শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুমুল নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টের অধিবেশন ১৬ নভেম্বর থেকে এগিয়ে ৫ নভেম্বর পুনর্নির্ধারণ করেছেন।
পার্লামেন্টের এই অধিবেশন গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজাপক্ষেকে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজাপক্ষে পরাজিত হলে সেটা একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনারও পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত হবে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সব পক্ষের নজর এখন তাই ৫ নভেম্বরে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
তবে পার্লামেন্টের অধিবেশন ১৬ নভেম্বর থেকে ১১ দিন এগিয়ে এনে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ইতিমধ্যে বরখাস্ত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গে ক্ষমতার লড়াইয়ে একদফা পরাজিত হলেন। সংগতভাবেই পার্লামেন্টের অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘোষণামাত্র বিক্রমাসিংহে টুইট করেছেন, ‘জনতার দাবির জয় হলো’।
পার্লামেন্টের অধিবেশন এগিয়ে আনাটা শ্রীলঙ্কার চলমান রাজনৈতিক সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অক্ষশক্তিরও এক দফা প্রাথমিক বিজয়। প্রকাশ্যেই তারা চাইছিল অবিলম্বে পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করা হোক। চীনের বন্ধু হিসেবে বিবেচিত রাজাপক্ষের প্রধানমন্ত্রী হয়ে পড়া ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লি উভয় রাজধানীতে ছিল তাৎক্ষণিক একটা খারাপ বার্তা। প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রকেই বেশি উদ্বিগ্ন দেখা গেছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা দুটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিল পার্লামেন্টের অধিবেশন চেয়ে।
সিংহলিদের লড়াই মীমাংসা হবে তামিলদের ভোটে?
শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট ২২৫ সদস্যবিশিষ্ট। পার্লামেন্টে ভোটের হিসাব–নিকাশই এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কাজুড়ে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এখানে রাজাপক্ষে ও বিক্রমাসিংহের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। আপাতত যা দেখা যাচ্ছে, বিক্রমাসিংহের ন্যাশনাল পার্টি (এনপি) এবং রাজাপক্ষে-সিরিসেনার ফ্রিডম পার্টি কোনো দলেরই ১০০ জনের ওপরে জনপ্রতিনিধি নেই । ২০১৫ সালে যে পার্লামেন্ট নির্বাচন হয় তাতে রাজাপক্ষের দল ফ্রিডম পার্টি ৯৫টি আসন পায় এবং বিক্রমাসিংহের এনপি ১০৫টি আসন পায়। এনপির ৫ জন এমপি এবং ডগলাস দেবানন্দ নামের একজন তামিল এমপি রাজাপক্ষেকে সমর্থন করছেন এই মুহূর্তে। এর অর্থ দাঁড়িয়েছে রাজাপক্ষে ও বিক্রমাসিংহে উভয়ের ১০১ জন করে এমপি রয়েছেন। অথচ দরকার তাঁদের ১১৩ জনের সমর্থন।
ফলে ৫ নভেম্বরের ভোটাভুটিতে নির্ধারক ভূমিকা নিতে পারে তামিলদের জোট টিএনএ (তামিল ন্যাশনাল এলায়েন্স)। পার্লামেন্টে তাদের ভোট রয়েছে ১৬টি। জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) নামের সিংহলি জাতীয়তাবাদী আরেকটি দলের রয়েছে ৬টি ভোট। মূলত এই ২২ জনই রাজাপক্ষে ও বিক্রমাসিংহের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। জেভিপি অবশ্য বলেছে, তারা কাউকেই ভোট দেবে না। সে ক্ষেত্রে তামিলদের ১৬ জন এমপি সিদ্ধান্তসূচক ভূমিকা নেবেন। টিএনএ জোট যদিও এত দিন সিরিসেনা-বিক্রমাসিংহে সরকারের সমর্থক ছিল। কিন্তু এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে, আসন্ন ভোটাভুটিতেও তারা বিক্রমাসিংহেকে ভোট দেবে। গত তিন বছরে বিক্রমাসিংহে সরকার তামিলদের জন্য এমন কিছু করেনি, যা সমর্থন অব্যাহত থাকার নিশ্চিয়তা দেয়; বিশেষ করে তামিল অঞ্চলগুলোকে অধিক স্বায়ত্তশাসন দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টিতে বিক্রমাসিংহে সরকার সফল হয়নি। তবে তামিল জোটের ওপর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও পছন্দ কাজ করতে পারে। রাজাপক্ষে ইতিমধ্যে ভোটাভুটিতে টিএনএ প্রধান সাম্পাত্তানের সমর্থন চেয়ে আবেদন করেছেন। সিংহলি জাতীয়তাবাদের অন্যতম উগ্র এক প্রতিভূ হিসেবে রাজাপক্ষের এই আবেদন অগ্রাহ্য হলে তামিল-সিংহলি সামাজিক বিবাদ আরও তিক্ত রূপ নেবে। এমনকি তাতে দাঙ্গার ঝুঁকিও রয়েছে। তবে তামিলরা যাঁকেই সমর্থন দেবে, সেটা হবে তাদের এলাকার জন্য সুস্পষ্ট পদক্ষেপের চুক্তির আলোকে। সিংহলিদের অভ্যন্তরীণ এই দ্বন্দ্ব থেকে তারা সর্বোচ্চ ফায়দা নিতে চেষ্টা করবে।
কলম্বোতে এই মর্মে অনির্ভরযোগ্য একটি সংবাদও রয়েছে যে, ১২০ জন এমপি অবিলম্বে পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বানের জন্য স্পিকারকে অনুরোধ করেছেন। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে আস্থা ভোট সিরিসেনা-রাজাপক্ষের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের ভবিষ্যতের জন্য সুখকর না–ও হতে পারে।
কিন্তু জেভিপির মতো টিএনএও যদি ভোটাভুটি থেকে দূরে থাকার নীতি নেয়, তাহলে মাত্র ১-২ ভোটে রাজাপক্ষে ও বিক্রমাসিংহের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। সে ক্ষেত্রে টিএনএ প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কাছেই অপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হবে। ফলে টিএনএকে রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে সিংহলিদের কোনো এক শক্তির সঙ্গে না থেকেও উপায় নেই।
ভোটে রাজাপক্ষে হেরে গেলে কী হবে
শ্রীলঙ্কার বরখাস্ত প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে এখনো নিজেকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করে আসছেন। তবে পার্লামেন্টের স্পিকার কারু জয়সুরিয়া ইতিমধ্যে নিশ্চিত করেছেন যে, গেজেট মান্য করে ৫ নভেম্বর পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর আসনে রাজাপক্ষেকেই বসতে দেওয়া হবে। আস্থা ভোটে রাজাপক্ষে হেরে গেলে তিনি হবেন শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের স্বল্পকালীন প্রধানমন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, আস্থাভোটে তাঁর নিয়োগকৃত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজাপক্ষে হেরে গেলে তিনি নিজেও ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। কারণ যে যুদ্ধ মূলত তাঁর দ্বারা শুরু হয়েছে, তার দায় না নিয়ে উপায় নেই সিরিসেনার। সে ক্ষেত্রে দেশটিতে পার্লামেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট উভয় নির্বাচন এগিয়ে আসতে পারে। যদিও নতুন করে উভয় নির্বাচনের এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি আছে।
শ্রীলঙ্কার জন্য এই মুহূর্তে আরও দুটি জাতীয় নির্বাচনের ভার বহন প্রকৃতই দুরূহ। দেশটির অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না। জিডিপির প্রবৃদ্ধি (৪ শতাংশের নিচে) দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় বৈদেশিক দেনার ভার। গত বছর ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার দেনার ভার মেটাতে না পেরে চীনকে ৯৯ বছরের জন্য দক্ষিণের হামবানটোটা বন্দর লিজ দিতে হয়েছে।
বলা বাহুল্য, এরূপ পরিস্থিতির দায়ভার রাজাপক্ষে-সিরিসেনা-বিক্রমাসিংহের মতো সিংহলি রাজনীতিবিদদের ওপরই বর্তায়। ২০০৯-এর আগে তামিলদের স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা যতটা উদ্যম ও আক্রোশ নিয়ে তারা দমাতে পেরেছেন, ততটা যোগ্যতার সঙ্গে যুদ্ধজয়–পরবর্তী সময়কে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য কাজে লাগাতে পারেননি। সিরিসেনার ২৬ অক্টোবরের রাজনৈতিক জুয়া সিংহলি রাজনীতিবিদদের অতীত লাগাতার ব্যর্থতাকে সম্ভবত আরও বিপর্যয়কর রূপ দিতে চলেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার এই অধ্যায় তামিলদের মাঝে হতাশা আরও বাড়াবে। ৫ নভেম্বরের আস্থাভোটে যদিও তাদের ‘কিংমেকার’ হওয়ার একটা সুযোগ মিলেছে, কিন্তু ফ্রিডম পার্টি ও ন্যাশনাল পার্টির শক্তি পরীক্ষার এই মহাযুদ্ধে উত্তরের তামিল অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নটি রাজনৈতিক পরিসর থেকে অনেকখানি হারিয়ে গেল।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক