শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক সংকটের জন্য দায়ী কারণগুলোর মধ্যে অনেকগুলো সম্পর্কে বিশ্লেষকেরা একমত হলেও চীনের অর্থায়নে মেগা প্রকল্পের ভূমিকা কতটুকু, সেটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণে চীনা ঋণের হিস্যা যেহেতু ১৫ শতাংশ (তর্ক সাপেক্ষে), তাই শ্রীলঙ্কার সংকটের জন্য চীনা ঋণকে দায়ী করা ঠিক হবে না। ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কার সংকট আসলে একটা উপসর্গ, মূল রোগ নয়। মূল রোগের আলোচনায় যাওয়ার আগে ঋণ নিয়ে কিছু কথা বলে রাখা যাক।
‘ধার করে ঘি খাওয়ার’ চর্চা শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘদিন ধরেই আছে। সত্যি বলতে, এটা মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতায় আসার আগেই ছিল। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার মোট জাতীয় ঋণ জিডিপির ১১০ শতাংশের মতো (যা নিরাপদ সীমার প্রায় দ্বিগুণ)। মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতায় আসার আগেই শ্রীলঙ্কায় ঋণ জিডিপির অনুপাত ছিল ৮০ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন দেশের ঋণের অনেক বছরের ডেটা লাইন গ্রাফের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয় বলে সাধারণ প্রবণতা এক মুহূর্তেই চোখে পড়ে। শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের গ্রাফটিতে গেলে দেখা যাবে, স্বাধীনতার পর থেকে গ্রাফটি ধীরে ধীরে বেড়েছে। মাহিন্দা রাজাপক্ষের প্রথম প্রেসিডেন্ট হওয়ার বছর, ২০০৫ সালে গ্রাফটি হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে খুব দ্রুত ওপরে উঠে যায় এবং সেভাবেই চলতে থাকে। রাজাপক্ষেদের শাসনামলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে আগে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ বেশি ছিল, কিন্তু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল বেশ কম। মাহিন্দা এসে বিদেশি ঋণকে অতি দ্রুত ভয়ংকর বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যান।
চীনা ঋণ নিয়ে সমালোচনার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সেগুলো ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে এমন সব প্রকল্প, যেগুলো তৈরির আগেই স্পষ্ট ছিল সেগুলোর আদৌ কোনো অর্থনৈতিক উপযোগিতা নেই। হামবানটোটা সমুদ্রবন্দর, মাত্তালা রাজাপক্ষে বিমানবন্দর, কনফারেন্স সেন্টার এবং ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পোর্ট সিটি কলম্বোর কথা এখন বাংলাদেশের সচেতন মানুষমাত্রই জানেন। প্রশ্ন হচ্ছে, নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে, এমন প্রকল্প বানাতে চীন কেন অর্থায়ন করে?
বর্তমান বিশ্বে চীনের পরিচিতি অনেকটা আমাদের দেশের ঋণ দেওয়া মহাজনের মতো। যে মহাজন জমি বন্ধক নিয়ে ঋণ দেয় আর আশা করতে থাকে ঋণ নেওয়া ব্যক্তি যেন ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়, যাতে বন্ধকি সম্পত্তি সে নিজে নিয়ে নিতে পারে। আবার কোনো দেশ ঋণ ফেরত দিলেও তাতেও চীনের নানা রকম লাভের বিষয় থাকে।
চীন কীভাবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ঋণচুক্তি করে, সে সম্পর্কে বৈশ্বিক পরিসরে খুব ধারণা না থাকলেও সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন, ‘হাউ চায়না লেন্ডস: আ রেয়ার লুক ইনটু হান্ড্রেড ডেট কন্ট্রাক্টস উইথ ফরেন গভর্নমেন্টস’ থেকে অনেক কিছুই জানা যাচ্ছে। এখানে আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব ইউরোপের ২৪টি দেশের সঙ্গে চীনের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর করা ১০০টি ঋণচুক্তির বিশ্লেষণ করেছেন আইন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাঁচ বিশেষজ্ঞ।
বর্তমান বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী সরকারদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছে চীন। চীন নিজে যেহেতু গণতান্ত্রিক শাসনের বিপরীতে একদলীয় ও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় চলে, তাই তার মধ্যে প্রবণতা আছে বিভিন্ন দেশে একই ধরনের শাসনব্যবস্থা চালু করার। চীনের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যেমন শাসনগত অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি থাকা জরুরি, সেটা উদার গণতান্ত্রিক দেশ দিতে পারে না। চীনের এমন চেষ্টা একেবারেই প্রকাশ্য।
এ বিশ্লেষণে চীনা ঋণের যে চরিত্র সামনে আসে, তার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ১. একই ধরনের অন্য যেকোনো বৈশ্বিক চুক্তির তুলনায় চীনা ঋণচুক্তিগুলোয় অনেক বেশি কঠোর এবং অনেক বেশি গোপনীয়তার শর্ত থাকে। চুক্তির বিস্তারিত, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণচুক্তি আছে, এমন তথ্য প্রকাশ না করার শর্ত থাকে। ২. চীনের ঋণদাতারা অন্য ঋণদাতাদের তুলনায় অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা চান। যেমন ঋণগ্রহীতা দেশে এমন অ্যাকাউন্ট থাকবে, যেটা ঋণদাতা পরিচালনা করবেন এবং চীনের দেওয়া ঋণে অন্য কোনো সমন্বিত উদ্যোগে (যেমন ‘প্যারিস ক্লাব’) রিস্ট্রাকচারিং করা যাবে না। ৩. চীনা ঋণচুক্তির মধ্যে প্রকল্পের গতি বৃদ্ধি, স্থিতাবস্থা বজায় রাখা এবং বাতিল করার ক্ষেত্রে চীনের অনেক বেশি ক্ষমতা আছে, যা দিয়ে তারা ঋণগ্রহীতা দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি প্রভাবিত করার ক্ষমতা পায়।
শুধু সেটাই নয়, আমরা অনেকেই জানি, চীনা ঋণ মূলত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট। অর্থাৎ চীনা ঋণের খুব বড় একটা অংশ (ক্ষেত্রভেদে তিন-চতুর্থাংশ পর্যন্ত) ব্যয় করতে হয় চীন থেকে পণ্য ও সেবা কেনার জন্য। চীনা প্রকল্পগুলোর নির্মাণসামগ্রীর প্রায় সবকিছু যেমন চীন থেকে আনা হয়, তেমনি হাজার হাজার চীনা সাধারণ শ্রমিক কাজ করেন প্রকল্পগুলোয়। একই প্রবণতা কিন্তু আমরা এখন বাংলাদেশেও দেখছি।
চীনের অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঋণসহ বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে যাচ্ছেতাই করা থেকে শুরু করে পরিণাম না ভেবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর দেউলিয়া হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীর পরও ভ্যাট অর্ধেকে নামিয়ে আনা, পুরো কৃষিকে জৈবকৃষিতে রূপান্তর করার মতো উদ্ভট চিন্তাগুলো এসেছে রাজাপক্ষেদের স্বৈরাচারী মানসিকতার কারণে। এটাই আসলে শ্রীলঙ্কার সংকটের প্রধান কারণ।
গুম, অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলার মাধ্যমে বিরোধীদের দমন, সংবাদমাধ্যম ও ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের ওপর তীব্র চাপ, চরম দুর্নীতি, ইস্টার বোমা হামলার অজুহাতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর তীব্র বিদ্বেষ সৃষ্টি আর বিচ্ছিন্নতাবাদী ইতিহাসের কারণে হিন্দু তামিলদের প্রতি বিদ্বেষকে উসকে দিয়ে সিংহলি উগ্র জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া দেওয়ার মতো নানা অগণতান্ত্রিক কাজ করেছেন রাজাপক্ষে ভাইয়েরা। ক্ষমতায় এসেই দুই ভাই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা নিয়ে কোনো রাখঢাক করেননি; রীতিমতো সাংবিধানিক সংশোধনীর মতো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন (১৮ ও ২০তম সংশোধনী)।
সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীতে শ্রীলঙ্কায় একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল ছিল। এটি গঠিত হতো সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য এবং নাগরিক সমাজের সদস্যদের (৩ জন) নিয়ে। প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্ট ও আপিল আদালতের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল নিয়োগ করত এই কমিশন। এ ছাড়া দেশের সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন কিছু কমিশন, যেমন নির্বাচন কমিশন, অডিট কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, জাতীয় প্রকিউরমেন্ট কমিশনসহ অন্যান্য কমিশনও নিয়োগের এখতিয়ার ছিল সেই সাংবিধানিক কাউন্সিলের। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’-এর ক্ষেত্রে এটা এক অসাধারণ অনুকরণীয় পদক্ষেপ ছিল।
২০তম সংশোধনীতে গোতাবায়া রাজাপক্ষে এই সাংবিধানিক কাউন্সিল বিলুপ্ত করে দেন। এর জায়গায় আনা হয়েছে সংসদীয় কাউন্সিল, যাতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই সংসদীয় কাউন্সিলকে শুধু পর্যবেক্ষকের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে; তারা শুধু মতামত দিতে পারবে। এখন প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়োগ দিতে পারেন।
২০তম সংশোধনীতে খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে প্রেসিডেন্টের সব কর্মকাণ্ডকে আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া হয়েছে; তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি অভিযোগ আনা যাবে না। অথচ ১৯তম সংশোধনীতে এটা করা যেত। প্রেসিডেন্টকে আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া এবং সাংবিধানিক কাউন্সিলকে প্রথম বিলুপ্ত করা হয় ২০১০ সালে, প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সময়, সংবিধানের ১৮তম সংশোধনীতে। মাহিন্দা তাঁর ছোট ভাই গোতাবায়ার চেয়ে আরেকটি কাজ বেশি করেছিলেন, একজন প্রেসিডেন্ট দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না—এ বাধ্যবাধকতা বাতিল করেছিলেন। ১৯তম সংশোধনীতে এটা আবার যুক্ত হয়, কিন্তু গোতাবায়া এটাকে আবার বাতিল করেননি।
শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টের হাতে কোনো মন্ত্রণালয় থাকা বাতিল করা হয়। কিন্তু ২০তম সংশোধনীতে সেটা আবার ফিরিয়ে আনা হয় এবং গোতাবায়া রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রেখেছেন নিজ হাতে।
গোতাবায়ার ২০তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টকে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আগের সংশোধনীতে মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা নির্দিষ্ট করা থাকলেও এ সংশোধনী অনুযায়ী তিনি যত ইচ্ছা ততজন মন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারবেন। এর চেয়েও বড় কথা, এ সংশোধনীতে মন্ত্রিসভা গঠনে প্রধানমন্ত্রীকে স্রেফ একজন পর্যবেক্ষক বানিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দেওয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্টকে। ১৯তম সংশোধনীতে সাড়ে চার বছরের আগে প্রেসিডেন্ট সংসদ ভাঙতে পারতেন না।
শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী প্রেসিডেন্টের একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা কমিয়েছিল, গণতন্ত্র শক্তিশালী করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। বলা হয়, এ সংশোধনী শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় এক বিরাট মাইলফলক এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনীয় অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়। এ সংশোধনী হয়েছিল ২০১৫ সালে, যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাইথ্রিপালা সিরিসেনা আর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রনিল বিক্রমাসিংহে (যিনি এখন আবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন)।
শ্রীলঙ্কায় সংবিধানের মাধ্যম কর্তৃত্ববাদ কায়েম করতে চাওয়া আর দেশকে উদার গণতান্ত্রিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাওয়া মানুষের মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য আছে। দুই রাজাপক্ষে ভাই অতি চীনঘনিষ্ঠ আর দেশকে সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক করতে তুলতে চাওয়া দুজন, বিশেষ করে বিক্রমাসিংহে চীনবিরোধী বলেই বেশ পরিচিত। আমরা জেনে রাখব, ক্ষমতায় এসেই সিরিসেনা-বিক্রমাসিংহে সরকার ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচের পোর্ট সিটি কলম্বোর কাজ বন্ধ করেছিলেন, যদিও চীনের চাপের কাছে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি।
কোনো দেশে সামরিক কিংবা বেসামরিক একনায়কতন্ত্র টিকে থাকার জন্য আসলে অতি শক্তিশালী কারও পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। স্নায়ুযুদ্ধকালে পৃথিবীর অনেক দেশে গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিশেষ করে সামরিক একনায়কত্ব ক্ষমতা দখল করতে ও টিকে থাকতে পেরেছিল তৎকালীন মার্কিন সরকারের নীতির কারণে।
তখন সমাজতন্ত্র নিয়ে তরুণদের মোহের সময়। মার্কিনরা দেখেছিল, একটা দেশে গণতান্ত্রিক আবহাওয়া খুব ভালোভাবে বিরাজমান থাকলে সেখানে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ মাথাচাড়া দেয়, তাই স্বৈরশাসকের হাতে ক্ষমতা দিয়ে কমিউনিস্টদের চাপে রাখা ছিল তখনকার মার্কিন সরকারগুলোর নীতি। এ কারণেই আমরা দেখব সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার প্রয়োজন ফুরানোর কারণে পৃথিবীর বহু দেশে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটেছে। বাংলাদেশের এরশাদের পতনকেও আমি এর একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ বলে মনে করি।
বর্তমান বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী সরকারদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছে চীন। চীন নিজে যেহেতু গণতান্ত্রিক শাসনের বিপরীতে একদলীয় ও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় চলে, তাই তার মধ্যে প্রবণতা আছে বিভিন্ন দেশে একই ধরনের শাসনব্যবস্থা চালু করার। চীনের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যেমন শাসনগত অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি থাকা জরুরি, সেটা উদার গণতান্ত্রিক দেশ দিতে পারে না। চীনের এমন চেষ্টা একেবারেই প্রকাশ্য। বাংলাদেশে ২০১৮ সালের বিতর্কিত ও সমালোচিত নির্বাচনের ঠিক পরপর চীনা সরকারের অন্যতম মুখপত্র ‘গ্লোবাল টাইমস’-এ ‘বাংলাদেশ ক্যান আনলিশ মোর অপরচুনিটি বাই ওভারকামিং পার্টিজান পলিটিকস’ শিরোনামের নিবন্ধে বলা হয় উন্নয়ন অব্যাহত বাংলাদেশকে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে সরে আসতে হবে।
শুধু প্রকল্প দিয়ে লুটপাটের সুযোগ নয়, রাজাপক্ষে ভাইদের পেছনে এই চীন আরও নানাভাবে দাঁড়িয়েছে। যে কাজ সিংহলিদের কাছে এই দুই ভাইকে নায়কে পরিণত করেছিল, সেই তামিলদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংঘাতের সময় মারাত্মক যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে আনীত প্রস্তাবে একাধিকবার ভেটো দিয়ে দুই ভাইকে রক্ষাকারী দেশটি চীন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কয়েকবার ভোট দিয়েছিল চীন। সর্বশেষ ভোটে চীনের সঙ্গে যে ১০ দেশ শ্রীলঙ্কার পক্ষে ভোট দিয়েছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশও আছে। এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও (আইসিসি) কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগবে। বলা বাহুল্য, তাঁদের বাঁচতে তখন চীনের ভেটো লাগবেই।
নিশ্চয়ই মনে আছে, আমাদের জন্য চরম সংকট সৃষ্টিকারী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আনীত প্রস্তাবেও দফায় দফায় ভেটো দিয়েছিল চীন এবং রাশিয়া।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির মূল কারণ রাজাপক্ষে ভাইদের স্বৈরাচারী মানসিকতা। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও দমনপীড়নের মাধ্যমে তাঁরা হয়ে উঠতে চেয়েছেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী একেকজন স্বৈরাচার। অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমাদের সঙ্গে চীনের সংঘাতে নিজের পক্ষে রাখার জন্য স্বৈরাচারী শাসকদের চীন সমর্থন দিয়ে যাবে। তার উদাহরণ দেখা যাবে আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপে।
জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক