরী ছিল খোলামেলা। এক পাড়ার সব মানুষ সবাইকে চিনত। যেসব পুরোনো বাড়িতে আমরা বাস করতাম তাতে ছিল উঠান। সেখানে বাচ্চারা খেলত। তা ছাড়া ছিল প্রতিটি পাড়ায় খেলার মাঠ বা ফাঁকা জায়গা, তাতে খেলাধুলা করা যেত। বহু বড় পুকুর ছিল, তাতে সাঁতার কাটা যেত। তখন বহুতল উঁচু ভবন খুব কম ছিল। গত ২০-২৫ বছরে পুরোনো দিনের একতলা-দোতলা বাড়ি ভেঙে বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট বানানো হয়েছে। তার একেকটি ফ্ল্যাটে খুব কম হলে কুড়িটি পরিবার, কোনোটিতে ৬০-৭০ থেকে ১০০টি পরিবার বাস করে। খেলার মাঠ নেই। ছেলেমেয়েরা যাবে কোথায়? তারা কেউ কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলে, ফেসবুক ঘাঁটে, কেউ দেখে পর্নো ছবি।

আমি আমার সহযোগীদের নিয়ে ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, কলাবাগান, বনানী ও গুলশানের প্রায় ৪৫টির মতো অ্যাপার্টমেন্টে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সবগুলোতেই নিরাপত্তাকর্মী ও ড্রাইভারদের বিশ্রামকক্ষ ও নামাজের ঘর আছে। কোনো কোনোটিতে কমিউনিটি হল ও অতিথিদের বসার ঘরও আছে। কিন্তু একটিতেও কোনো পাঠাগার নেই।

বহুতল অ্যাপার্টমেন্টে শ দেড়েক থেকে হাজারখানেক মানুষ বাস করে। তার এক-তৃতীয়াংশ শিশু-কিশোর। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টে যদি ছোট একটি পাঠাগার থাকে, তাহলে ফ্ল্যাটগুলোর বাসিন্দারা, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে যাঁরা কর্মজীবী নন, তাঁরা অবসরে পাঠাগারে গিয়ে বই পড়তে পারেন। ছোট ছেলেমেয়েরা হবে অত্যন্ত উপকৃত। তা ছাড়া ড্রাইভার ও নিরাপত্তাকর্মীরাও বই পড়ার সুযোগ পাবেন। প্রতিটি বহুতল ভবনে যদি পাঠাগার থাকে, একটি জ্ঞান-আলোকিত সমাজ গঠনে তা খুব বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। বিষয়টি অ্যাপার্টমেন্টগুলোর মালিকদের ভেবে দেখতে সবিনয় অনুরোধ করছি।

কয়েক মাস যাবৎ প্রথম আলোতে দেশের বিভিন্ন গণগ্রন্থাগার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে দেখা যায়, অনেক গ্রন্থাগারে বই আছে যথেষ্ট, পাঠক নেই। আগ্রহ ও সময়ের অভাব থাকতে পারে, তবে যানজটের ফলে এখন কোথাও যাতায়াতও কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। যুগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনধারাও বদলে যায়। অ্যাপার্টমেন্টবাসীর যদি হাতের কাছে বই থাকে, তাহলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে উঠবে। তারা পর্নোগ্রাফির মতো অনিষ্টকর প্রবণতা থেকে দূরে থাকবে। সত্য ও সুন্দরের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়বে। মানবজীবন সম্বন্ধে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হবে উদার। তারা সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদকে নিজের থেকেই ঘৃণা করতে শিখবে।

কম্পিউটার-ইন্টারনেটের উপকারিতাও সীমাহীন। সেটাও জ্ঞান অর্জনের অফুরন্ত উৎস। এগুলোর ক্ষতিকর দিক অতি সামান্য। বই পড়া ও কম্পিউটার যদি একই সঙ্গে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সোনায় সোহাগা। নির্ভর করে সদ্ব্যবহারের ওপর। প্রতিটি যুগেরই নিজস্ব কিছু সমস্যা থাকে, যা পূর্ববর্তী আর কোনো যুগের ছিল না। সেই সমস্যা সমাধানের উপায় যুগের মানুষকেই খুঁজে বের করতে হয়। যদি সেই যুগের মানুষ সমস্যাগুলো শনাক্ত করে তা সমাধানে অপারগ হয়, তাহলে তারা ব্যর্থ মানুষ। শুধু বর্তমান সময়ের সমস্যা নয়, আগামী দিনের সম্ভাব্য সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকা চাই। অতীতের চেয়ে যেহেতু এই যুগ সমৃদ্ধ, তাই এই যুগ ও পরবর্তী যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন উন্নত চরিত্রবিশিষ্ট মেধাবী মানুষের। যেসব মানুষ জঘন্য অপরাধ করে, তাদেরও সেটার ঘাটতি নেই।

মেধাকে তারা সৃষ্টিশীল ও মানবকল্যাণে ব্যবহার না করে জিঘাংসা ও ক্ষতিকর কাজে লাগাচ্ছে। সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের দায়িত্ব, তারা যাতে সেই পথে যেতে না পারে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ দায়িত্ব সরকার ও নাগরিক সমাজ দুদিকেরই।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।