মতামত

সংবাদপত্রের থাকা না-থাকা এবং প্রথম আলো

দুনিয়াজুড়ে দেড়-দুই দশক ধরে যে শঙ্কা খবরের কাগজগুলোর জন্য বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো অনলাইন সংবাদ পরিবেশনার তাৎক্ষণিকতার ও সীমাহীন সহজলভ্যতার যুগে এই মুদ্রণমাধ্যমের আয়ু কি ঘনিয়ে এল? সোজা কথায়, যেখানে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত একটি মুঠোফোনে যে কেউ যখন-তখন দিনের সবচেয়ে তাজা খবরটি পেয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে একগাদা স্থির ও সচল ছবিও, সেখানে কেন মানুষ গাঁটের পয়সা খসিয়ে একটা খবরের কাগজ কিনবে, যেখানে আগের দিনের বাসি খবরগুলো পড়তে হবে? এই অতিমারির শুরুতে তো একটা ভয়ও ছড়িয়েছিল যে খবরের কাগজ মারাত্মক করোনাভাইরাসকে সাতসকালে ঘরের ভেতর নিয়ে আসবে। সে ভয় কেটেছে, কিন্তু অস্তিত্বের সংকটের ভয়টা যায়নি। এই ভয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে সংবাদপত্রের পথে দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো কিছু প্রতিবন্ধকতা, যেমন মুদ্রিত সংবাদপত্রকে টেকসই রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপন না পাওয়া, কাগজ-কালি ও অন্যান্য উপকরণের অব্যাহত দাম বাড়া, নানা ধরনের আইনকানুনের ফাঁকে পড়ে সাংবাদিকদের বিপন্ন হওয়া, সরকারের সুদৃষ্টিতে না থাকার ভোগান্তি, মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রটি ক্রমে সংকুচিত হওয়া এবং সংবাদপত্রকে ব্যবহার করে কিছু মালিকপক্ষের নানা সুবিধা আদায় ও সংবাদপত্রের ওপর তাদের দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণ।

বিজ্ঞাপনের অভাবে আমেরিকার বনেদি সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রায় দেড় শ বছরের প্রথা থেকে বেরিয়ে ২০০৯ সালে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম বিজ্ঞাপন ছাপাতে শুরু করে। আমাদের দেশেও এখন শুধু প্রথম পৃষ্ঠা নয়, প্রথম দুই ও শেষ দুই পৃষ্ঠাজুড়ে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে সামনের পৃষ্ঠার আদলে একটা আলাদা ক্রোড়পত্রে মূল কাগজটিকেও ঢেকে দিতে রাজি অনেক সংবাদপত্র। এখন সংবাদপত্রের মুখ বিজ্ঞাপনে ঢেকে গেলেও উপায় নেই, আয়-ইনকাম যেহেতু কমতির পথে। এখন অনেক পত্রিকাকে সংবাদ বেছে নেওয়া এবং পরিবেশনায় চমক সৃষ্টি করতে হচ্ছে, দৃশ্যমাধ্যমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হলে যা করতে হয় বলে অনেকের ধারণা। পৃথিবীর সব দেশে এ ধরনের কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে নিশ্চয় আরও দেখা যাবে।

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সংবাদপত্রের টিকে থাকা না-থাকার প্রসঙ্গটির অবতারণা কোনো দম্পতির বিবাহবার্ষিকীতে দেওয়া উপহারে ‘আপনাদের বিয়েটা টিকে থাকবে আশা করি’ বা এ রকম কিছু কথা লিখে দেওয়ার শামিল। তবে বিয়েটা যদি ২৩ বছরের পুরোনো হয়, তাহলে এই কথাগুলোয় শঙ্কা তৈরি হবে না, নিছক কৌতুক হিসেবেই সেসব শোনাবে। সংবাদপত্রের সংকটের প্রেক্ষাপটে এই তুলনার অবতারণা নিশ্চয় শঙ্কা মোচনে নেতির চেয়ে অস্তির দিকেই আমাদের নিয়ে যাবে। অর্থাৎ সংবাদপত্র থাকবে, কারণ সংবাদপত্র আমাদের প্রয়োজন, একটি শিক্ষিত, সচেতন, ক্রিয়াশীল সমাজ গঠনের এটি একটি উপকরণ। সংবাদপত্র শুধু খবর পরিবেশন, খেলাধুলা, শরীরচর্চা, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং অন্য নানা বিষয়ে ঘনিষ্ঠ আলোকপাত করে না, বরং সংবাদপত্র একটি সংস্কৃতির নামও। নিউইয়র্ক টাইমস প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন ছাপবে না ছাপবে না—এ নিয়ে যখন দ্বন্দ্বমান ছিল, সিএনএনের এক ভাষ্যকার বলেছিলেন, পাঠকেরা বিজ্ঞাপন পড়ার জন্য এ কাগজ কেনে না, কেনে এর মুদ্রিত কথাগুলো পড়ার জন্য। এটি বন্ধ হওয়া আর মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টস অথবা নিউইয়র্ক ইয়াঙ্কজির মতো (বেসবল) দল অদৃশ্য হয়ে যাওয়া একই ব্যাপার। স্বস্তির বিষয়, কাগজটি শুধু যে টিকে আছে তা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্তিত্বের সংকটের এই মুহূর্তে পাঠককে নানা বিষয়ে অবহিত করে যাচ্ছে, অর্থাৎ বেঁচেবর্তে আছে।

আমাদের দেশে সংবাদপত্রগুলো দীর্ঘজীবী হয় না, কারণ প্রচুর প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে জীবনীশক্তি ধরে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও কয়েকটি কাগজ এখনো স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে টিকে আছে। সংবাদ থেকে অনেক নবীন প্রথম আলো বাজারে আসার পর থেকেই ক্রমে একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। পাঠকপ্রিয় হয়েছে। এর অনলাইন সংস্করণ সারা বিশ্বের লাখ লাখ বাংলাদেশি ও বাঙালি পাঠক পড়ছেন। অর্থাৎ এর গ্রহণযোগ্যতাও ব্যাপক। যদিও এর সমালোচকও আছেন প্রচুর, যাঁদের কারও কারও দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ এবং তাঁরা কাগজটা পড়েন নানান মত-অপমতের ঘষা কাচের ভেতর দিয়ে। তারপরও এসব সমালোচনা গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রমাণ করে, দেশটিতে বহুমত প্রকাশের একটা পরিবেশ মানুষ নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছে। একটা সময় আসবে, যখন যেকোনো বিষয়ে, অথবা বাংলা ভাষায় চলে আসা একটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে বললে, ইস্যুতে-যুক্তিনির্ভর, বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার একটা চর্চা তৈরি হবে। সেই চর্চা অবধারিতভাবে আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চায় গতির সঞ্চার করবে।

আমাদের দেশে সংবাদপত্রগুলো দীর্ঘজীবী হয় না, কারণ প্রচুর প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে জীবনীশক্তি ধরে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও কয়েকটি কাগজ এখনো স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে টিকে আছে। সংবাদ থেকে অনেক নবীন প্রথম আলো বাজারে আসার পর থেকেই ক্রমে একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। পাঠকপ্রিয় হয়েছে। এর অনলাইন সংস্করণ সারা বিশ্বের লাখ লাখ বাংলাদেশি ও বাঙালি পাঠক পড়ছেন। অর্থাৎ এর গ্রহণযোগ্যতাও ব্যাপক। যদিও এর সমালোচকও আছেন প্রচুর।

সেই চর্চা কীভাবে তৈরি হবে এবং তা ক্রমে শক্তিশালী ও টেকসই করা যাবে, তা বলার আগে সংবাদপত্রের অস্তিত্বের সংকটের মূলে যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক। দু-তিনটি বিষয় আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি বিষয়গুলোর মধ্যে আছে সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত নানা পক্ষকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার অথবা কাজে লাগানোর এবং কিছু বাধা উতরানোর বিষয়। কয়েকটি বাদ দিলে বাকি বাধাগুলো সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেগুলো বেশি শক্ত হলেই ঘোর বিপদ।

সংবাদপত্রের সংযুক্তি আছে পাঠকের সঙ্গে, বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে, সমাজ ও নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সংবাদপত্রের মালিক এবং সরকারও এমন দুই পক্ষ, সংবাদপত্রের কাজকর্মে যাদের কোনো হস্তক্ষেপ করার কথা নয়, একে নিয়ন্ত্রণ করা তো দূরের কথা। কিন্তু মালিকদের বেশির ভাগ এ বিষয় মেনে চলেন না, যেহেতু সংবাদপত্রে তাঁরা বিনিয়োগ করেন একে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য। সরকারও কখনো পরোক্ষে, কখনো সরাসরি নানাভাবে সংবাদপত্রকে নিজের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করে। এ জন্য সরকারি বিজ্ঞাপন কমিয়ে, বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রভাবিত করে এবং নানা আইন-বিধানের মাধ্যমে সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করে। এটি শুধু আমাদের দেশে নয়, আমাদের মতো অনেক দেশে, এমনকি ইউরোপের দু-এক দেশেও হয়। আমাদের দেশের কথা যদি বলি, জাতীয় সংসদে কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে গঠনমূলক সমালোচনার এবং অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে, দুর্নীতি আর অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য সংবাদপত্রগুলোই তো একটা বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেয়। এসব কথা শুনলে উপকারটা হওয়ার কথা সরকারেরই, লাভটা হওয়ার কথা দেশেরই। এ জন্য সংবাদপত্রকে প্রতিপক্ষ না ভেবে সহযোগী ভাবাই তো উচিত, জনমত পরিমাপের একটা উপায় হিসেবেও দেখা উচিত।

সংবাদপত্রের উচিত কোনো রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র না হয়ে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের পক্ষে—এমনকি ওই গোষ্ঠী সংবাদপত্রের মালিক হলেও—কাজ না করা। এতে সংবাদপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। সরকার সহযোগিতা করলে, মালিকপক্ষ অদৃশ্য হয়ে থাকলে, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর এবং সর্বোপরি পাঠকের অব্যাহত সমর্থন পেলে সংবাদপত্রের সংকট অনেকটাই কেটে যায়। আমাদের অর্থনীতি মজবুত হচ্ছে, শিল্প-কৃষি-সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী। অর্থনীতি ভালো হলে বিজ্ঞাপন পাওয়াটা অনেকটাই সহজ হবে। আমরা জানি, সরকার ও নানা প্রতিষ্ঠানের ভেতর সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য সংবাদপত্র বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। এ জন্য এর চলার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা যেন তৈরি না হয়, তা দেখাটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের জন্য একটি আবশ্যকীয় কাজ। একই সঙ্গে সংবাদপত্রের একটি বড় দায় হচ্ছে নিজের স্বচ্ছতা ও বস্তুনিষ্ঠতার ভূমিকাটা তৈরি করে রাখা।

সংবাদপত্র অনলাইনে থাকবে, মুদ্রণেও থাকবে, কারণ সংবাদপত্র ঘরের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর একটি সংযোগ। মানুষ টেলিভিশনে খবর শোনে, অনলাইনে খবর পড়ে, তারপরও সকালের সংবাদপত্রটি হাতে তুলে নেয়, কারণ তাতে সময় ও দিনের পৃথিবীর সঙ্গে একটা বাস্তব সংযোগ তৈরি করার তৃপ্তি সে পায়। এ পর্যবেক্ষণ পাশ্চাত্যের মতো আমাদের সমাজেও প্রযোজ্য। দেশে শিক্ষার যত প্রসার হবে, সংবাদপত্রের পাঠক তত বাড়বে।

প্রথম আলোকে তার ২৩তম জন্মবার্ষিকীর শুভেচ্ছা। সারা বছর এর দৃষ্টির কেন্দ্রে থাকুক শিক্ষার নতুন দর্শন ও কর্মপন্থা তৈরি ও গ্রহণের আবশ্যকতাটি। শিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ, উন্নতি ও মান অর্জন এক-দুই প্রজন্মে সংবাদপত্রের জন্যও সুবর্ণ সময় নিয়ে আসবে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শিক্ষাবিদ