দুর্ঘটনা

সড়ক-মহাসড়কে মুখোমুখি সংঘর্ষ কেন?

প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু একটি সাধারণ খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের দুটি ঈদে এই দুর্ঘটনার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। এবার ঈদুল ফিতরের আগে-পরের বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২৫০ জন। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার ধরনের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুই গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ। এ কারণে নিহত ও আহতের সংখ্যাও সব সময় বেশি হয়। উদাহরণ হিসেবে এবারের ঈদে মুখোমুখি সংঘর্ষের কয়েকটি উল্লেখ করছি: বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়ের সংযোগ সড়কে হাটিকুমরুল এলাকায় এই ঈদের সময় ঘটা চারটি দুর্ঘটনার মধ্যে একটি ঘটেছে মুখোমুখি সংঘর্ষ, যার
বলি হয়েছেন সর্বোচ্চ ৩১ জন, ২৩ জুলাই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সরাইলের ইসলামাবাদ এলাকায় অটোরিকশার সঙ্গে যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুজন, ২৪ জুলাই ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে কাভার্ড ভ্যান-লেগুনার সংঘর্ষে লেগুনার চালকসহ পাঁচজন, একই দিন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মাদারীপুরের কালকিনিতে বাস-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের চালকসহ পাঁচজন এবং শেরপুর-ঝিনাইগাতী সড়কের আহম্মদনগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। ২৫ জুলাই ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে বাস-মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে সাতজন নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনার কারণ ও ধরন অনেক, যা গবেষণার দাবি রাখে। বাহন, সড়কের অবস্থা ও দেশভেদে যার তারতম্যও হতে পারে। তবে এই নিবন্ধে দুই যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বাংলাদেশে অনেক সড়ক ও মহাসড়ক বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করে নির্মাণ করা হয়েছে ও হচ্ছে। এসব সড়ক ও মহাসড়ক যেখানে হাটবাজার বা শহর-বন্দরের মাঝ দিয়ে পার হয়েছে, সেখানের অল্প কিছু অংশ ছাড়া সাধারণত ডিভাইডার ব্যবহার করা হয়নি (অবশ্য এর ব্যতিক্রম হচ্ছে এয়ারপোর্ট রোড়)। ডিভাইডার ব্যবহার করা না হলেও প্রচলিত প্রথায় দেশের সড়ক ও মহাসড়কগুলো, বিশেষ করে যা পরামর্শক নিয়োগ করে করা, তার অনেক অংশের মাঝ–বরাবর একটি রেখা আঁকা হয়েছে। রেখাটির বেশির ভাগ অংশ অবিচ্ছিন্ন বা সংযুক্ত (সলিড লাইন), বিশেষ করে সড়কের আঁকাবাঁকা ও মোড় ঘোরার অংশে। আবার অনেক অংশে এই রেখাটি বিচ্ছিন্ন বা কাটা কাটা (ব্রোকেন লাইন)। অর্থাৎ সড়ক-মহাসড়কের মাঝ-বরাবর আঁকা রেখাটি কোথাও অবিচ্ছিন্ন আবার কোথাও বিচ্ছিন্ন। কেন রেখাটি কোথাও অবিচ্ছিন্ন আবার কোথাও বিচ্ছিন্ন—এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে ঘরোয়াভাবে অনেক গাড়িচালককে জিজ্ঞেস করে কারও কাছ থেকে সঠিক উত্তর পাইনি। অবাক হয়েছি, এই গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক একটি বিষয় না শিখিয়ে কী করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয়। তবে অনেক চালক রেখা-সংক্রান্ত নির্দেশনাটি সম্পর্কে জানেন বলে বিশ্বাস করি।
রেখা সম্পর্কে অজ্ঞতাই যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটার একমাত্র কারণ, তা অবশ্য নয়। তবে অবিচ্ছিন্ন বা সংযুক্ত রেখা আঁকা অংশে কোনো অবস্থাতেই একজন চালক ওই রেখা অতিক্রম করে পাশের লেনে যেতে পারবেন না এবং ওভারটেক করতে পারবেন না। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এমন অবিচ্ছিন্ন বা সংযুক্ত রেখা আঁকা থাকে সড়কে, যেখানে বাঁক নেয় বা অন্য কোনো কারণে ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। উল্লিখিত রেখার বিচ্ছিন্ন বা কাটা কাটা আঁকা থাকা অংশেই শুধু একজন চালক সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পাশের লেনে যেতে পারবেন এবং ওভারটেক করতে পারবেন। এমন বিচ্ছিন্ন বা কাটা কাটা রেখা থাকে সড়কে, যে অংশ বাঁকহীন, সোজা ও অতিশয় নিরাপদ। অবিচ্ছিন্ন ও বিচ্ছিন্ন রেখার এই নির্দেশনা মেনে চলতে হবে উভয় দিক থেকে চলা চালক এবং একই দিকে চলা চালক সবারই। একজন ধৈর্যশীল ও নিয়মকানুন মেনে চলা চালক অন্য একজন অধৈর্য চালকের খামখেয়ালিপনার বলি হতে পারেন।
সড়ক সবার এবং সতর্কও হতে হবে সবাইকে। তাহলে একই লেনে ও দিকে চলতে থাকা দুটি ভিন্ন গতির যানের পেছনেরটি যদি অধিক গতিসম্পন্ন হয় এবং ওভারটেক করার প্রবণতায় থাকে, তখন তাঁকে অবিচ্ছিন্ন ও বিচ্ছিন্ন রেখার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে এবং তিনি সামনের বাহনটিকে ততক্ষণ ওভারটেক করতে পারবেন না, যতক্ষণ না বিচ্ছিন্ন বা কাটা কাটা লাইন আঁকা অংশ না পান, তা-ও অত্যধিক সতর্কতার সঙ্গে, বিশেষ করে বিপরীত দিক থেকে আসা যানবাহন লক্ষ করে। এটা যদি একজন চালক ধৈর্যের সঙ্গে মেনে চলেন, তবে তিনি মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াতে পারবেন। এ জন্য অবিচ্ছিন্ন ও বিচ্ছিন্ন অংশের নির্দেশনাটি প্রত্যেক চালকের মনেপ্রাণে গেঁথে থাকা ও ধারণ করার মতো একটি সহজ কিন্তু অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে চালক তা জানেন না এবং মনেপ্রাণে ধারণ করেন না, তাঁর তো মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটানোরই কথা। মুখোমুখি সংঘর্ষগুলোর অনেক ক্ষেত্রে চালক নিজেও তাৎক্ষণিক নিহত হন। কেউ হন চিরদিনের জন্য পঙ্গু। পরিবার বসে পথে।
মহাসড়কের অনেক জায়গায় শুধু মাঝ–বরাবরই নয়, পাশেও অবিচ্ছিন্ন রেখা আঁকা থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আঁকা এসব অবিচ্ছিন্ন রেখার বাইরে যাওয়া নিষেধ, এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিআরটিএ এ বিষয়সহ ট্রাফিক আইনকানুন-সংবলিত পুস্তিকা চালকদের নতুন লাইসেন্স দেওয়ার সময় এবং পুরোনো লাইসেন্স নবায়ন করার সময় দিতে পারে। চালকদের ধৈর্য ধরে এসব নির্দেশনা ও ট্রাফিক চিহ্নগুলো মেনে চলা উচিত নিজের জীবনের কথা ভেবে হলেও। প্রথম আলোয় ‘বিআরটিএ সংস্কারে কিছু সুপারিশ’ এমন একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম ৫ সেপ্টেম্বর ২০১১, যেখানে কিছুটা বিস্তারিত বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে, এমনটি ভাবা যাচ্ছে না। সড়ক-মহাসড়কের ওপর আঁকা উল্লিখিত রেখার রং সাদা, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হলুদ হলে ভালো হয়। তার কারণ, এই রেখাগুলো বাংলাদেশের সব সড়ক-মহাসড়কে নেই এবং রেখাগুলোর নির্দেশনার সঙ্গে বাংলাদেশের চালকেরা এখনো ভালোভাবে অভ্যস্ত নন। এ কাজটি সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের। যাদের অবশ্য পালনীয় একটি কাজ হচ্ছে রেখাগুলো সব সময় তরতাজা রাখা।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার বিষয়টি আকারে ব্যাপক। এর কারণ, সড়ক-মহাসড়কগুলো উন্নত বিশ্বের মতো উন্নত মানের নয় এবং চলছে বিভিন্ন গতির যানবাহন। এই নিবন্ধে শুধু সড়ক-মহাসড়কের মাঝ–বরাবর আঁকা একটি রেখা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চালকেরা এই লাইনের নির্দেশনা মেনে চললে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার কথা নয়। এই নিবন্ধের দ্বারা কারও সামান্যতম উপকার হলে খুশি হব।
ড. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব।