মতামত

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা হেরে যাচ্ছি কেন

ডি এল রায়ের গানে আছে, ‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।’ বাংলাদেশের জন্মের পেছনে কাজ করেছে স্বপ্ন আর স্মৃতি। এই স্বপ্ন একটা বৈষম্যহীন দেশের, ভেদহীন রাষ্ট্রের; আর স্মৃতির মধ্যে ছিল দূরায়ত সোনার বাংলা! যেখানে গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু। যে স্মৃতির মধ্যে ছিল, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটুগান গাইতাম!’ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ববঙ্গের মানুষের মোহভঙ্গ ঘটে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত, এই আওয়াজ ১৯৪৭ সালের আগস্টের আগেই উঠেছিল, আর আগস্ট থেকেই আওয়াজ আন্দোলনের রূপ পেতে থাকে।

১৯৪৮ আর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব বাংলার মানুষ বুঝতে পারে, তারা একটা আলাদা জাতিসত্তা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে শোষিত-বঞ্চিত পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতিবাদ, আশা, স্বপ্ন আর স্মৃতি ধারণ করার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে সংস্কৃতি। আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম আর সংস্কৃতির সংগ্রাম মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। সেই অভিন্ন স্রোতোধারা এসে মিলিত হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রামের মোহনায়। আমরা স্বাধীন দেশ পেলাম।

১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমাদের সংস্কৃতিসেবীরা যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের পটভূমি তৈরি করেছেন স্বাধীন প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ২০২২ সালে এসে ক্রমাগতভাবে মনে হচ্ছে যে আমাদের স্বপ্ন আর স্মৃতির বাংলাদেশ আমরা হারিয়ে ফেলছি।

এ বছর পয়লা বৈশাখের ক্রোড়পত্রে প্রথম আলো তিন সংস্কৃতিজনের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। এই সাক্ষাৎকারগুলোর দিকে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

এতে শাহরিয়ার কবির বলেছেন:

‘যাত্রা, পালাগান, কবিগান, মেলা তো বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ। কিন্তু গ্রামে গ্রামে কি এখন সেসব আছে? পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের জন্য এখন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। যাত্রাপালা আর কবিগানের জন্য নিতে হয় অনুমতি। বঙ্গবন্ধুর সময় তো এসব বিধিনিষেধ ছিল না।

‘এক যুগের বেশি সময় ধরে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি যে ’৭২-এর সংবিধান, সেখানে ফেরার কথা তারা এখন মুখেই আনে না। মুখে তারা অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে, কিন্তু কাজে প্রতিফলন দেখি না। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রতিপত্তি বেড়েছে।...পাঠাগার, মিলনায়তন বা খেলার মাঠ গড়ার কোনো উদ্যোগ নেই। সংস্কৃতি নিয়ে বড় পরিকল্পনা নেই। তাই সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন সময় সাংস্কৃতিক উৎসব করা হলেও সেগুলো সপ্রাণ হতে পারছে না। এভাবেই আমাদের সংস্কৃতি থেকে মানুষ ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে।’

নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেছেন:

‘পয়লা বৈশাখ আমাদের লোকায়ত উৎসব। সে উৎসবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের জীবনযাপনের উপকরণ পাওয়া যেত। করপোরেট আর এজেন্সিগুলো এখন বর্ষবরণের উৎসবকে দখল করেছে। একে একে আমাদের সব উৎসবকেই তারা দখল করেছে। আদতে আমাদের সংস্কৃতি এখন ক্ষমতাবানদের হাতে চলে গেছে। ফলে প্রাণের যোগ গেছে কমে, প্রায় সবই এখন আনুষ্ঠানিক। তাই সংস্কৃতির সঙ্গে জনতার বন্ধনও ক্রমেই আলগা হয়ে গেছে।’

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেছেন:

‘গ্রামগঞ্জে এখন আর আগের মতো বারো মাসে তেরো পার্বণ হয় না। মেলা বা যাত্রাপালা করার মতো পরিবেশ গ্রামে আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।...নির্মল বিনোদনের কোনো উপকরণ গ্রামের মানুষের কাছে নেই।’

সাখাওয়াত টিপুর সম্পাদনায় তর্কবাংলা প্রকাশ করেছে তর্ক নামের একটা সাময়িকী (বৈশাখ ১৪২৯)। তাতে সাংবাদিক মতিউর রহমানের একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার আছে। তাতে এসব প্রসঙ্গ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মতিউর রহমান বলেছেন, ‘যদি গণতান্ত্রিক শিক্ষা বা প্রগতিশীল সংস্কৃতির প্রসার না ঘটে, তবে এই দেশের এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না। এটা শুধু রাজনৈতিক সংগ্রাম দিয়ে হবে না, এটার পাশাপাশি জোরদার একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন লাগবে। এই জায়গায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। যেখানে আমাদের বিরাট একটা পরাজয় ঘটে গেছে।’

বিশিষ্টজনদের কথাগুলো একসঙ্গে পড়লে একটা অভিন্ন সুর পাই। একটা ছবিও পাই। সেই সুরটা হতাশার, সেই ছবিটা মলিনতার। বহুদিন আগে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী একটা কলাম লিখেছিলেন। যশোরে নিয়মিত মধুমেলা হতো স্থানীয় উদ্যোগে। তারপর সেটার ভার নিল সরকার। তারপর একসময় সেই মেলার আয়োজন বন্ধ হয়ে গেল। তারই প্রেক্ষাপটে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, সরকার এমন একটা জিনিস, তা যখন শত ফুল ফোটাতে চায়, তখন সব ফুল ঝরে যায়।

সংস্কৃতি হলো একটা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জীবনাচার। এটার একটা স্বতঃস্ফূর্ততা আছে। তা মাটি কেটে বানানো পুকুর বা লেক নয়, তা পাহাড় থেকে নেমে আপন গতিতে সমুদ্রের দিকে ধেয়ে চলা নদী। বাংলাদেশের মানুষ আবহমানকাল থেকেই নিজের মতো করে তার চর্চা করছে। আমাদের পালাগান, জারিগান, বাউলগান, মুর্শিদি, লোকগান, ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালির কোনো তুলনা নেই, ছিল না। লোকসংস্কৃতির পাশাপাশি ছিল আয়োজিত সংস্কৃতিচর্চা, পাড়ায় পাড়ায় ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন, পাঠাগার; ঘরে ঘরে ছিল হারমোনিয়াম। খেলাঘর, কচিকাঁচার মেলার মতো সংগঠনগুলো শিশু-কিশোরদের বিকাশে অবদান রাখত। জনপদে জনপদে নাটক মঞ্চস্থ হতো। শীত মানেই গ্রামগুলো মুখর ছিল যাত্রা, জারি-সারি-পালাগানের আসরে।

এরপর সবকিছু হয়ে যেতে লাগল ‘করপোরেটের ইভেন্ট’। নৌকাবাইচ পর্যন্ত। আগে আমরা স্কুলে ডিবেট বা বিতর্ক করতাম, ব্ল্যাকবোর্ডে ‘শহরের চেয়ে গ্রাম ভালো’ লিখে দুটো দল বানিয়ে বিতর্কে মাততাম, রুমভরা ছাত্ররা হাততালি দিত। একটা দল জয়ী হতো। একটা টাকাও খরচ হতো না। এখন একটা বিতর্কের আয়োজন করতেও লাখো টাকা খরচা করতে হয়।

করপোরেটের পর এখন সংস্কৃতির চর্চা হয়ে গেছে সরকারের ইভেন্ট। এমনকি ‘জয় বাংলা সাংস্কৃতিক জোট’ও যদি নিজস্ব উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অনুষ্ঠান, বিশেষ দিবস পালনের আয়োজন করত, তা–ও হতো। সরকারের বাইরের আওয়ামী লীগকেও তো এসব আয়োজনে দেখি না। এখন আয়োজক হয়ে গেছে বিজ্ঞাপনী সংস্থা। আর তার পেছনে থাকে সরকারের কতগুলো বিশেষ সংস্থা। ষাটের দশকে, এমনকি নব্বইয়ের দশকেও আর্ট কলেজের বড় বড় শিল্পী নিজের গরজে এসে মঞ্চসজ্জা করে দিতেন। আলতাফ মাহমুদের মতো শিল্পীরা এসে রিহার্সাল করাতেন, গান করতেন। এখন সবই করে দেবে সরকার, বড় বড় বাজেট বরাদ্দ হবে, ইভেন্ট-এজেন্সি মঞ্চ বানাবে, ক্রিপ্ট বানাবে, মহড়া করাবে, শো করবে। এর সঙ্গে জনগণের যোগটা যে কেটে গেছে, তা তো আমরা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মানুষের চিত্তস্রোত নদীর চেয়ে সামান্য জিনিস নহে। সেই চিত্তপ্রবাহ চিরকাল বাংলার ছায়াশীতল গ্রামগুলিকে অনাময় ও আনন্দিত করিয়া রাখিয়াছিল—এখন বাংলার সেই পল্লীক্রোড় হইতে বাঙালির চিত্তধারা বিক্ষিপ্ত হইয়া গেছে। তাই তাহার দেবালয় জীর্ণপ্রায়—সংস্কার করিয়া দিবার কেহ নাই, তাহার জলাশয়গুলি দূষিত—পঙ্কোদ্ধার করিবার কেহ নাই, সমৃদ্ধ ঘরের অট্টালিকাগুলি পরিত্যক্ত—সেখানে উৎসবের আনন্দধ্বনি উঠে না। কাজেই এখন জলদানের কর্তা সরকার বাহাদুর, স্বাস্থ্যদানের কর্তা সরকার বাহাদুর, বিদ্যাদানের ব্যবস্থার জন্যও সরকার বাহাদুরের দ্বারে গলবস্ত্র হইয়া ফিরিতে হয়। যে-গাছ আপনার ফুল আপনি ফুটাইত, সে আকাশ হইতে পুষ্পবৃষ্টির জন্য তাহার সমস্ত শীর্ণ শাখাপ্রশাখা উপরে তুলিয়া দরখাস্ত জারি করিতেছে। না হয় তাহার দরখাস্ত মঞ্জুর হইল, কিন্তু এই-সমস্ত আকাশকুসুম লইয়া তাহার সার্থকতা কী?’

আমাদের ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, জনপদে জনপদে সংস্কৃতিচর্চার সেই মুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে!

আর সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে স্বাধীনভাবে ক্ষমতাবলয়ের বাইরে এসে দাঁড়াতে হবে। সংস্কৃতি হলো ভাষাহীনের ভাষা, ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা। অসাম্প্রদায়িক, মুক্ত–স্বাধীন স্বপ্ন ও স্মৃতির বাংলাদেশ সংস্কৃতিজনকে চাইতে হবে নিজের মতো করে; ক্ষমতার কাছে ধরনা দেওয়া মানে আকাশকুসুম রচনা, রবীন্দ্রনাথ বলেই রেখেছেন, তাতে কোনো সার্থকতা নেই।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক