রাজনীতি

সংবিধান একটি অমীমাংসিত গদ্য

অনেক দিন আগে বন্ধুস্থানীয় এক চিত্রশিল্পীকে মুখ ফসকে বলেছিলাম, ‘আচ্ছা, আপনাদের এসব অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট বা বিমূর্ত ছবির মাথামুণ্ডু তো কিছুই বুঝি না।’ হাস্যরস করে এও বলেছিলাম, ‘শিল্পীর ব্রাশ ঝাড়া দিলে কাগজের ওপর যে রঙের ফোঁটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে কিংবা রঙের বাটিতে ডুবে যাওয়ার পর তেলাপোকা হেঁটে গেলে কাগজে যে ছাপ পড়ে, তাকেও নাকি বিমূর্ত ছবি হিসেবে গণ্য করা হয়?’

শিল্পীবন্ধু আমার কথায় রাগ করেননি। তবে একটি মন্তব্য করেছিলেন, যা আমি সারাজীবন মনে রাখব। বিনয়ের সঙ্গেই তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো আঁকা শিখেছি পদ্ধতিগতভাবে ছয় বছর। তারপরও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। আপনি এক দিনও আর্টের ক্লাস না করে, এ সম্পর্কে কোনো বই না পড়ে, একটি ছবি দেখে এক মুহূর্তেই সবকিছু বুঝে নিতে চান?’

আমি লজ্জা পেয়েছিলাম।

একদিন এক আড্ডায় এক বন্ধু আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা, ইনফ্লেশন জিনিসটা একটু বুঝিয়ে দিন তো?’ আমি দু-এক কথা বলার পর তিনি উল্টাপাল্টা প্রশ্ন জুড়ে দিলেন—এটা কেন হবে, ওটা কেন হবে, ইত্যাদি। শেষমেশ বললাম, আমি এসব বিষয় কিছুটা বুঝেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় বছর পড়াশোনা করে। তারপরও পুরোপুরি বুঝেছি, এমন দাবি করব না। কেননা, প্রতিদিনই একটু একটু করে দুনিয়া পাল্টে যাচ্ছে, যার পূর্বাভাস আমাদের টেক্সট বইয়ে সব সময় থাকে না। এক বেলার আড্ডায় আমি কী করে বিষয়টা আপনাকে বোঝাই? টিচ ইয়োরসেল্‌ফ ইকোনমিকস-জাতীয় বইটই পড়ে আসুন। তখন আলাপ করতে সুবিধে হবে।

এ কথাগুলো বললাম এ জন্য যে আমরা অনেক সময় চটজলদি সবকিছু বুঝতে চাই। স্কুলে আমরা ছয় বছর পাটিগণিত পড়ে তারপর বীজগণিত শুরু করেছিলাম। নতুন কোনো কিছু শেখার জন্যও কিছু শেখা দরকার, দরকার একটা প্রস্তুতিপর্বের।

তারপরও বলতে হয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিগ্রি থাকলেই তিনি রাজনীতি ভালো বুঝবেন বা সফল রাজনীতিবিদ হবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি কথা মনে পড়ল। সেটা ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি। রমনার বটমূলে মঞ্চ বানিয়ে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান চলছে। প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু। অতিথি আলোচকদের একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে অধ্যাপক চৌধুরীকে ইঙ্গিত করে একটু কৌতুকের সুরেই বলেছিলেন, ‘আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট, আমি মাঠের ডক্টরেট।’

শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে বা গ্রন্থাগারে হয়নি। হয়েছিল মাঠে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে, তাঁর ভাষায় ‘চোঙা ফুঁকে’। এবং এক দিনে নয়, বছরের পর বছর লেগে থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মধ্য দিয়ে। শুধু গলাবাজি করে নয়, অনেক বছর কারা নির্যাতন ভোগ করে তিনি একধরনের উপলব্ধি ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিলেন। যাঁরা টাকা দিয়ে টিকিট কিনে পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছেন কিংবা বিনা ভোটে সংসদ ভবনে ঢুকেছেন, তাঁদের পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব নয়।

তবে কবিতার ব্যাপারটি বোধ হয় আলাদা। কবিতা বোঝার জন্য কবিতার ক্লাস করার দরকার হয় বলে শুনিনি। মোটামুটি ভাষাজ্ঞান থাকলেই কবিতার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। অর্থ নিয়ে ধুন্ধুমার করার দরকার কী? এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি বেশ পছন্দ। ‘কিছু একটা বুঝাইবার জন্য কেহ তো কবিতা লেখে না। হৃদয়ের অনুভূতি কবিতার ভিতর দিয়া আকার ধারণ করিতে চেষ্টা করে। এই জন্য কবিতা শুনিয়া কেহ যখন বলে বুঝিলাম না, তখন বেশ মুশকিলে পড়িতে হয়।’ রবীন্দ্রনাথের কথা শুনে মনে হয়, কবিতা পড়ার মন, শোনার কান এবং বোঝার মেজাজও তৈরি করার বিষয়। তবে প্রকাশভঙ্গির কারণে কোনো কবিতা সহজে বোঝা যায়, কোনোটা বোঝা যায় না বা বুঝতে কষ্ট হয়। সব কবি ভালো কমিউনিকেটর নন। সব কবিতা পাঠকের মনের গহিনে ঢুকতে পারে না। যিনি পারেন, তিনিই সার্থক কবি।

প্রশ্ন হলো, কবিতা কী? শামসুর রাহমান একবার বলেছিলেন, মূল থেকে অনুবাদে যা হারিয়ে যায়, তা-ই কবিতা। বিষয়টা অবশ্য একেকজন একেকভাবে দেখেন। কবি নির্মলেন্দু গ্‌ুণ লিখেছেন, কবিতা অমীমাংসিত রমণী। বইয়ের এ রকম শিরোনামে পুরুষতান্ত্রিকতার গন্ধ থাকতে পারে। অমীমাংসিত রমণীর কথা ভাবলে আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে নানা রকম ত্রিভুজ প্রেমের উপাখ্যান। অমীমাংসিত রমণীর একটি বড় উদাহরণ হলো শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ উপন্যাসের ‘অচলা’ চরিত্রটি। শরৎচন্দ্র একজন সার্থক ‘মনের কারবারি’। এই বইয়ে তিনি একজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মীমাংসা রেখে গেছেন। দৈনন্দিন জীবনে যে জিনিসটা আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে, তা হলো রাজনীতি। আপনি রাজনীতি করুন আর না-ই করুন, রাজনীতি আপনাকে ছাড়বে না। রাজনীতিবিদদের নেওয়া সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে আপনার-আমার জীবনযাপন, আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।

আমাদের দেশে যে রাজনীতি চলে আসছে, তার অনেক কিছুই অমীমাংসিত। সে জন্য আমরা পদে পদে হোঁচট খাই, পথ খুঁজে পাই না। একসময় মনে হতো, অনেক কিছুরই মীমাংসা হয়ে গেছে, ইতিহাসের জাদুঘরে চলে গেছে। এখন আর এ রকম মনে হয় না। যা একসময় মনে হতো মীমাংসিত, তা আবার নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমরা যেন কয়েকটা বিষয় নিয়েই দশকের পর দশক ঘুরপাক খাচ্ছি। বেরোনোর পথ পাচ্ছি না। বিষয়টা হলো আমাদের সংবিধান।

সংবিধানে অনেক কাটাছেঁড়া হয়েছে, মোট ১৬ বার। এর মধ্যে ১৪ বার হয়েছে ‘নির্বাচিত’ সরকারের হাতে, দুবার সামরিক আইনের ছাতার তলায়, যদিও ‘নির্বাচিত’ সদস্যরাই ওই কাজটি করেছেন। এসবের মধ্যে একাধিক সংশোধনী সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়ে যায়। অষ্টম সংশোধনী বাতিল হয় ১৯৮৮ সালে, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হয় ২০১১ সালে; আর ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়েছে কয়েক দিন আগে। সাম্প্রতিকতম সংশোধনী ও তার বাতিলকরণ নিয়ে উচ্চ আদালত ও জাতীয় সংসদ মুখোমুখি অবস্থানে গেছে এবং এ নিয়ে রাজনৈতিক বিভক্তি বেশ স্পষ্ট। বলা চলে, সংবিধান আবারও অমীমাংসিত থেকে গেল। আবদুল মান্নান সৈয়দের কাব্যগ্রন্থের শিরোনামের আদলে বলা যায়, সংবিধান একটি অমীমাংসিত গদ্য।

পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম সংবিধান পেতে সময় লেগেছিল নয় বছর। সেটা অবশ্য কার্যকর ছিল মাত্র দুই বছর। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা ন্যূনতম সময়ের মধ্যে একটা সংবিধান পেয়েছিলাম। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সংবিধান বিল গৃহীত হয়েছিল ৪ নভেম্বর। সংবিধান অবশ্য কার্যকর হয়েছিল ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে। ১৬ বার সংবিধান কাটাকুটির পর এখন প্রশ্ন উঠেছে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার। এটা কি সম্ভব? এটা কি বাস্তবানুগ? এই প্রশ্নগুলোও ঘুরেফিরে আসছে।

১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর ফলে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন করা সম্ভব হয়েছে। ওই বছর ২২ সেপ্টেম্বর গৃহীত দ্বিতীয় সংশোধনীতে জরুরি অবস্থা জারির বিধান রাখা হয়। চুয়াত্তরের ২৮ নভেম্বর তৃতীয় সংশোধনীর পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে আমরা ছিটমহল সমস্যার মীমাংসা করতে পেরেছি। পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারব্যবস্থা আমূল বদলে ফেলে সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। এই চারটি সংশোধনী হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে, তাঁর উদ্যোগে।

বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য আবেগের কথা ভেবে আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সংবিধানই মূল সংবিধান এবং স্বাধীনতার চেতনা সমুন্নত রাখতে হলে ওখানেই ফিরে যেতে হবে। এ কথার মাধ্যমে তাঁরা কি সংবিধানের দ্বিতীয়, তৃতীয়—এসব সংশোধনীও ছেঁটে ফেলতে চাইছেন? চতুর্থ সংশোধনীর কথা অবশ্য তাঁরা মুখ ফুটে আর বলেন না। তাঁরা এটা ভালো করেই জানেন, অবিকৃত অবস্থায় বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার আর উপায় নেই।

সংবিধান একটি পবিত্র দলিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। একটি শিশুর কাছে অ-আ-ক-খ-এর একটি বইও পবিত্র। প্রয়োজনে পবিত্র জিনিসও সাফসুতরো করতে হয়, পরিমার্জনের দরকার পড়ে। আমাদের শিশুরা এখন আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাল্যশিক্ষা পড়ে না। ভাষা আর ব্যাকরণেও অনেক সংস্কার হয়েছে। মানুষের জন্যই সংবিধান, সংবিধানের জন্য মানুষ না। আর সংবিধান কীভাবে সংশোধন করতে হয়, তার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সংবিধানেই লেখা আছে। আমার অনুমান, সংবিধান এমনই একটি প্রয়োজনীয় দলিল, যা সবচেয়ে কমসংখ্যক লোকে পড়েন এবং খুব কম মানুষের সংগ্রহে এর কপি আছে।

অতীতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে সংবিধান কাটাছেঁড়া হয়েছে বারবার। এখনো হচ্ছে। যার যার সুবিধামতো সংবিধানের দোহাই দিই আমরা। এ নিয়ে তর্ক আর ঝগড়া চলছে তো চলছেই। এসবের আশু মীমাংসা হওয়া দরকার। সবার ওপরে এ দেশের মানুষ, নাগরিক, তারপরে হলো জাতীয় সংসদ কিংবা বিচারালয়।

আইন বিভাগ আর বিচার বিভাগের মধ্যে এখন যে মতান্তর চলছে, তাকে অহংয়ের বা ইগোর লড়াই বলার সাহস নেই আমার। কারণ, তাঁরা সবাই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। একটা কথা সবার জানা থাকা দরকার, দেশের মালিক জনগণ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণই প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। সবার আগে দেশের মানুষ, তারপর অন্য সব।

তাহলে সমস্যা কোথায়? রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে আবারও বলতে হয়:

‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি,

মূর্ত্তি ভাবে আমি দেব,—হাসে অন্তর্যামী।’

গণদেবতার কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।

মহিউদ্দিনআহমদ: লেখক ও গবেষক