দুই দু’গুণে পাঁচ

সংবাদপত্র-সমাচার

গল্প আছে, একটি সংবাদপত্রের একজন তরুণ রিপোর্টার হঠাৎ দেখতে পেলেন, একটি সড়ক দুর্ঘটনার পর কৌতূহলী জনতা চারপাশ থেকে ভিড় করে আছে। সংবাদপত্রের পরিভাষায় যেটাকে বলে ‘স্কুপ’, সেটা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় ব্যগ্র হয়ে তিনি ‘আমাকে যেতে দিন, আমাকে দেখতে দিন, যিনি মারা গেছেন আমি তঁার পুত্র’ বলে এগোতে থাকলে জনতা তাঁর জন্য সরে দাঁড়াল। তিনি কাছে গিয়ে দেখেন, সড়কের মাঝখানে যানবাহনের সামনে একটি গাধা মরে পড়ে আছে। গল্পটি আমাদের মনে ঈষৎ হাসির খোরাক জোগালেও তরুণটির কর্তব্যনিষ্ঠা ও সর্বাগ্রে সংবাদ সংগ্রহের প্রবল ইচ্ছা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

বলা হয়ে থাকে, চিকিৎসকেরা তাঁদের ভুলকে কবর দিয়ে দেন, আইনজীবীরা ফাঁসিতে লটকান; আর সাংবাদিকেরা তাঁদের ভুলকে প্রথম পৃষ্ঠায় পত্রস্থ করেন। আর সংবাদপত্রের সম্মানিত সম্পাদকদের ব্যাপারেও আদলাই স্টিভেনসন একটি মজার কথা বলেছেন। একজন সম্পাদক হচ্ছেন তিনি, যিনি গমকে তুষ থেকে আলাদা করেন, অতঃপর তুষটাকে ছাপান।

সে যাহোক। প্রায় হাজার বছর আগে আবির্ভাবের পর থেকে সংবাদপত্র সভ্য জগতের এতটাই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে যে একবার নাকি বিলেতের কিছু লোককে ‘হেল’ তথা নরক কী জিনিস বোঝানো যাচ্ছিল না। অবশেষে সেখানে সংবাদপত্র থাকবে না বলতেই ওরা সহজে বুঝে নিল। রেডিও-টিভি আর কম্পিউটারের দৌরাত্ম্যে বর্তমানে সংবাদপত্রের কর্তৃত্ব কিছুটা কমলেও নিঃশেষিত হয়ে যায়নি এবং যাবেও না কোনো দিন। কেননা, রেডিও-টিভিতে সংবাদ শুনলেও মানুষ সংবাদপত্রের পাতায় বিস্তারিত ও ছবিসহ সেটা পাঠ করতে চায়। আর্থার মিলার তাই যথার্থই বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, একটি ভালো সংবাদপত্র হচ্ছে নিজের সঙ্গে কথাবার্তায় রত একটি জাতি (a nation talking to itself)।’

অবশ্য আজকাল বাঁচার তাগিদে সংবাদপত্রের প্রায় অর্ধেকটাই জুড়ে থাকে বিজ্ঞাপন। আর এ প্রসঙ্গে হাস্য-সম্রাট মার্ক টোয়েনের একটা মজার উপাখ্যান আছে। মার্ক টোয়েন একসময় একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তো একবার একজন ব্যবসায়ী গ্রাহক তাঁকে চিঠি লিখে পাঠালেন, ‘আমার পত্রিকার ভাঁজের মধ্যে একটি মরা মাকড়সা পেয়েছি। এটা কি শুভ লক্ষণ, নাকি অশুভ লক্ষণ?’

মার্ক টোয়েন তড়িঘড়ি উত্তর লিখে দিলেন, ‘প্রিয় মহোদয়, এটা শুভ-অশুভ কোনো লক্ষণই নয়। আসলে মাকড়সাটি মৃত্যুর পূর্বে আমাদের পত্রিকাটিকে পর্যবেক্ষণ করে দেখছিল কোন সওদাগর আমাদের পত্রিকায় তঁার সওদার বিজ্ঞাপন দেননি, যাতে করে সে ওই সওদাগরের গুদামে গিয়ে দরজায় জাল বুনে শান্তিতে ও নিরুপদ্রবে সেখানে বাস করতে পারে।’ বলাই বাহুল্য, অতঃপর ওই গ্রাহক লজ্জা–শরমের খাতিরে মার্ক টোয়েনের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে মজবুর হয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত, তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন নাকি একদা পরিহাসছলে বলেছিলেন, ‘সংবাদপত্রের সবচেয়ে সত্যনিষ্ঠ অংশ হচ্ছে বিজ্ঞাপন’। আর টেক্সাসের এক স্থানীয় সংবাদপত্র প্রচারসংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে লিখেছিল, ‘জনগণের কী করা উচিত জানতে আপনার ধর্মগ্রন্থ পড়ুন, আর জনগণ প্রকৃতপক্ষে কী করছে সেটা জানতে এই পত্রিকা পাঠ করুন।’

প্রচারসংখ্যা বাড়ানোর কথা বলতেই মনে পড়ে গেল, সংবাদপত্রের একটিমাত্র সংস্করণ কী পরিমাণ বৃহদাকার হতে পারে সেটার প্রমাণ হলো মার্কিন মুলুকের দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-১৯৭১ তথা আমাদের স্বাধীনতার বছরে ১০ অক্টোবর তারিখে এই পত্রিকাটিতে ছিল ১৫টি বিভাগ, ৯৭২টি পাতা, ১০ কোটি ২০ লাখ লাইন বিজ্ঞাপন আর পত্রিকাটির ওজন ছিল ৩.৫ কিলোগ্রাম ও দাম ৫০ সেন্ট। বর্তমানে পত্রিকাটির দাম ২ ডলার।

এবার নিউইয়র্কে দেখে এলাম ব্রডশিটে সংবাদপত্র বলতে ওই একটিই, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এবং সঙ্গে আছে ট্যাবলয়েডে গোটা তিনেক নিউইয়র্ক পোস্ট, ডেইলি নিউজনিউজেড। আমাদের ঢাকায় নামসর্বস্ব পত্রিকাগুলো বিবেচনায় নিলে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে দৈনিক কয়েক ডজন পত্রিকা বেরোয়। তাতে অবশ্য একটা কাজ হচ্ছে; কিছু ছেলেমেয়ে কাজ করে খাচ্ছে।

আর মানুষ প্রবাসে যেখানেই যায়, তার কৃষ্টি-কালচার নিয়েই যায়। তাই নিউইয়র্ক থেকে ট্যাবলয়েড বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরোয় প্রায় এক কুড়ির মতো (সম্প্রতি সেগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়েছে সাপ্তাহিক প্রথম আলো)। এর মধ্যে মাত্র দুটো ব্যতিরেকে বাকিগুলো পাওয়া যায় বিনা মূল্যে—মসজিদগুলোর বারান্দায় কিংবা বাঙালি দোকানের সামনে ফুটপাতে। জ্যাকসন হাইটসের বাঙালি মুদির দোকানে পয়সা দিয়ে ওই দুটো কিনে যখন অন্যগুলো চাইলাম, তখন বিক্রেতা বাঙালি যুবক যে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ফুটপাতের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল সেটা দেখতে পেলে আমার বিশ্বাস, পত্রিকাগুলোর সম্পাদক সাহেবরা ভিরমি খেতেন।

বিদেশে এই বাংলা পত্রিকাগুলো বেঁচে আছে কেবল বিজ্ঞাপনের বদৌলতে এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোয় পরিবেশিত সংবাদ ও কলাম ‘কাটিং’ করে। প্রবন্ধ পুনমু‌র্দ্রণের জন্য আইনত পূর্ব অনুমতি প্রয়োজন; কিন্তু প্রবাসী বাঙালিরা ওগুলোর তোয়াক্কা করেন না। তা এ ধরনের বাছবিচারহীন ‘কাটিং সাংবাদিকতা’ যে অনেক সময় খতরনাক হতে পারে, নিচের উপাখ্যানটিই সেটার প্রকৃষ্ট প্রমাণ:

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমি যখন রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে লেবার কাউন্সেলর পদে কর্মরত, তখন সেখানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগদান করেন চট্টগ্রামের এক রাজনৈতিক নেতা। ঠিক সেই সময়টাতেই চট্টগ্রাম থেকে আগত একজন শ্রমিক সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে জেদ্দাস্থ তার কফিলের ১০ তলা অফিস ভবন থেকে নিচে পড়ে গিয়ে মারা যায়।

আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী আমি তৎক্ষণাৎ দূতাবাসের পক্ষ থেকে সৌদি ফরেন মিনিস্ট্রিতে ‘নোট ভারবাল’ প্রেরণ করি ও তাগিদ দিই। তবে সৌদি সরকার বরাবরই এগুলোর ব্যাপারে নির্বিকার ও শ্লথগতির। কিন্তু রাষ্ট্রদূত নতুন গেছেন; তাই তিনি ধরে নিলেন আমরা যথেষ্ট করছি না। রাষ্ট্রদূতের পারিবারিক পদবি ছিল ‘মীর’ আর এদিকে ঢাকায় তখনকার শ্রমমন্ত্রীরও পদবি ছিল ‘মীর’।

দুই মীরে টেলিফোনে কী মিরেকল কথাবার্তা হয়েছে, খোদায় মালুম। তবে ঢাকার পত্রিকায় হঠাৎ বেরিয়ে গেল, শ্রমমন্ত্রী প্রেস কনফারেন্সে রাষ্ট্রদূতের বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘রিয়াদস্থ লেবার কাউন্সেলরের অবহেলার কারণে একজন বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে।’ অতঃপর লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমত সংবাদটি ‘কাটিং’ করে ছাপানোয় সেথায় বসবাসরত আমার বড় ভাই সেটা পড়ার পর তঁার একটা হার্ট অ্যাটাকই হয়ে গেল। তিনি ভেবে বসলেন, সরকার আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে শূলে চড়িয়ে দেবে।

আমিও অবশ্য রিয়াদে বসে দেশের পত্রিকায় সংবাদটা পড়েছি এবং যথারীতি উপেক্ষা করেছি। কেননা আমি জানতাম, আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ এবং সবার ওপরে একজন তো আছেন। 

আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷