মানুষ কষ্টে আছে। বানের জলে ভেসে গেছে লাখ লাখ মানুষের সম্পদ ও স্বপ্ন। এ দৃশ্য নতুন নয়। আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই দেখা যায়, সবকিছু ছাপিয়ে জন-আলোচনার চূড়ায় উঠে এসেছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়, যে সংবিধান এ দেশের অধিকাংশ মানুষ চোখেও দেখেনি।
দেশটা চালান ‘আলোকপ্রাপ্ত’ হোয়াইট কলার শহুরে মধ্যবিত্তরা। তাঁদের চিন্তা ও কাজে যা অগ্রাধিকার পাবে, তা-ই সংবাদ শিরোনাম হবে এবং এ নিয়ে চায়ের পেয়ালায় তুফান উঠবে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় তেমনি একটি বিষয়। এ রায় নিয়ে সমাজের ‘অগ্রসরমাণ’ অংশে তুলকালাম হচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির ঝগড়াটা যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বেশ কিছু মতামত আছে, যা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক এবং চলছে কুতর্ক। এগুলোর একটি হচ্ছে জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কিছু মন্তব্য। বলা হয়েছে, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র নাকি অপরিপক্ব—এ-জাতীয় কিছু কথা।
জাতীয় সংসদের কার্যকারিতা নিয়ে কথাবার্তা ও হইচই নতুন কিছু নয়। ১৯৯১ সালে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকেই এ নিয়ে প্রশ্ন ও সমালোচনা আছে। এই বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন রাজনীতিবিদেরাই, যাঁরা বিভিন্ন সময় সংসদের চত্বর আলোকিত করে রেখেছিলেন এবং এখনো আলো ছড়াচ্ছেন।
আমরা জাতি হিসেবে ইতিহাসমনস্ক নই, এমন একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। দূর অতীত আমরা ভুলে যেতে অভ্যস্ত এবং নিকট অতীত নিয়ে খোঁচাখুঁচি করেই আনন্দ পাই। রাজনীতির ইতিহাসের আদি-অন্ত ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে আমি জাতীয় সংসদে মাননীয় সদস্যদের নানা সময়ের ভূমিকা ও মন্তব্য পর্যালোচনা করে দেখলাম, সংসদকে জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁরা অনেকেই ফুটবল-ময়দানে স্ট্রাইকারের ভূমিকায় নেমেছিলেন। তাঁদের সব কথাবার্তা যে রেকর্ডে থেকে যায় এবং পরে নানান অছিলায় তাঁরা পল্টি খেলেও মানুষ যে তাঁদের অতীত বিস্মৃত হয় না, এটা অনেকেই হয়তো বুঝতে চান না।
আমরা অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালুর ইতিহাস আলোচনার সময় মাগুরার উপনির্বাচনের উদাহরণ টেনে আনি। কিন্তু সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছিল তারও আগে, ১৯৯৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরের একটি আসনে উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ ‘ভোট কারচুপি’ ঠেকানোর জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দাবি করেছিল। ২৮ নভেম্বর ১৯৯৩ জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদক ও দেশি-বিদেশি সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে।’ ৭৫-পরবর্তী অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে কোনো সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জনমতের প্রতিফলন ঘটায় না। শাসক দল স্বীয় স্বার্থে প্রশাসনকে অন্যায় ও অবৈধভাবে ব্যবহার করে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করে। ‘...আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেও কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই নির্বাচন করবে।’
১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরার উপনির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগের অব্যাহত দাবির জবাবে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বললেন, ‘একমাত্র শিশু ও পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়।’ ১৭ জুন ১৯৯৪ জাতীয় সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা হয়। বিএনপির সরকারের তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদা জাতীয়তাবাদীদের তুঙ্গে। তিনি মন্তব্য করলেন, ‘রাজাকার, হাইজ্যাকার ও স্বৈরাচারের আজকের আঁতাত কোনো নতুন ঘটনা নয়।...বিএনপি যখন আজ ক্ষমতায়, তখন “তিন শয়তান” আবার এক হয়ে ষড়যন্ত্র করছে।’
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে ‘জয়ী’ হয়ে বিএনপির সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আইন পাস করল। নির্বাচনের গন্ধ নাকে যেতে না যেতেই শুরু হলো দলবদলের হিড়িক। কেননা, হাওয়া তখন অনেকটাই ঘুরে গেছে বলে মনে হয়েছিল। জেনারেল এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি নূরুল ইসলাম এবং জিয়া সরকারের তথ্যমন্ত্রী ও পরে এরশাদ আমলের ১৯৮৮ সালের সংসদের স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে জামায়াতে ইসলামী সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দিন খানের নাম প্রস্তাব করেছিল। বিএনপিতে ঢুকতে না পেরে তিনি সটান আওয়ামী লীগে চলে যান। নির্বাচনে মনোনয়ন না-ও পেতে পারেন, এই আশঙ্কায় আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দিন আহমেদ এবং ছাত্রলীগের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব যোগ দেন বিএনপিতে। বোঝা গেল, সদস্য কেনাবেচা সংসদের ভেতরে যেমন হয়, বাইরেও হয়।
বাজারে একটা কথা চালু আছে, বিএনপি ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করে, আর আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দুই দলের ধর্মতত্ত্ব একাকার হয়ে গেল। দু-এক দিন আগে-পরে দুই দলের দুই নেত্রী সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরানের (রহ.) মাজার জিয়ারত করে নির্বাচনী প্রচার শুরু করলেন।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ তৈরি করল ‘ঐকমত্যের সরকার’। দলের বাইরে থেকে জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং জাসদের আ স ম আবদুর রবকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হলো। সরকার গঠনের আগে এরশাদকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রশি-টানাটানি হয়েছিল। পাঁচ বছর জেল খেটে এরশাদ তখন খালেদা জিয়ার ওপর খুবই ক্ষুব্ধ। তাঁকে ইঙ্গিত করে এরশাদ বলেছিলেন, ‘এই মহিলাকে কোনো সমর্থন দেওয়ার আগে আমার যেন কুষ্ঠ হয়।’
১৪ জুলাই (১৯৯৬) সংসদের প্রথম অধিবেশনে আ স ম রব বিরোধী দলের সদস্যদের দিকে বুড়ো আঙুল তুলে কিছু মন্তব্য করলে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এই ‘অভদ্র’ আচরণের প্রতিবাদ জানানো হয়। তাঁরা রবকে মাফ চাইতে বলেন। স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ‘বুড়ো আঙুল’ বিষয়টি প্রিভিলেজ কমিটিতে পাঠিয়ে দেন। ৫ আগস্ট বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া সরকারি দলের সদস্যদের উদ্দেশ করে একপর্যায়ে ‘বেয়াদব’ শব্দটি উচ্চারণ করেন। এতে ভীষণ প্রতিক্রিয়া হয়। স্পিকার বলেন, সংসদকক্ষ ঝগড়া করার জায়গা নয়, বেগম জিয়ার মুখে ‘বেয়াদব’ শব্দটি অনাকাঙ্ক্ষিত।
২৫ আগস্ট (১৯৯৬) সংসদ অধিবেশন চলাকালে আওয়ামী লীগের আবুল কালাম আজাদ মাইক্রোফোনে কারও নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘আমাকে একজন দুই নম্বরি (অসৎ) লোকের পর বলতে দেওয়া হলো, যিনি এর আগে জিয়া ও এরশাদের জুতা চেটেছেন, এখন তিনি খালেদা জিয়ার জুতা চাটছেন। একসময় তিনি মুজিব কোট পরে ঘুরে বেড়াতেন।’ বিএনপির সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়ে স্পিকারকে এসব কথা ‘এক্সপাঞ্জ’ করতে অনুরোধ করেন। স্পিকার তাতে রাজি হননি।
১৯৯৮ সালের ১৫ এপ্রিল সংসদ অধিবেশন চলাকালে চরম গন্ডগোল হয়। কথা বলার সুযোগ না পেয়ে একপর্যায়ে বিএনপির কয়েকজন সদস্য স্পিকারের দিকে ছুটে যান। তাঁরা ফাইল ছুড়ে মারেন, একটা টিভি ক্যামেরা ভেঙে ফেলেন এবং সংসদের রিপোর্টিং ডেস্ক তছনছ করে দেন। ঘটনাটি ছিল বহুল আলোচিত। একটি জাতীয় দৈনিকে এমন খবরও ছাপা হয়েছিল যে বিরোধী দলের একজন সদস্য জুতা ছুড়ে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন। টেলিভিশনে দেখা গেছে, তৎকালীন বিরোধীদলীয় উপনেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরী স্বয়ং এতে নেতৃত্ব দেন। স্পিকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সার্জেন্ট-অ্যাট-আর্মসকে তৈরি থাকতে বলেন। ১০ মিনিট ধরে এই অরাজক অবস্থা চলছিল।
১৯৯৯ সালের ৯ নভেম্বর সংসদের অধিবেশনে সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু মন্তব্য করেন। বিরোধী দলের ডাকা হরতালের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘হরতালের ফলে ছাত্রদের ক্ষতি হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতা নিজে লেখাপড়া করেননি, জাতি শিক্ষিত হোক, তা তিনি চান না। নিজে পরীক্ষায় ফেল করেছেন বলে অন্যদের পরীক্ষায় বসতে দিতে চান না। রাজনীতির সম্মানটা তিনি কোথায় টেনে নামিয়েছেন?’
১৯৯০-পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ আমলে সংসদ কখনোই পুরোপুরি কার্যকর ছিল না। ঝগড়া আর গালাগালের পাশাপাশি চলছিল লাগাতার সংসদ বর্জন। পঞ্চম সংসদে (১৯৯১-৯৬), সংসদ অধিবেশন বসেছিল ২৯৫ দিন। সংসদনেতা খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন ২৫৬ দিন, বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন ১১৯ দিন। সপ্তম সংসদে (১৯৯৬-২০০১) সংসদ বসেছিল ৩৮৩ দিন। সংসদনেতা শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া হাজির হয়েছিলেন যথাক্রমে ২৯৮ ও ২৮ দিন। জাতীয় সংসদের আইন অনুযায়ী একাধারে ৯০ কার্যদিবস সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকলে সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাওয়ার বিধান থাকলেও অনেক সাংসদ ৯০ দিন পার হওয়ার দু-এক দিন আগে কয়েক মিনিটের জন্য সংসদ অধিবেশনে হাজির হয়ে তাঁদের সদস্যপদ টিকিয়ে রাখতেন।
অষ্টম জাতীয় সংসদ গোড়া থেকেই ছিল অকার্যকর। এমন ভয়ংকর এক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল যে যার পথ ধরে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিল এবং তা তাৎক্ষণিকভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছিল। নবম সংসদেই ‘একদলীয় গণতন্ত্রের’ বীজটি বপন করা হয়েছিল, যা দশম সংসদে ডালপালা মেলে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা কেন জাতীয় সংসদ, রাজনীতি ও নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে ‘আগবাড়িয়ে’ কথা বলতে গেলেন। সংসদীয় ব্যবস্থার সর্বনাশ করতেসাংসদেরা এবং রাজনৈতিক দলগুলোই কি যথেষ্ট নয়?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।