মতামত

সত্যিকারের সংলাপ চাই, ‘লোক দেখানো’ কিছু নয়

মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করেছেন। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এই সংলাপে নিতান্তই অনুষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিকতার বাইরে কিছু হবে বলে আশা করা যায় না। কারণ, আমাদের সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই ২০১২ ও ২০১৭ সালের মতো আবারও একই ধরনের অনুসন্ধান কমিটি ও নির্বাচন কমিটি গঠিত হবে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেটার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে আজ একটি সত্যিকারের সংলাপ আবশ্যক।

আজ আমাদের জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন একটি রাজনৈতিক সমঝোতার এবং বহুদিনের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল দূরীকরণের লক্ষ্যে অনেক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী সংস্কার। যার লক্ষ্য হবে, তরুণদের ভাষায়, ‘রাষ্ট্রের মেরামত’।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করলে আমাদের স্বীকার করতেই হবে, যে আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল—একতা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার, সেসব থেকে প্রায় সর্বোতভাবে আমরা বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ১৯৭১ সালে একটি ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠী হলেও, আজ আমরা চরমভাবে বিভক্ত, নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতিতে লিপ্ত এক জাতিতে পরিণত হয়েছি। অপরাজনীতি, বিচারহীনতা এবং ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান এখন দৃশ্যমান সর্বত্র। সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিবর্তে আমরা স্বজনতোষণ ও সীমাহীন দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে এক ভয়াবহ বৈষম্যমূলক সমাজ সৃষ্টি করে ফেলেছি। আমরা আজ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতা আজ সর্বত্র। আমরা আজ নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত, স্বার্থপর ও চরমভাবে বিশৃঙ্খল পথ হারানো জাতির দিকেই ধাবিত হয়েছি।

অনেকেরই আজ আশঙ্কা, এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে জাতি হিসেবে আমরা এক সংকটময় ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে পারি। পরিণতিতে সারা দেশে এক নৈরাজ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আমরা সহিংস উগ্রবাদের পথেও হাঁটতে পারি। গভীর খাদে পড়ে নিজেদের ও আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলতে পারি।

আমরা মনে করি, এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে আজ আমাদের জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন একটি রাজনৈতিক সমঝোতার এবং বহুদিনের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল দূরীকরণের লক্ষ্যে অনেক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী সংস্কার। যার লক্ষ্য হবে, তরুণদের ভাষায়, ‘রাষ্ট্রের মেরামত’। আর এ সংস্কার ধারণাগুলোর ভিত্তিতে প্রণীত ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের দ্বারা স্বাক্ষরিত হতে পারে ১৯৯১ সালের ‘তিন জোটের রূপরেখা’–এর আদতে একটি ‘জাতীয় সনদ’। জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সম্ভাব্য ঐকমত্যের ক্ষেত্রসমূহ হতে পারে:

রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন: প্রতিহিংসাপরায়ণতা অবসান ঘটিয়ে রাজনীতিতে শিষ্টাচারবোধ ফিরিয়ে আনা এবং রাজপথে হানাহানির পরিবর্তে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সব জাতীয় সমস্যার সমাধান এবং জনস্বার্থকে রাজনীতির লক্ষ্যে পরিণত করা।

নির্বাচনী সংস্কার: সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে আইনকানুন ও বিধিবিধানের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এবং সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা।

নির্বাচনকালীন সরকার: গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা।

কার্যকর জাতীয় সংসদ: জাতীয় সংসদকে একটি স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, যাতে নির্বাহী বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ‘চেকস ব্যালেন্সেস’পদ্ধতি কার্যকর হয় এবং সাংসদরা আইন প্রণয়ন ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

স্বাধীন বিচার বিভাগ: প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক্‌করণের মাধ্যমে এর স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং সঠিক ব্যক্তিদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা।

সাংবিধানিক সংস্কার: সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন, যাদের সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী সময় সংবিধান সংশোধন করা।

গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক দল: গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ এবং দায়বদ্ধ রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর বিধান অনুযায়ী দলের অঙ্গ, সহযোগী সংগঠন ও বিদেশি শাখা বিলুপ্ত করা, যাতে ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিকদের ব্যবহারের রাজনীতির অবসান হয়।

স্বাধীন বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান: স্বাধীন বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যে আইনি কাঠামোতে প্রয়োজন পরিবর্তন এবং এসব প্রতিষ্ঠানে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদান করা।

দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান: একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া এবং তাঁদের অবৈধভাবে উপার্জিত এবং পাচার করা অর্থ বিদেশ থেকে ফেরত আনা।

প্রশাসনিক সংস্কার: যথাযথ প্রশাসনিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী জনপ্রশাসন আইন প্রণয়ন এবং মান্ধাতার আমলের পুলিশ আইনের সংস্কার করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা ও পেশাদারি নিশ্চিত করা।

বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার: আইনকানুন ও বিধিবিধানের পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, যাতে স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বায়ত্তশাসিত, নিয়ন্ত্রণমুক্ত ও কার্যকর হতে পারে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাযথ আইনি সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা।

শক্তিশালী নাগরিক সমাজ: একটি কার্যকর ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ গঠনের পথের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা, যাতে রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি সব সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারিত্ব করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে কার্যকর ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে পারে।

মানবাধিকার সংরক্ষণ: মানবাধিকার সংরক্ষণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসানের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংস্কৃতির অবসান করা।

একটি নতুন সামাজিক চুক্তি: রাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান আয় ও সুযোগের বৈষম্য নিরসনে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি প্রণয়ন করা, যাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত হয়, তাঁরা মানসম্মত সেবা সুলভ মূল্যে ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে পান এবং সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রের মালিকে পরিণত হন।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা: জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।

আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা: আর্থিক খাতে লুটপাট প্রতিরোধসহ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারসহ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও সব ধরনের লুণ্ঠনকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।

সাম্প্রদায়িক মানসিকতার অবসান: সমাজের সব শুভ শক্তিকে সংগঠিত করে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার মানসিকতা নিরসনে একটি কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং উগ্রবাদী শক্তিকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান বন্ধ করা।

তরুণদের জন্য বিনিয়োগ: ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’অর্জনের লক্ষ্যে তরুণদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সুযোগ সৃষ্টি এবং গ্রামীণ শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

নারীর ক্ষমতায়ন: নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি সব নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

বর্তমান সংকট উত্তরণে একটি টেকসই সমাধানে পৌঁছার লক্ষ্যে উপরিউক্ত সংস্কার ধারণাগুলোকে আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে সব স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে একটি সংলাপের আয়োজন এবং তা থেকে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে একটি ঐকমত্য সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। এই ঐক্যমত্যের ভিত্তিতেই তৈরি হতে পারে একটি জাতীয় সনদ, যাতে সব স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি স্বাক্ষর করবেন এবং জরুরি ভিত্তিতে এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবেন।

বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, যার দায়িত্ব হবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নিয়োগ। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন, তাঁদেরই দায়িত্ব হবে জাতীয় সনদের পরিপূর্ণ ও যথাযথ বাস্তবায়ন। তাহলেই আমাদের জটিল ও ভয়াবহ সমস্যাগুলোর একটি কার্যকর সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে। আশা করি, লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে জাতিকে জঞ্জালমুক্ত করতে রাষ্ট্রপতি জরুরি ভিত্তিতে একটি সত্যিকারের সংলাপ আয়োজন করবেন।

বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক