বিগত ২০১০ থেকে আমরা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের একটি টিম চাঁদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের ইলিশ মাছ নিয়ে গবেষণা করছি। চেষ্টা করছি এই মাছের প্রজনন ঋতু সঠিকভাবে নির্ধারণের। আমরা প্রজনন ঋতু নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্ত্রী মাছের জিএসআই (Gonado Somatic Index) পরিমাপপদ্ধতি ব্যবহার করছি। জিএসআই হলো মাছের ডিমের ওজন ও দেহের ওজনের অনুপাতের শতকরা হার। সাধারণত প্রজনন ঋতুতে ডিমের আকার বড় হতে থাকে বলে জিএসআই বাড়তে থাকে এবং ভরা প্রজনন মৌসুমে গিয়ে তা সর্বোচ্চ হয়। প্রজনন ঋতুতে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়ে বিগত পাঁচ বছরের জিএসআইর পরিমাপ থেকে দেখা গেছে যে বাংলাদেশে ইলিশ সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত প্রজনন করে। সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে জিএসআই ১০-১১ থেকে বাড়তে বাড়তে অক্টোবরের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকে এসে সর্বোচ্চ ১৫-১৭ পর্যন্ত পৌঁছায় এবং নভেম্বরে এসে তা হঠাৎ করে কমে যায়। ১৫-১৭ জিএসআই ইলিশের ভরা প্রজনন মৌসুম নির্দেশ করে।
অন্য অনেক মাছ, কাঁকড়া কিংবা চিংড়ির মতো ইলিশ মাছও প্রজননের ক্ষেত্রে চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে। অর্থাৎ এই মাছ ভরা পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় প্রজনন করে। মাছের প্রজননের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো তাপমাত্রা। প্রজননের জন্য চন্দ্রনির্ভর আবর্তনের ওপর নির্ভরশীল মাছ সারা বছরের মধ্যে তার পছন্দনীয় তাপমাত্রা যে মৌসুমে পাওয়া যায়, সেই মৌসুমের পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যায় প্রজনন করে। ইলিশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা ২০১০ থেকে এই বছরের অমাবস্যা পর্যন্ত গবেষণা করে দেখেছি যে অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত যে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা পড়ে, সেই সময়ে এই মাছের জিএসআই সর্বোচ্চ থাকে। এ বছরের সেপ্টেম্বরে ইলিশ ধরা বন্ধের আগে এবং অক্টোবরে পুনরায় মাছ ধরা শুরুর পর আমরা জিএসআই পরিমাপ করে দেখেছি যে তা বেড়েই চলেছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বরের নমুনায় আমরা জিএসআই পেয়েছি প্রায় ১১। আর ১০ অক্টোবরের নমুনায় জিএসআই ছিল প্রায় ১৪। অর্থাৎ আগামী পূর্ণিমা (২৭ অক্টোবর) পর্যন্ত তা আরও বাড়তে পারে। কিন্তু মন্ত্রণালয়-নির্ধারিত ভরা প্রজনন মৌসুম শেষ হয়েছে ৯ অক্টোবর।
>অন্য অনেক মাছ, কাঁকড়া কিংবা চিংড়ির মতো ইলিশ মাছও প্রজননের ক্ষেত্রে চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে। অর্থাৎ এই মাছ ভরা পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় প্রজনন করে
ইলিশ শুধু পূর্ণিমাতেই প্রজনন করবে—এ ধারণা ভুল। চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে এমন অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেখে জানা যায় যে পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যা যেকোনো সময়েই এসব মাছ প্রজনন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত ওই নির্দিষ্ট পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যার দিনসহ আগে ও পরের কয়েক দিন ধরে মাছ সবচেয়ে বেশি প্রজনন করতে দেখা যায়। কিন্তু ইলিশ মাছের প্রজনন ঋতু নির্ধারণ এবং ভরা প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে এসব বিষয় বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ২০১০ সালের অক্টোবরের ১৬ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল, আর পূর্ণিমা ছিল ২৩ অক্টোবর। পূর্ণিমার দুই দিন পর থেকে কি মাছের প্রজনন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? পরবর্তী দুই বছর ইলিশ আহরণ নিষেধের সময় ১০ দিন করে এগিয়ে আনা হলো। ২০১১ সালের অক্টোবরের ৬ থেকে ১৬ এবং ২০১২ সালে সেপ্টেম্বরের ২৫ থেকে অক্টোবরের ৫ তারিখ পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে পূর্ণিমা ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর।
২০১০ সালে যে ইলিশ ২৩ অক্টোবর প্রজনন করেছিল, ২০১২ সালে এসে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে সেই ইলিশ প্রায় এক মাস আগে প্রজনন করবে তা অসম্ভব। ২০১৩ সালে এসে ১৩ থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হলো এবং এ সময় পূর্ণিমা ছিল ১৯ অক্টোবর। ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আবার আগের নিয়মে ১০ দিন করে এগিয়ে আনতে আনতে এ বছর ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের সময় ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে ইলিশের ক্ষেত্রে প্রতি তিন বছর পরপর প্রজননের চন্দ্রনির্ভর আবর্তন পরিবর্তন হয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়? জৈবিকভাবে সেটি এত দ্রুত ঘটা কি সম্ভব? হ্যাঁ, জলবায়ু পরিবর্তন, হাইড্রোলজিক সাইকেলের ব্যাপক পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে ইলিশের প্রজনন ঋতু এক মাস এগিয়ে বা পিছিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সেটি তিন বছরের মতো এত কম সময়ে সম্ভব নয়।
ভরা প্রজনন মৌসুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধু ‘ইলিশ আশ্বিনের পূর্ণিমায় প্রজনন করে’ এই সনাতন ধারণার ওপর নির্ভর করে এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ব্যবস্থাপনাপদ্ধতি নির্ধারণ করাটা সঠিক হবে না। আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণানির্ভর তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে এর সঠিক ব্যবস্থাপনা করলে আরও অধিক ইলিশ উৎপাদন সম্ভব হবে।
ড. হারুনুর রশীদ: অধ্যাপক, মাৎস্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
rashid@bau.edu.bd