প্রত্যেক ‘শ্রেষ্ঠ জাতি’র মধ্যে রয়েছে এমন অনেক কল্পকাহিনি, যেখানে দেখানো হয়, সে কীভাবে ‘অপর’ ধর্ম বা জাতির বিরুদ্ধে ‘বিজয়ী’ হয়েছে। এটা খুব পরিকল্পিত রেওয়াজ, ‘রূপকথা’গুলো পড়ানো হয় শিশুকালে। এসব শিক্ষার মধ্যেই উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন হয়ে চলে শ্রেষ্ঠত্বের তৃপ্তি—যুগের পর এ যুগ। এর অন্যদিকে রয়েছে গণসহিংসতা, মানবাধিকারের পদ্ধতিগত লঙ্ঘন, গণহত্যা। এসব কি কারও ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হতে পারে? অনেক দেশ ও তাদের সরকার সে রকমই দাবি করে।
আরাকানে রোহিঙ্গা পীড়ন, কাশ্মীরে বাড়ি বাড়ি থেকে শিশুদের নিয়ে যাওয়া, আসামে ৪০ লাখ মানুষের রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন হয়ে পড়া, বালুচ তরুণদের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার, পশতুদের হাতে হাজারাদের নির্বিচারে খুন, তামিলদের জমিতে সিংহলিদের সেনাছাউনি, বাংলাদেশে কল্পনা চাকমার নিখোঁজ হয়ে থাকা যদি দেশে দেশে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হয়, তাহলে তাকে নিশ্চয়ই নৈতিক ন্যায্যতা দেয় জাতিগত বা ধর্মীয় ‘শ্রেষ্ঠত্ব’-এর বোধ। ‘শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা’ সহিংসতার পটভূমিকে উসকে দেয় প্রায়ই। একে প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য মনে করায়। ‘ধর্ম’ বা ‘জাতি’কে বিপদমুক্ত করার নামেই এটা ঘটে। ‘জয় শ্রীরাম’ বলে গরু পরিবহনকারী গাড়ির চালককে পিটিয়ে মেরে ফেলাকে ধর্মীয় কর্তব্য মনে করছে আরএসএস কর্মীরা।
এই ‘মনে করা’ যে ‘বৈধ’, তার সবচেয়ে বড় নজির মেলে ভোটের হিসাবে। অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের তাঁর দেশে একটা ‘উপজাতি’ হিসেবেও মানতে নারাজ। গত নির্বাচনে তাঁর দল এনএলডি বিপুল ভোটে জিতেছে এবং আগামী বছরের নির্বাচনেও জিতবে।
তামিলদের স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। সিংহলিদের কাছে এই অর্জনের গৌরব এত বড় যে দেশটির আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওই পরিবারের ছোট ভাই গোট্টা রাজাপক্ষেকে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে তারা।
সাংবিধানিক মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পর নিস্তব্ধ কাশ্মীরে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কারফিউ চলছে। খাদ্য ও ওষুধের সংকটে ধুঁকছে জনপদটি। কিন্তু উত্তর ভারত মনে করছে, মোদি এমন কিছু এনে দিয়েছেন, যার তুলনা চলে কেবল ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ যুদ্ধে বিজয়ের সঙ্গে। মোদির জনপ্রিয়তা দেশটিকে বিরোধী দলশূন্য করে ফেলেছে।
ওয়াজিরিস্তানের পশতুদের কিংবা বেলুচিস্তানে স্থানীয় লোকজনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফ, ভুট্টো ডাইনেস্টি কিংবা ইমরান খানের জনপ্রিয়তায় কখনো ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানা যায় না।
এ রকম সব দৃষ্টান্তই কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম কোথাওবা সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতিপরিচয় দ্বারা সুরক্ষা ও সমর্থন পাচ্ছে। সু চিকে সাহায্য করছে বামার পরিচয়; মোদি-অমিত শাহ সমর্থন পাচ্ছেন হিন্দুত্ববাদের; সিংহলি-বৌদ্ধরা রাজাপক্ষেদের মনে করছে শ্রীলঙ্কার ত্রাতা। বাংলাদেশ কিংবা অন্যত্রও ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ জাতি-ধর্ম নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে চিরঞ্জীব রেখেছে। ‘অপর’কে বর্জন জারি রাখতে শ্রেষ্ঠকে সব সময় ঘৃণা ছড়াতেই হয়।
এ মনোভাবই শিশুদের ওপর জ্যেষ্ঠদের সহিংসতা, বস্তিবাসীদের ওপর শহুরে প্রশাসনের উচ্ছেদাভিযান কিংবা অন্য প্রাণীর ওপর ‘মানুষ’-এর খুনোখুনির মধ্যে কোনো অযৌক্তিকতা, অন্যায় খুঁজে পায় না। এই না পাওয়ার পেছনে রয়েছে ‘শ্রেষ্ঠত্বের বোধ’। এই বোধ আজকের দিনে ‘সভ্যতা’র অংশ। এটাকে অস্বাভাবিক মনে করছে না প্রায় কেউই। এ কি অসুস্থতা নয়?
প্রতিটি শ্রেষ্ঠ জাতির থাকে অনেক ‘রূপকথা’
এই ‘গণ-অসুস্থতা’র বৃহত্তর পরিসর আরও ভয়ংকর, যেখানে সমাজে বেশি বেশি নজরদারি ও সামরিকায়নকে প্রয়োজনীয় ভাবা হয়। নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাকে মনে করা হয় জরুরি। ‘ব্যক্তি’ ও ‘কওম’-এর সার্বভৌমত্বকে ক্ষতিকর এবং দুর্বল-দরিদ্রদের বিবেচনা করা হয় ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের জন্য অমানানসই। শ্রেষ্ঠদের জায়গা বাড়াতে তাই বস্তি উজাড় হয়। শ্রেষ্ঠদের বিনোদনের জন্য উপকূলীয় দ্বীপগুলো খালি করতে হয়। শ্রেষ্ঠত্বকে সমাজে মেরুকরণ বাড়াতে হয়। দুই ‘মেরু’র মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে হয়।
এভাবেই এগোতে এগোতে জাতিগত বা ধর্মগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা একপর্যায়ে কিছু ব্যক্তির ‘শ্রেষ্ঠত্ব’-এর পরিসরে পর্যবসিত হয়, যা ‘সিন্ডিকেট’-এর মতো। সফল সিন্ডিকেটগুলো তখন দেশে দেশে অদৃশ্য ‘আধুনিক’ দাসসমাজ সৃজন করে। যেখানে দাসরা দাসত্ব ভুলে থাকে ‘শ্রেষ্ঠত্ব’-এর মাদকে। এভাবেই শ্রেষ্ঠত্ব ক্রমাগত ‘বিজয়ী’ হতে থাকে। একে ন্যায্য মনে করে ‘দাস’রা; যদিও আদতে তাদের সেটা মনে করানো হয় মাত্র।
শ্রেষ্ঠত্বের এই মাদকাসক্তির কাছে গৌণ হয়ে যায় স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বাসস্থান-নিরাপত্তা-মানবিক মর্যাদার যাবতীয় প্রয়োজন। আরাকানে রোহিঙ্গা নিধনে যারা সমর্থন দিয়েছিল, তারাও স্বাধীনতা হারানো রাখাইন। ভারতে বিজেপি যে মুহূর্তে বারবার জিতে চলেছে, ঠিক তখনই কর্মসংস্থানের ব্যাপক খরা যাচ্ছে সেখানে। যে সিংহলি সেনাবাহিনী তামিলদের দমন করেছে, সেই সেনাদের হাতেই পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক দল জেভিপির হাজার হাজার সিংহলি কর্মী গুম হয়ে গিয়েছিল ১৯৭১ ও ১৯৮৭ সালে দুবার। পাকিস্তানিরা তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে গর্বিত। প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন রুপি। কিন্তু প্রায় ২০ ভাগ মানুষ দেশটিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে আজও। গণ-অসুস্থতার কালে এসব স্ববিরোধিতার কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। কিন্তু এসব স্ববিরোধিতা উপরতলার ১ শতাংশের জন্য স্বর্ণসুযোগের মতো।
বাংলাদেশেও নিচুতলার বহু মানুষ, কোটি কোটি শ্রমজীবী বিশ্বাস করে, দেশটা দরিদ্র, কারণ দেশটায় মানুষ বেশি! সম্পদের অসম বণ্টন তাদের কাছে সমস্যা মনে হয় না। বরং ‘বাঙালির একটা দেশ’ নিয়ে সৃষ্ট গর্বের অংশীদার হতে চায় তারা। কেউ কেউ গৌরবান্বিত তাদের ‘ধর্ম’ নিয়ে। ফেসবুক, টুইটার এই গর্বিত মনস্তত্ত্ব প্রচারের সুযোগ অবাধ করেছে। পকেটে স্মার্টফোন থাকলে এই ‘গর্ব’-এর জীবন্ত অংশীদার থাকা যায়। মানুষ তাই আকুল হয়ে ‘উন্নয়ন’-এর সঙ্গে থাকে। মাঝেমধ্যেই ফোন বের করে ‘অর্জন’ খোঁজে। ‘লাইক’ দেয়। একজন শহীদ আফ্রিদি, বিরাট কোহলি কিংবা সাকিব আল হাসান তাদের গর্বিত করে। করপোরেট অফিসে বসে আম্বানিরা হাসে।
বহু ইতিহাস সাক্ষী, শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা এ পথেই গুটিকয়েকের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবনকে সহায়তা করে। নতুন গতি দেয়। সেটা ট্রাম্পের আমেরিকা হোক কিংবা বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারতের দক্ষিণ এশিয়া হোক। এ রকম কাজে মধ্যবিত্তের সহায়তা লাগে। তাই শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা মধ্যবিত্ত তরুণকে ‘স্বপ্ন’ দেখায়। শ্রেষ্ঠত্বকে তখন উন্নয়নের খোলস পরানো হয়। তখনই বাজারে আসে জিডিপির ‘গল্প’গুলো। এই গল্পগুলো উপন্যাসে পরিণত হওয়ার মধ্যেই সিসি ক্যামেরার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ভিন্নমতাবলম্বীদের সংখ্যা তখন কমে। শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শ নিরঙ্কুশ হয়। ‘জাতীয় অর্জন’গুলো তখন রজত-সুবর্ণ-হীরকজয়ন্তীর পর প্লাটিনাম উৎসবের জন্য প্রস্তুত হয়। এই প্রস্তুতির জন্য প্রতিনিয়ত ‘স্বপ্ন’-এর বীজ বপন করতে হয়। ধর্ম ও জাতি চেতনার শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে তখন মিশিয়ে দিতে হয় ধন ও ক্ষমতার স্বপ্ন।
পাকিস্তানি এলিটরা চীনের বিনিয়োগ দিয়ে সেখানকার মধ্যবিত্তকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। বিজেপি দেখিয়েছিল ‘গুজরাট মডেল’ দিয়ে। রাজাপক্ষে প্রয়োজন ছাড়াই গভীর সমুদ্রবন্দর করে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। পরে সেটা জমিসহ বিক্রি করতে হয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্প থেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পাওয়া ‘আয়’ শ্রীলঙ্কার উপরতলার ১ শতাংশকে ফেরত দিতে হয়নি। রাজাপক্ষেকেও এই রুগ্ণ প্রকল্পের জন্য জবাবদিহি করতে হয়নি। কারণ, বৌদ্ধভিক্ষুরা তাঁর পাশে আছেন। চীনে উইঘুরদের কারাগারে পুরে দেওয়ার কাজে আঙ্কেল সির পাশে আছে শ্রেষ্ঠ ‘হান’ জাতি।
‘শ্রেষ্ঠত্ব’ রোগের দায় বইতে হচ্ছে কেবল ‘অন্য’দের
শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা মানুষের প্রাত্যহিক আর্থসামাজিক নাজুকতাকে ‘প্রাইভেট’ বিষয় বানিয়ে দেয়। ‘অপর’কে দমনই তখন কেবল ‘পাবলিক’ বিষয় থাকে। এটাই শ্রেষ্ঠত্বের অক্সিজেন। যুদ্ধের ভঙ্গিতেই কেবল শ্রেষ্ঠত্বের উদ্যাপন।
এ কারণেই শ্রেষ্ঠত্ব অসুখের দায় ভোগ করতে হয় বরাবরই ‘অন্য’দের। ধর্ম, জাতি বা রাজনৈতিক ‘সংখ্যালঘু’দের। জার্মানিতে অর্ধকোটি ইহুদিকে মরতে হয়েছে। ৭০ বছর এই নিয়ে নিন্দা ও শোকের পর ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করে বামাররা জানিয়ে দিল শ্রেষ্ঠত্বের অসুস্থতা চিরায়ত।
তামিলদের ছিন্নভিন্ন জাফনা কিংবা আত্মঘাতী হামলায় প্রকম্পিত মাজার-ই-শরিফের শিয়া হাজারাও শ্রেষ্ঠত্বের জান্তব বাস্তবতার সাক্ষী। কেউ কি জোর করে বলতে পারে, ব্রহ্মপুত্র ভ্যালির ৪০ লাখ মানুষের চোখের জল ভাটির যমুনায় আসবে না? হায়, সে যে সংখ্যালঘুরই চোখের জল। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের চোখের জলের সঙ্গে সেই জলের কি মেশামেশি হতে পারবে?
এই আগস্ট, উপমহাদেশের ‘স্বাধীনতা’র ৭৩তম বিজয়বার্ষিকী প্রবলভাবে জানিয়ে দিচ্ছে, শ্রেষ্ঠত্বের বিকার নিত্যনতুন জ্বালানি পেয়ে দাউ দাউ করে দেয়ে আসছে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে। কে তার মুখোমুখি হবে? কখন? বিকল্প কিছু ভাবছে কেউ?
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক