শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক বন্ধুটি এবার বাংলাদেশ থেকে শপিং করলেন নানা জাতের ওষুধ। ঢাকায় এসেছিলেন পেশাগত কাজে। একসময় পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন, সরকারের সঙ্গেও কাজ করেছেন, এখন কাজ করেন সংবাদমাধ্যম নিয়েই। শ্রীলঙ্কার রাজনীতির ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক। গত বৃহস্পতিবার তাঁর ঢাকা ছাড়ার আগের রাতে একান্ত আলোচনায় সব ছাপিয়ে আসে শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থা। নাম প্রকাশ করতে চান না তিনি, কিন্তু বললেন সবকিছুই।
তাঁর পরিবারেই থাকেন তাঁর অশীতিপর শাশুড়ি। নানা রোগে জর্জরিত। মাসে অনেক ওষুধ লাগে। শ্রীলঙ্কার নানা সংকটে ওষুধের প্রাপ্যতাও এখন বড় সমস্যা। সে জন্যই তাঁর শপিং তালিকায় অগ্রাধিকার ওষুধ। ওষুধ কেনা শেষে কফি হাতে জানতে চাই শ্রীলঙ্কার সংকটের আসল কারণগুলো।
আলোচনায় ওঠে আসে বড় মাপের সংকটের কথা। ঋণ নিয়ে সমস্যা নেই, কিন্তু সমস্যা হলো, সেই ঋণ কীভাবে পরিশোধ করা হবে সেই পথ নিয়ে চিন্তা করা হয়নি, অথবা চিন্তা থাকলেও তা যে বাস্তবানুগ ছিল না, তা তো প্রমাণিতই। জাহাজ নেই, কিন্তু ঋণ নিয়ে বানানো হয়েছে নৌবন্দর। নিজেদের উড়োজাহাজ নেই, বিদেশি উড়োজাহাজ আসবে এমন নিশ্চয়তা না পেয়েও বানানো হয়েছে বিশাল বিমানবন্দর। এর সঙ্গে করোনা মহামারি পেরেক ঠুকেছে আয়ের পথে।
সাংবাদিক হিসেবেই তাঁর বিশ্লেষণ, তামিল বিদ্রোহীদের পরাস্ত করার পর অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে রাজাপক্ষে পরিবার। তারা যা চেয়েছে তা–ই হয়েছে, কাজেই তারা যা খুশি তা–ই করেছে। ‘ওয়ান কান্ট্রি ওয়ান ল’ করে উগ্র বৌদ্ধদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। তামিল তো বটেই, মুসলমান, খ্রিষ্টানসহ কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীই দেশটিকে আর নিজের দেশ মনে করে না। অথচ, একসময় মুসলমানরা ছিল দেশটির বড় বাণিজ্য–শক্তি।
গত আড়াই বছরে পর্যটন থেকে আয় শূন্যের কোঠায়। আর রাশিয়া–ইউক্রেন পরিস্থিতি ঠুকেছে শেষ পেরেক। কারণ, এই দুই দেশ থেকেই আসতেন সবচেয়ে বেশি পর্যটক। দুই দেশেই শ্রীলঙ্কা থেকে রপ্তানি হতো সবচেয়ে বেশি চা। এখন দুটোই বন্ধ।
জানতে চাই, চীন কি বিপদের সময় দূরে সরে গেল? বন্ধুটি বলেন, একটি পরিবারের অপশাসনে যখন দেশ ডুবছে, তখন চীন সতর্ক করেছিল। কিন্তু সেই পরিবার শোনেনি কিছুই। তাতে চীন যে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট, তা বোঝা যায়।
ভেতরের আরও খবর জানতে চাই তাঁর কাছে।
সাংবাদিক হিসেবেই তাঁর বিশ্লেষণ, তামিল বিদ্রোহীদের পরাস্ত করার পর অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে রাজাপক্ষে পরিবার। তারা যা চেয়েছে তা–ই হয়েছে, কাজেই তারা যা খুশি তা–ই করেছে। ‘ওয়ান কান্ট্রি ওয়ান ল’ করে উগ্র বৌদ্ধদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। তামিল তো বটেই, মুসলমান, খ্রিষ্টানসহ কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীই দেশটিকে আর নিজের দেশ মনে করে না। অথচ, একসময় মুসলমানরা ছিল দেশটির বড় বাণিজ্য–শক্তি। পাশাপাশি একদিকে সরকারে যেমন একটি পরিবারের দৃশ্যমান উপস্থিতি বেড়েছে, এর প্রভাব পড়েছে আমলাতন্ত্রে। আমলারা ওই পরিবারটিকে তোষণ করে হয়েছেন বেপরোয়া। রাজনৈতিক আর আমলাদের যৌথ চক্রের বেপরোয়া লুটপাট ও দুর্নীতি দেশকে ফোকলা বানিয়ে ফেলেছে। সরকার ও পরিবারের আশীর্বাদ ধন্য ব্যবসায়ীরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে, পাচার করেছে। বৈষম্য বেড়েছে সীমাহীন।
তিনি আরও বলছেন, রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষ প্রায় নিশ্চিহ্ন, সিভিল সোসাইটি কণ্ঠস্বরহীন, মিডিয়া সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রিত। একটি পরিবার ও সরকারের অন্ধ সমর্থকদের বসানো হয়েছে নানা পদে। বছরের পর বছর তাঁরা এসব পদে বসে সরকার ও পরিবার তোষণে যতটা পারঙ্গম, নিজেদের দায়িত্ব পালনে ততটাই অযোগ্য, অথর্ব। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোও কার্যত ধ্বংসের মুখে। এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে দলের মধ্যেও। দলের মধ্যে যোগ্য যাঁরা, তাঁরা হয় দেশ ছেড়েছেন, না হয় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। পরিবারতন্ত্র, শোষক সরকার, দুর্নীতিবাজ আমলা, লুটেরা ব্যবসায়ী, নানা পদে নিয়োগ পাওয়া অযোগ্য চক্র এমন একটি বৃত্ত গড়ে তুলেছে যে দেশ পরিচালনায় কোনো সৎ পরামর্শই নীতিনির্ধারক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না। এমনকি পরিস্থিতির যখন অবনতি হচ্ছিল, তখন আইএমএফের সতর্কবার্তাও নীতিনির্ধারকেরা কানে তোলেননি।
জানতে চাই, এ অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কা কি বেরোতে পারবে? কীভাবে?
জবাব, বের হয়ে আসার শক্তি শ্রীলঙ্কার আছে। চীন চুপ। ভারত এগিয়ে এসেছে, বাংলাদেশও সহায়তা দিচ্ছে। ভারত গ্যারান্টার হলে আইএমএফ বেইল আউট প্যাকেজে রাজি হবে। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর সে কথাই বলছেন। কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়। শাসকদলের মধ্যেও যাঁরা নির্বাচিত, যোগ্য ও মেধাবী, তাঁরা তো নীতিনির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না বা তাঁদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
ঘুরেফিরে ‘দুই ভাই চক্রের’ হাতেই নাটাই ঘুরছে। তাঁদের নাটাইয়ের সুতা হচ্ছে দুর্নীতিবাজ আমলা, লুটেরা ব্যবসায়ী, অযোগ্য, অথর্ব কিছু চেনা মুখ। এ অবস্থায় এই চক্র না দেশের মানুষের আস্থায় থাকতে পারছে, না যাদের সহায়তায় সংকট উত্তরণ সম্ভব, তাদের আস্থা অর্জন করা যাচ্ছে।
বন্ধুটি শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেন, রাজনীতির মধ্যেই সমাধান বের করতে হবে। এমনকি শাসকদলের মধ্যেও যোগ্যতর যাঁরা, তাঁরা সামনে এসে হাল ধরার সুযোগ পেলেও পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। বিরোধী দলেও মেধাবী ও যোগ্য মানুষ আছেন। যেমনটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিঙ্গে বলেছেন, ‘আমাদের তরুণেরা শাসকগোষ্ঠীর প্রতি রাজপথে তাঁদের ঘৃণা উগরে দিচ্ছেন, কিন্তু হিংসা ছড়াচ্ছেন না। তাঁদের এই প্রত্যাশা তো সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ধারণ করতে হবে।’
আলোচনায় মধ্যরাত পার হয়। বিমর্ষভাবে কলম্বো উড়ালের প্রস্তুতি নেন বন্ধুটি। এই দুঃসময়ে বাংলাদেশ যে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে, সে জন্য কৃতজ্ঞতা তাঁর।
মনজুরুল আহসান বুলবুল সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে; সাবেক ভাইস চেয়ার, আইপিআই; সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব