মতামত

শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে ভাইদের যুদ্ধাপরাধ ও সংখ্যালঘু নিপীড়ন

মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও গোতাবায়া রাজাপক্ষে
ছবি: রয়টার্স

এই মার্চেই, ৪৬তম অধিবেশনে (ভার্চ্যুয়াল) জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের বৈঠকের একটি সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) কাছে একটি পাঠানো হয়। এতে তাঁর দপ্তরকে শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য ‘সংগ্রহ, সংকলন, বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণ’ করতে বলা হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগসহ তামিল ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটা সহিংসতার বিবরণ।

গত জানুয়ারিতে ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অবরোধ ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হলেও মানবাধিকার পরিষদ এবার অত দূর পর্যন্ত যায়নি। ২২টি দেশ এ সিদ্ধান্তে সমর্থন দেয়, ১১টি দেশ বিরোধিতা করে, অনুপস্থিত থাকে ১৪টি দেশ। শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে বিজয় হিসেবে অভিহিত করেন, যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বিপক্ষে বা অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে এরপরও এ সিদ্ধান্তের আলোকে আইনি পদক্ষেপ চাইলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারবে।

শ্রীলঙ্কার আগের সরকার এ ধরনের পদক্ষেপ থামাতে পুনর্মিলন প্রক্রিয়া চালু, নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে দপ্তর প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিক বিচারক, আইনজীবী ও তদন্তকারীদের সমন্বয়ে যুদ্ধাপরাধ আদালত এবং ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এনেছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী, জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ এবং বৌদ্ধ পুরোহিতেরা তা হতে দেননি, দেবেনও না।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয় শ্রীলঙ্কার সরকার বারবারই অস্বীকার করে আসছে। তামিল বিদ্রোহীরাও বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটালেও শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সব ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে গেছে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের তারবার্তায়ও যুদ্ধাপরাধের দায় ‘দেশটির শীর্ষ সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের এবং বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে ও তাঁর ভাইদের’ বলে জানিয়েছিল। বর্তমানে মাহিন্দা রাজাপক্ষে দেশটির প্রধানমন্ত্রী এবং তামিল যুদ্ধের সময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোতাবায়া রাজাপক্ষে এখন দেশটির প্রেসিডেন্ট।

আন্তর্জাতিক চাপে মাহিন্দা রাজাপক্ষে সরকার একটি কমিশন গঠন করলেও তাদের প্রতিবেদনে সব দায় চাপানো হয়েছে তামিলদের ওপর। এমনকি শান্তি আনায় ওই কমিশন যে কয়টি নিরপেক্ষ প্রস্তাব করেছিল, তা-ও মানা হয়নি।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয় শ্রীলঙ্কার সরকার বারবারই অস্বীকার করে আসছে। তামিল বিদ্রোহীরাও বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটালেও শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সব ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে গেছে

মিথ্যাচার এবং সত্য প্রকাশে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং তাঁর জাতীয়তাবাদী সমর্থকেরা প্রকাশ্যেই মানবাধিকারের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়ে যাচ্ছেন। শ্রীলঙ্কার আদালত বেসামরিক তামিলদের গলা কেটে হত্যার জন্য অল্প কয়েকজন সেনাকে শাস্তি দিলেও প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষ তাঁদের ক্ষমা করে দেন। যুদ্ধাপরাধের হোতাদের মধ্যে সেনাপ্রধান এবং প্রতিরক্ষাসচিবকে জেনারেল পদেও উন্নীত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওই সেনাপ্রধান ও তাঁর পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি ক্ষেত্র হলো মুসলিম জনগোষ্ঠী। কোভিড-১৯-এ মারা যাওয়া কোনো মুসলমানের কবর সেখানে হতে পারে না। তঁাদের বাধ্যতামূলকভাবে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। মুসলমানদের অনেক মাদ্রাসা সেখানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেবল এইচআরসি বৈঠকের আগে নিষেধাজ্ঞাটি তুলে নেওয়া হলেও রাজাপক্ষে গোষ্ঠী জনগণের মধ্যে তীব্র ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে চলেছে। তারপরও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও উজবেকিস্তান জাতিসংঘের সাম্প্রতিক ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়, অন্যরা অনুপস্থিত থাকে।

জাতিসংঘের ওই রেজল্যুশন শ্রীলঙ্কার সিংহলি জাতীয়তাবাদের দম্ভের বিরুদ্ধে এক সতর্কবার্তা। ২০১৯-এ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে চলছে সামরিকায়ন। ২৮টি বেসামরিক শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদে সাবেক সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বসানো হয়েছে। ৩০টি সরকারি দপ্তরকে নেওয়া হয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

সামরিকায়নের পাশাপাশি চলছে নজরদারি ও সাংবাদিক নির্যাতন। শ্রীলঙ্কার সরকার তামিল ও মুসলিম-অধ্যুষিত উত্তর ও পূর্বের প্রদেশগুলোকে উপনিবেশ বানাতে বদ্ধপরিকর। উগ্র জাতীয়তাবাদী নিরাপত্তামন্ত্রী মুসলিম নারীদের বোরকা ও নিকাব নিষিদ্ধ করেছেন, মাদ্রাসা বন্ধ করে দিচ্ছেন, যখন কিনা শ্রীলঙ্কা মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন আশা করছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ শ্রীলঙ্কাকে গ্রাস করছে। এ পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কা সরকার গৃহযুদ্ধের নৃশংসতার ঐতিহ্য থেকে বেরোতে পারবে না। সে কারণেই জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার উচিত হবে সমস্যাটি থেকে দৃষ্টি না সরানো।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, ফরেন পলিসি থেকে নেওয়া

নিল ডেভোটা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েক ফরেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সুমিত গাঙ্গুলি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ফরেন পলিসি পত্রিকার কলাম লেখক