১৯৫০ আর ১৯৬০-এর দশকে আমাদের শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি যে বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরেছিলেন এবং নতুনভাবে রূপায়ণ করে তুলেছিলেন, তারই রাজনৈতিক পরিণতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ। পাকিস্তানের উপনিবেশপ্রায় শাসন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ঝেড়ে ফেলে এসে সেই বাঙালি সংস্কৃতির অবস্থা এখন কেমন? সম্প্রতি একজন বলেছেন, ‘বাঙালি সংস্কৃতির প্রসার তো ঘটেইনি, বরং মৃত্যু হয়েছে।’ আর কেউ নয়, কথাটা বলেছেন বর্তমানে ক্ষমতাসীন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারেরই একজন মন্ত্রী, আ ক ম মোজাম্মেল হক।
গত ৩১ মার্চ এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা এই মন্ত্রী আক্ষেপের কণ্ঠে আরও বলেছেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় অনেক গভীরে চলে গেছে।...গান–বাজনা, নাটক, যাত্রা—এগুলো কি আছে সমাজে? বাঙালির যে কৃষ্টি, ঐতিহ্য, লোকজ সাহিত্য-সংস্কৃতি, পুঁথি পড়া—এগুলো কোনো কিছুই নেই। এতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর জন্য পোয়াবারো হয়েছে। তাদের কাজ চলছে।’ কথাটা তিনি এমন একটা সময়ে বললেন, যার আগের দুটো বছরজুড়ে সাড়ম্বরে স্বাধীনতার অর্ধশতক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপিত হয়েছে। সে উদ্যাপনে কাঁড়ি কাঁড়ি সরকারি টাকা ঢেলে নানা সাংস্কৃতিক যজ্ঞের পরে তাহলে কী রইল আমাদের হাতে?
এ তো গেল একেবারেই হালফিলের কথা। সুড়ঙ্গপথে নানা ক্ষয়ে সংস্কৃতিক্ষেত্র যে গভীরভাবে জর্জরিত, তা নিয়ে আরও বছর কয়েক আগে, ২০১৭ সালে, একটি সাক্ষাৎকারে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আরও কিছু কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাদের যে সংস্কৃতিচর্চা, সেটা মূলত নগর ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক। বৃহত্তর সাধারণ মানুষের কাছে একে নিয়ে যেতে পারিনি।...ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা সেটা পেরেছে নানা রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।...লোকসংস্কৃতির সঙ্গে নগরসংস্কৃতির যে ব্যবধান, আমরা তার ফাঁদে পড়ে গেছি।’ (আলাপে ঝালাতে, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯) ঘটনাটা এক দিনে ঘটেনি, স্বাধীনতার পর থেকে বিরূপ আবহাওয়ায় ক্রমে গভীর হয়েছে, এই তাঁর অভিজ্ঞতা।
সংস্কৃতির এই গভীর সংকটের প্রশ্নে সংস্কৃতি অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় প্রথম সারির কয়েকজন মানুষকে নিয়ে প্রথম আলো একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। জ্যেষ্ঠদের সঙ্গে ছিলেন নবীনতররাও। সেখানে এই সংকটের লক্ষণ ও কারণ নিয়ে তাঁরা বিশদ করে বললেন।
স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চার একটি ভয়ের উৎস এখন রাষ্ট্র, আরেকটি উদ্ধত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। আর স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চার এক আপদ এখন সরকারি আনুকূল্যের মুখাপেক্ষিতা, অন্য আপদ করপোরেটের অর্থনির্ভরতা। এ থেকে মুক্তি কিসে? বক্তারা বলেছেন ঢাকায় বড়, প্রবল ও টানা সাংস্কৃতিক যজ্ঞের আয়োজন করা এবং সারা দেশে সেটাকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু মানুষ কি তার সঙ্গে যুক্ত হবে, যদি তাদের মনে বুদ্বুদের মতো উঠতে থাকা জিজ্ঞাসাগুলোর কোনো সাড়া সেসব অনুষ্ঠানে না পায়? এটাই বড় প্রশ্ন।
তাঁদের কথা সংক্ষিপ্ত সারমর্ম করে দুই কথায় বললে দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম: মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটা রাষ্ট্র পেয়েছি, কিন্তু যে রকমের রাষ্ট্র আমরা চেয়েছিলাম, স্বাধীনতার পর তা কায়েম করতে পারিনি; আবার সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে তার প্রত্যাশাও আমরা ধরে রাখতে পারিনি, বরং ক্রমাগত সেটা থেকে দূরে সরে গেছি। গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চর্চা, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তোলা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্য বিলোপের যে আকাঙ্ক্ষা দশকব্যাপী তুমুল গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সম্ভবপর করে তুলেছিল, বাংলাদেশ সেখান থেকে পিছু হটেছে। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতি হচ্ছে আপসের শিল্প। এ দেশে সে আপস প্রায় একচেটিয়াভাবে ঘটেছে প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাৎমুখী শক্তির সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের আগের দুটি দশকের মতো সংস্কৃতি সেখানে প্রগতিশীল ভূমিকা রাখতে পারেনি। অথচ সংস্কৃতির কাছেই তার প্রত্যাশা ছিল। কারণ, সংস্কৃতিচর্চার মূল চেতনা সাহসী প্রতিবাদে ও জনমুখিনতায়। ১৯৫০ আর ১৯৬০-এর দশকের সংস্কৃতিচর্চার সেখানেই জয়।
বেদনাদায়কভাবে আমাদের সরকারগুলোর রাজনীতিচর্চার মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা। এর জন্য তারা একদিকে প্রলোভন দেখিয়েছে; আরেক দিকে নানা নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করে, তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে, আমলাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে নানা বাধা তৈরি করে একটা আতঙ্কের আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে। আমাদের সংস্কৃতিচর্চা সেই আতঙ্কে বা প্রলোভনে মুখে কুলুপ এঁটেছে। সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে রাজনীতির ছা-পোষা কেরানি।
দাসত্ব ও মুক্তি একটি মানসিক অবস্থা, বলেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ক্ষমতার দাপটে মানুষ দাসত্বের অবস্থায় থাকতে পারে। সংস্কৃতিচর্চার কাজ সেখানে আরও বড়। মানুষের মনে মুক্তির স্বপ্ন জাগিয়ে তোলা এবং সেটিকে সপ্রাণ রাখা। সমাজে নতুন রাজনৈতিক শর্ত উদ্ভাসিত করে তোলার জন্য মানুষের মধ্যে যোগ ও ঐক্য গড়ে তোলা। ক্ষমতা ও জনতার দুই মেরুতে বিশ্ব বিভক্ত। সেখানে সংস্কৃতিচর্চার শক্তির উৎস ক্ষমতার কেরানিগিরিতে নয়, বরং জনতার কাতারে।
প্রথম আলোর আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, সেখানেই আমাদের সংস্কৃতিচর্চা নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ বিতর্কের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। সমাজকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন তল পর্যালোচনা করার মতো মুক্ত পরিস্থিতি বাংলাদেশে আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে তরুণেরা দেশকে যথার্থভাবে জানতে পারেননি। সংস্কৃতিচর্চার বৃহত্তর অংশই সরকারের পক্ষপুটে ঢুকেছে এবং সমাজে জেগে ওঠা সমস্ত প্রশ্নের জলাঞ্জলি দিয়েছে। এতে মোদ্দা ফল হয়েছে এই যে মানুষের কাছে সে তার আবেদন হারিয়েছে। আমাদের মূলধারার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মানুষ আর প্রাণের সাড়া পায় না।
আলোচনায় আরেকটি প্রশ্ন উঠেছে ধর্ম নিয়ে। বক্তাদের কয়েকজন বলেছেন, ধর্ম, বিশেষ করে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলামের সঙ্গে আমরা কোনো সংলাপ গড়ে তুলতে পারিনি। কার্পেটের তলায় রেখে দিয়ে বিষয়টিকে আমরা বিস্ফোরণোন্মুখ করে তুলেছি।
এ বিষয়ে আমরা চলেছি বিপজ্জনক দুটো উল্টো ধারায়। স্বাধীনতাযুদ্ধে নতুন রাষ্ট্রে আমাদের অঙ্গীকার ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার। সংবিধানে আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, নতুন রাষ্ট্রে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাখা হবে। বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রে এটা ছিল দারুণ এক প্রগতিশীল উত্তরণ। একই সঙ্গে এটাও উপলব্ধির প্রয়োজন ছিল যে ধর্ম সংস্কৃতির এক অবিভাজ্য উপাদান। সমাজের বড় অংশ যখন ইসলামে সমর্পিত, তখন সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে তার সঙ্গে কোনো সংলাপে আমরা যুক্ত হইনি।
এর একটি দিক যদি হয় ঐতিহাসিক, আরেকটি দিক তাহলে সমাজতাত্ত্বিক। দেশভাগের আগে উনিশ শতকের কলকাতায় উদ্ভূত ও বিকশিত যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা সন্দেহ করেছিল এবং পরিত্যাগ করে এসেছিল, তারাই আবার বায়ান্নর পর থেকে রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে দ্রুত তুলে নেয়। বাঙালি মুসলমানের দিক থেকে এ এক দারুণ উত্তরণ। তারা দুই পা এগিয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেই থিসিস রক্তমাখা বিজয় এনেছে। এই রাজনৈতিক বিজয়ের পরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সামাজিক উপলব্ধিকে এই জাতীয়তাবোধের মধ্যে আমরা সাংস্কৃতিকভাবে আত্মস্থ করার উদ্যোগ নিইনি। সেই উপেক্ষার নানা রন্ধ্রপথে সাম্প্রদায়িক শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার পেছনে ফেলে আমরা রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে প্রবলভাবে মিশিয়েছি। আবার সমাজ, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রশ্নে ধর্মকে উপেক্ষার পাত্র করেছি। যা হওয়ার কথা ছিল, আমরা গিয়েছি তার সম্পূর্ণ উল্টো পথে। ফ্রান্সে নির্বাসিত এই সময়ের বিশ্বনন্দিত সিরীয় কবি আদোনিস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ধর্মের প্রগতিশীল ব্যাখ্যা দেওয়া এখনকার একটি বড় দায়িত্ব, পশ্চাৎপন্থীদের হাতে একে ছেড়ে রাখা যায় না। সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র থেকে দূরে সরিয়ে রেখে ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্র আপস করতে থাকলে সাম্প্রদায়িক বিষ থেকে দেশকে উদ্ধার করা কঠিন।
স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চার একটি ভয়ের উৎস এখন রাষ্ট্র, আরেকটি উদ্ধত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। আর স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চার এক আপদ এখন সরকারি আনুকূল্যের মুখাপেক্ষিতা, অন্য আপদ করপোরেটের অর্থনির্ভরতা। এ থেকে মুক্তি কিসে? বক্তারা বলেছেন ঢাকায় বড়, প্রবল ও টানা সাংস্কৃতিক যজ্ঞের আয়োজন করা এবং সারা দেশে সেটাকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু মানুষ কি তার সঙ্গে যুক্ত হবে, যদি তাদের মনে বুদ্বুদের মতো উঠতে থাকা জিজ্ঞাসাগুলোর কোনো সাড়া সেসব অনুষ্ঠানে না পায়? এটাই বড় প্রশ্ন।
সবাই তরুণদের ওপর ভরসা রেখেছেন। তাঁরা এ সময়ের সন্তান, পিছুটানহীন এবং তাঁদের গরিষ্ঠ অংশ কোনো কুঠুরির মধ্যে ঢুকে পড়েননি। আমাদেরও ভরসা তাঁরাই। ভবিষ্যতের দেশ তাঁদেরই কল্পনায় ও হাতে। সাংস্কৃতিক জোয়ারে তাঁরা অংশ নিলেই না সেই পথে রাজনীতি দিশা পাবে, যেমন পেয়েছিল স্বাধীনতার আগের দশকগুলোয়।
সাজ্জাদ শরিফ প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কবি