জাতীয় শিক্ষানীতি

সংশোধনের আগে মূল্যায়ন হোক

করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে, পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ভবিষ্যৎ কী, অনলাইন ক্লাসের ভালো–মন্দ—এসবের মধ্যে গত মঙ্গল ও বুধবার প্রকাশিত দুটি খবর থেকে জানা গেল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং জাতীয় শিক্ষানীতি সংশোধন হবে। শিক্ষানীতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণীত হয়েছিল ২০১০ সালে। এখন এগুলো সংশোধন করার আগে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, গত এক দশকে জাতীয় শিক্ষানীতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন কতটা কার্যকর হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের পুরোটা সময়ে এক সরকার শিক্ষানীতি করেছে তো আরেক সরকার বাতিল করেছে। ফলে কোনো শিক্ষানীতিই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময়ে যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, সেই সরকারই এখন ক্ষমতায় আছে। শিক্ষানীতিটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্যও ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন সেই অর্থে হয়নি। গত বুধবার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, সময়ের সঙ্গে ‘অনেক বিষয় পরিবর্তন হওয়ায়’ শিক্ষানীতি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১০ বছর দীর্ঘ সময়। তাই সময় এসেছে শিক্ষানীতি সংশোধন, পরিমার্জন ও সংযোজন করার।

প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৮ সদস্যের কমিটি এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। এরপর ২০১১ সালের জুনে ওই সময়কার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে আহ্বায়ক করে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কেন্দ্রীয় কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটির অধীনে বেশ কয়েকটি উপকমিটি করা হয়েছিল, সেগুলো এখন অকার্যকর। আর শিক্ষানীতি কার্যত ফাইলবন্দী।

কী ছিল ওই শিক্ষানীতিতে? কথা ছিল, ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং ২০১৮ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়িত হবে। ২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত থাকবে ১:৩০। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তর এবং মাধ্যমিক পরীক্ষা দ্বাদশ শ্রেণির পর হওয়ার কথা ছিল। মাধ্যমিকে তিন ধারা—সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে অভিন্ন পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক; মাধ্যমিকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চতর গণিত থাকবে বাধ্যতামূলক। মাধ্যমিক পর্যায়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে কয়েক ধরনের জনশক্তি গড়ে তোলার সুপারিশও ছিল।

মাদ্রাসা অংশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়েছে। তা না করে দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমান দেওয়া হয়েছে; এটা জাতীয় শিক্ষানীতিতে ছিল না। স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ধারণের জন্য অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন, মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান নির্ধারণের জন্য প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয় স্থাপনসহ শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল।

উচ্চশিক্ষা স্তরে অভিভাবকের আয়ের ভিত্তিতে বেতন নির্ধারণ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকেন্দ্রীকরণের কথা ছিল। বলা হয়েছিল, চার বছরের স্নাতক সম্মানকে সমাপনী ডিগ্রি হিসেবে ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকতা ও গবেষণা ছাড়া সব কর্মক্ষেত্রে যোগদানের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমন আরও অনেক উদাহরণ থেকে পরিষ্কার যে শিক্ষানীতি সেই অর্থে বাস্তবায়ন হয়নি। আবার শিক্ষানীতিতে নেই, অথচ পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি শেষে দুটি সমাপনী পরীক্ষা এখন নেওয়া হচ্ছে। এ দুই পরীক্ষার যৌক্তিকতা নিয়ে কয়েক বছর ধরে সমালোচনা হচ্ছে।

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষানীতি প্রণয়নের এক দশকেও একটি শিক্ষা আইন করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। কেবলই খসড়া হয়, আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে স্তিমিত হয়ে যায়। এভাবে সাত-আট বছর পার হয়ে গেল। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে অনেক বিষয় থাকলেও বারবার সামনে চলে আসে কোচিং সেন্টার ও নোট-গাইড বা প্র্যাকটিস বুক বন্ধ করা এবং ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেন প্রসঙ্গ। চাপ সৃষ্টিকারী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আওয়াজ তোলেন, যুক্তিতর্ক নিয়ে হাজির হন এবং এরই ফাঁকে ফাঁকে টাকা ওড়ার গল্প ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষা আইন লালফিতায় বন্দী হয়। মাস কয়েক পর আবারও ফাইল থেকে উঁকি মারতে চাইলে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়।

শিক্ষানীতি ছাড়াই চলছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছে, পরীক্ষা দিচ্ছে, ফল প্রকাশ হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়ার অনেকটাই চলে গেছে কোচিং সেন্টারে, নোট বই-গাইড বইয়ে। নিবন্ধন ছাড়াই ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন ও কওমি মাদ্রাসা চলছে। প্রশাসনিক আদেশ-নির্দেশ, অস্থায়ী ভিত্তিতে শিক্ষার নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। এভাবে কারও খেয়ালখুশিমতো শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে না। এ জন্য যুগোপযোগী জাতীয় শিক্ষানীতি প্রয়োজন ছিল, যেখানে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা থাকবে। শিক্ষার সিঁড়ি বেয়ে সন্তানকে আমরা কোথায় নিতে চাই—সেই রূপরেখা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষানীতি জরুরি।

এদিকে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২০১০ সালের আইনটি সংশোধন করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করেছে। এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে ওই কমিটিকে। ২০১৬ সাল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করে ট্রাস্টি বোর্ডে সরকারের প্রতিনিধি রাখা এবং টিউশন ফি নির্ধারণ করে দেওয়ার উদ্যোগ চলছে। এসব লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির নেতৃত্বে একটি উপকমিটি এবং ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি কাজ শুরু করেছিল। প্রায় চার বছর পর আবারও শোনা গেল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন হবে।

২০১০ সালে আইন হওয়ার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ২০১২ থেকে অন্তত ছয়বার এই সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাত বছরের বেশি বয়সী মাত্র ২১-২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসে গেছে। অথচ সাত বছরের বেশি বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অর্ধশতাধিক।

প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের অন্তত ১০৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কটি আইন মেনে চলছে? এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় চলার মতো বাস্তবতা আছে কি না? আইনটি প্রয়োগ করার ক্ষমতা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির আছে কি না? ইউজিসিকে শক্তিশালী করা দরকার বলা হলেও গত দেড় দশকে তা কেন করা হয়নি?

এসব প্রশ্নের সমাধান না করে আইন প্রণয়ন ও তা সংশোধন করে লাভ কতটুকু সেই প্রশ্ন থেকে যায়। একই প্রসঙ্গ এসে যায় জাতীয় শিক্ষানীতির ক্ষেত্রেও। আগে পর্যালোচনা হোক—শিক্ষানীতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন কতটা কার্যকর হয়েছে, কতটা হয়নি; কেন হয়নি এবং না হওয়ার দায় কার।


শরিফুজ্জামান সাংবাদিক

pintu.dhaka@gmail.com