বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক জোটের টানা অবরোধ, নিয়মিত হরতাল ও সেই সঙ্গে নাশকতা চালিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনায় এক চরম অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। এই পরিস্থিতি উত্তরণের পথ নিয়ে মতামত দিয়েছেন ইফতেখারুজ্জামান।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে সংকট নিরসনে যে জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন, তা আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো উচিত। একই সঙ্গে যাঁরা এই সংকট নিরসন করতে পারেন, তাঁদেরও এ উদ্যোগকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এখন তাঁদের পরীক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে, তাঁদের ক্ষমতায় থাকার বা ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি আসলে কতটা জনস্বার্থমুখী। সাম্প্রতিক মর্মান্তিক জাতীয় পরিস্থিতিই এই পরীক্ষার তাগিদ সৃষ্টি করে রেখেছে। তবে যত দিন যাচ্ছে, ততই এর প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টা আমলে নিলে তাঁদের লাভ বৈ ক্ষতি হবে না।
এটা ভালো যে দেশের নাগরিকেরা এই সংকট নিরসনে নাগরিক চাহিদার সৃষ্টি করেছেন। অনেক কথাই তো হচ্ছে—সংলাপ, আলোচনা ও সমঝোতা। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই সমস্যার চাবিকাঠি রয়েছে দেশের দুই প্রধান নেত্রীর হাতে। তাঁদের মনে যদি এই উপলব্ধি আসে যে, না অনেক হয়েছে, এখন এই হানাহানির ইতি ঘটানো উচিত। এমন উপলব্ধি এলেই কেবল তাঁরা সংলাপ ও সমঝোতার এসব উপায়ের সদ্ব্যবহার করতে পারবেন।
এবার একটু আবেগের কথা বলি। দেশের ৬৪টি জেলা থেকে ৩২ জন ছাত্র ও ৩২ জন ছাত্রীকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাচাই করে দুই নেত্রীকে তাঁদের মুখোমুখি করা হোক। এতে তাঁরা দেশের তরুণদের কথা সরাসরি শুনতে পারবেন এবং অবশ্যই বুঝতে পারবেন। সেই প্রক্রিয়ায় কোনো নাগরিক, রাজনীতিবিজ্ঞানী—কারও ভূমিকার প্রয়োজন নেই। তাঁরা নিজেরাই শুনবেন, বুঝবেন এবং সেই অনুসারে ব্যবস্থা নেবেন। জাতির সবচেয়ে নিরীহ ও সজীব অংশের মুখোমুখি হওয়ার সৎ সাহস তাঁদের আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন। তবে এটা হলে সবচেয়ে ভালো হতো।
দুই নেত্রীরই এটা মাথায় রাখতে হবে যে এই অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ তাঁদের বাইরে চলে যেতে পারে। তাঁরা যে অগণতান্ত্রিক পরিবেশের সৃষ্টি করছেন, তাতে দেশে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের জন্ম হতে পারে। সেই কথা ভেবেও তাঁদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসা উচিত। সংকট উত্তরণের চাবিকাঠি তাঁদের হাতেই।
কথা হচ্ছে, বিরোধী দলকে সহিংস পথ থেকে সরে আসতে হবে। তাদের স্বীকার করতে হবে, এই পথ ভুল ছিল। তাদের বলতে হবে, এই সহিংসতার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হোক। আমরা এটা সমর্থন করি না। মোদ্দা কথা, তাদের গঠনমূলক ইতিবাচক রাজনীতিতে ফিরে আসতে হবে। এরপর ছয় মাস তারা আত্মবিশ্লেষণ করবে। এই রাজনীতি ছেড়ে তাদের রাজনীতির মূল পুঁজির দ্বারস্থ হতে হবে। সেটা হচ্ছে জনসমর্থন। তাদের তো জনসমর্থন আছে, এটা ভুলে যাওয়া চলবে না। সেই পুঁজি ভাঙিয়ে তাদের রাজনীতি করা উচিত। সেই পথে যেতে হলে তাদের পরবর্তী নির্বাচনের জন্য কর্মসূচি ঠিক করতে হবে। সেই কর্মসূচি অনুসারে তাদের অগ্রসর হতে হবে। নইলে বর্তমান ধারায় চলতে থাকলে তা আমাদের সবার জন্য আত্মঘাতী হবে।
আর সরকারকে আগামী নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করতে হবে। অন্তত ছয় মাস আগে তা ঘোষণা করতে হবে। এরপর তাদের ওপর আরেকটি গুরুদায়িত্ব বর্তায়। সেটা হচ্ছে, নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে তাদের। এর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারও করতে হবে। প্রয়োজন হলে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে সংস্কার প্রস্তাব আনা যেতে পারে। নির্বাচনকালীন প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেমন হবে, তার রূপরেখা নির্ধারণ করতে আলোচনা হতে পারে। একই সঙ্গে সরকারকে আরও কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে: ১) সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া বিরোধী দলের সব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিতে হবে। ২) বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার ও সহিংসতায় দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই গেঁা ধরে বসে থাকলে তো হবে না।
তবে এগুলো সব স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচি। আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যেমন: আমাদের রাজনীতিক, নাগরিক সমাজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাংবাদিক—সবাইকে নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যে কমিশনের দায়িত্ব হবে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কীভাবে রাজনীতি করা যায়, সে পথ খুঁজে বের করা। এতে দেশের নাগরিক সমাজ আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
কথা হচ্ছে, এই দীর্ঘ মেয়াদে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা আমাদের রাজনীতির জন্য সুখকর নয়। আমাদের প্রধান দুই দল হয়তো মনে করছে, সাময়িকভাবে তারা একে অপরকে ঘায়েল করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পেট্রলবোমা, সহিংসতা ও সহনশীলতার অভাব যে শেষমেশ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। কিছুদিন আগে ঢাকায় আইএসের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে আসলে কী করা হয়েছে, তা আমরা জানি না। এ অবস্থা আরও কিছুদিন চললে আত্মঘাতী বোমা হামলাও হতে পারে। এমন অবস্থা তৈরি করার চক্রান্ত শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও রয়েছে। আমাদের সতর্ক হতে হবে, নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই।
ইফতেখারুজ্জামান: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক।