সংকটে শ্রদ্ধায় অপমানে উপেক্ষায় এক বিচারপতি

নিভৃতচারী একজন লোকান্তরিত হলেন ৯২ বছর বয়সে। কোনোভাবেই অকালমৃত্যু বলা যাবে না। তাঁর মৃত্যু নিয়ে মাতম নেই। আহা-উহু নেই। কৃতজ্ঞতাবোধ থাকলে জাতীয়ভাবে ন্যূনতম তিন দিনের জন্য শোক পালন করা হতো। কোনো কোনো বিদেশি রাষ্ট্রনায়কের জন্য আমরা এটা করেছি। দেশের ক্রান্তিকালে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বরং বেশ কিছু মন্তব্য আছে গণমাধ্যমে। ফেসবুকে কিছু বিষোদ্‌গারও দেখেছি। সমাজে সবাই তো এক রকম নয়। আমরা অনেক কিছু বলি মন থেকে, আবার অনেক কিছু বলি মতলব থেকে।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়ে বন্ধুমহলে গর্ব করে বলি, তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই। পড়েছেন অর্থনীতি নিয়ে। ১৯৫৪ সালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে সিএসপি হয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেট, এসডিও ও এডিসি হিসেবে কাজ করেছেন। পরে স্বেচ্ছায় চলে যান বিচার বিভাগে। বিচারিক জীবনটাই ছিল তাঁর পছন্দের। ১৯৭২ সালে হাইকোর্টে এবং ১৯৮০ সালে আপিল বিভাগের বিচারক হন। প্রধান বিচারপতি হন ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে। বছর না পেরোতেই তাঁর কাঁধে চেপে বসে এক গুরুভার। এক সংকটময় সময়ে রাজনীতিবিদেরা নিজেরা ফয়সালা করতে না পেরে তাঁর দ্বারস্থ হন। তিনি সেটি সামাল দিয়েছেন। অন্য কোনো দেশ হলে তাঁকে জাতীয় বীর হিসেবে বন্দনা করা হতো। বাংলাদেশে তাঁকে নিয়ে গত ২০ বছর প্রকৃতপক্ষে কোনো আলোচনাই হয়নি। আড়ালেই থেকে গেছেন তিনি।

১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনেই সাহাবুদ্দীন আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়। ১৯৯১ সালে নির্বাচন হওয়ার পর তিনি প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যান। এ সময়টুকু তিনি ছিলেন ‘ছুটিতে’। এ জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, একজন ব্যক্তির জন্য ‘পবিত্র সংবিধান’ কাটাছেঁড়া করতে হয়েছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা দরকার। রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য তিনি রাজনীতিবিদদের কাছে দেনদরবার করেননি। রাজনীতিবিদেরাই তাঁকে বিচার বিভাগ থেকে টেনে এনে রাষ্ট্রপতির আসনে বসিয়েছিলেন। তিনি তখনই শর্ত দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শেষে আবার ফিরে যাবেন নিজ গৃহে, সুপ্রিম কোর্টে। এটি করার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছিল। বলা যায়, এই প্রথমবার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ ও সংবিধানের সংশোধন হয়েছিল। এ ব্যাপারে আর কোনো নজির আছে কি না আমার জানা নেই। তবে শুরুতে এই ঐকমত্য ছিল না।

ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই জনপদে সাহাবুদ্দীন আহমদের মতো একজন নির্লোভ মানুষ গভীর একটি রাজনৈতিক সংকটের সময় দেশের হাল ধরেছিলেন। এ জন্য তিনি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবেন অনন্য উচ্চতায়। একদা তিনি যেভাবে শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন, তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

তখন রাজনীতিতে তিনটি ঘরানা বা জোট। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলের জোট, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দলের জোট ও বাম দলগুলোর একটি জোট। তিন জোটের নেতাদের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছিল যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবেন। রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। কিন্তু খুব সহজে এটি হয়নি। আওয়ামী লীগ চাইছিল এয়ারভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকারকে রাষ্ট্রপতি করতে। বিএনপির নেতা খালেদা জিয়া আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, প্রধান বিচারপতিই হবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। সারা দিন অপেক্ষা করার পর আওয়ামী লীগ প্রধান বিচারপতিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে মেনে নিতে রাজি হয়। (সূত্র: হায়দার আকবর খান রনো, শতাব্দী পেরিয়ে)

সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে দলনিরপেক্ষ পেশাজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়োগ করেন। তাঁদের কাউকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি হলো নির্বাচন। বিএনপি সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এই ফলাফল ছিল আওয়ামী লীগের কল্পনার বাইরে। এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতি ঢাকার দুটি আসনে বিএনপির ‘অখ্যাত’ প্রার্থীদের কাছে হেরে যান। নির্বাচনের আগে ২৮ জানুয়ারি এক সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের গণজোয়ারে বিএনপি আতঙ্কিত হয়েছে।’ ২৮ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এক অদৃশ্য শক্তির গোপন আঁতাতের মাধ্যমে নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে।’

দেশে তখনো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন বারবার অনুরোধ করছিলেন, সংসদে যেন ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুযায়ী সরকারপদ্ধতিতে সংশোধনী আনা হয়। তাঁর অনুরোধে বিএনপি কর্ণপাত করেনি। এই দলের গঠনতন্ত্রে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতির কথা বলা ছিল। কোনো কোনো বিএনপি নেতা রাষ্ট্রপতিপদ্ধতির পক্ষে কথা বলতে থাকেন। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন চাপে ছিলেন। তিনি যদি স্পিকারের কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দেন, তাহলে বিএনপি সহজেই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। সংবিধান সংশোধনের জন্য বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এ জন্য দরকার ছিল প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা। কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বিএনপি রাষ্ট্রপতিপদ্ধতি বহাল রাখতে চায় এবং খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি হতে আগ্রহী। এতে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন চিন্তায় পড়ে যান। ১৯৯১ সালের ৬ এপ্রিল নতুন জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তিন জোটের রূপরেখা যদিও কোনো সাংবিধানিক বৈধতা বহন করে না, তবু তার রয়েছে বিরাট রাজনৈতিক গুরুত্ব।

প্রথম অধিবেশন চলে ৪১ দিন। কিন্তু বিএনপি সংবিধান সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। মন্ত্রী নাজমুল হুদা প্রকাশ্যেই বলেন, স্পিকারের কাছেই প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার ছেড়ে দেওয়া উচিত। রাষ্ট্রপতি এ ধরনের আচরণে মর্মাহত হন। ১৯৯১ সালের ৫ জুন রেডিও ও টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে রাষ্ট্রপতি একটি সংবিধানসম্মত ফর্মুলা উদ্ভাবনের দায়িত্বের কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন। ২ জুলাই জাতীয় সংসদে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী গৃহীত হলে অচলাবস্থার অবসান হয়। শুধু জাতীয় পার্টি বিলটির বিরোধিতা করেছিল।

১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে সম্মান করেছিল। এ ছিল এক অনন্য উদ্যোগ। এ দেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীন তিনিই সংসদ দ্বারা নির্বাচিত একমাত্র দলনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি। পাঁচ বছর রাষ্ট্রপতি থাকাকালে তিনি বঙ্গভবনেই দিন কাটাতেন। তিনি দেখলেন, বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের আমলে বঙ্গভবনে খাওয়া বাবদ খরচ হতো দৈনিক ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। বঙ্গভবনে আহার ও বাসস্থান ফ্রি। আবদুর রহমান বিশ্বাস গাঁওগেরামের লোক আর আত্মীয়স্বজন নিয়ে রাষ্ট্রের টাকায় খাওয়াদাওয়া করতেন। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন এ ব্যবস্থা পাল্টে দেন। জ্ঞাতিগুষ্টি আর দলের লোকদের গরিব মানুষের ট্যাক্সের টাকায় চর্ব্যচূষ্য খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বাজার খরচ নেমে আসে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়।

২০০১ সালের ২ অক্টোবর আবার হলো জাতীয় সংসদের নির্বাচন। বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় পেল। শেখ হাসিনা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘সূক্ষ্ম নয়, স্থূল কারচুপি করে ফলাফল বদলে দেওয়া হয়েছে।’ আওয়ামী লীগের অভিযোগ, নীলনকশার নির্বাচন করে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর একটা জবাব দিয়েছিলেন সাংসদ আবদুল কাদের সিদ্দিকী। ২০০১ সালের ৪ অক্টোবর সংসদে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছে, নীলনকশার নির্বাচন হয়েছে। আর সে নীলনকশা নাকি রাষ্ট্রপতি, নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার করেছে।...নীলনকশা হলে তা পাঁচ বছর আগে নির্বাচনের সময়ই হয়েছে। তাদের আশা ছিল, রাষ্ট্রপতি তাদের পক্ষে কাজ করবেন।’

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন। রাজনীতির কূটকৌশল বুঝতেন না। তাঁকে নিয়ে আওয়ামী লীগ যেসব প্রশ্ন তুলছে এবং নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে, সে সম্পর্কে তিনি তিন মাস মুখ খোলেননি। ২০০২ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি এ প্রসঙ্গে কথা বলেন। তখন তিনি আর রাষ্ট্রপতি নন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জেতানোর মুচলেকা দিয়ে আমি রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করিনি। তাঁদের সব কথা শুনলে আমি ফেরেশতা, নইলে আমি শয়তান।...হেরে যাওয়ার পর তাঁরা আমাকে নির্বাচন বাতিল করে রাষ্ট্রপতির অধীন পুনরায় নির্বাচন করার অনুরোধ করেন। আমি তাতে রাজি হইনি। (সূত্র: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি ১৯৭১-২০১১)

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ—কেউ অপদস্থ করতে ছাড়েনি। ক্ষমতার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়ার জন্য ক্ষমতাপ্রত্যাশী সবাই দায়ী করেছে তাঁকে। কেউ আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে চায়নি।

তারপরও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই জনপদে সাহাবুদ্দীন আহমদের মতো একজন নির্লোভ মানুষ গভীর একটি রাজনৈতিক সংকটের সময় দেশের হাল ধরেছিলেন। এ জন্য তিনি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবেন অনন্য উচ্চতায়। একদা তিনি যেভাবে শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন, তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

    mohi2005@gmail.com