মতামত

শ্রীলঙ্কাকে বাঁচাতে গোতাবায়াকে সরাতেই হবে

গোতাবায়া রাজাপক্ষে
গোতাবায়া রাজাপক্ষে

নববর্ষের প্রথম দিন যখন শ্রীলঙ্কার মানুষের উৎসবমুখর পরিবেশে স্বজনদের সঙ্গে বসে ভালো ভালো খাবার খাওয়ার কথা, তখন তাদের খাবারের দাবিতে কলম্বোয় প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে বিক্ষোভ করতে হয়েছে। জ্বালানি তেলের অভাবে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অনেকে গ্রামে থাকা আত্মীয়স্বজনের কাছে যেতে পারেনি। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষকে চরম অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আর এর জন্য তাদের সব ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে গোতাবায়া রাজাপক্ষের ওপর। প্রায় দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কার শাসনক্ষমতা নিজেদের মুঠোয় রাখা রাজাপক্ষে পরিবারের শাসনের অবসান চাইছে শ্রীলঙ্কার মানুষ। রাজপথে স্লোগান তোলা হচ্ছে ‘গোতা গো হোম’।

২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে আত্মঘাতী হামলায় আড়াই শ লোকের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা যে ধাক্কা খেয়েছিল, তা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই করোনা মহামারি শুরু হয়েছিল। এটি দেশটিকে আরেকটি ধাক্কা দেয়। করোনার কারণে পর্যটক আসা এবং পণ্যের আমদানি–রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মহামারি কেটে গিয়ে যখন পরিস্থিতি একটি ভালোর দিকে যাচ্ছিল, তখনই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এর অভিঘাত এসে পড়ে শ্রীলঙ্কায়। এখন বিদ্যুৎ–বিভ্রাট, ওষুধের ঘাটতি এবং নিত্যপণ্যের অনুপস্থিতি দেশটিতে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজাপক্ষে প্রশাসনের দুর্নীতি, জাতীয়তাবাদ এবং কর্তৃত্ববাদের কথা সুবিদিত ও প্রমাণিত। দেশটির আড়াই দশকের বেসামরিক শাসনামলে তামিল জনগোষ্ঠীর ওপর রাজাপক্ষের যুদ্ধাপরাধের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের তদন্ত ক্রমাগত খারিজ করা হয়েছে। আর এখন সাধারণ শ্রীলঙ্কানরা যখন অনাহারে কাতরাচ্ছে, যখন অভিজাতরা মোটা হচ্ছে। এ কারণে সাধারণ মানুষের মনে হচ্ছে, অনেক হয়েছে। এই শাসনের পতন ঘটাতে হবে।

এটি ঠিক, উপরিউক্ত বিষয়গুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু আসল বিষয় হলো, এই দুর্দশার মূল উৎস হলো অপশাসন। ট্যাক্স কমানো, অযৌক্তিক সরকারি ব্যয়, অস্বাভাবিক ব্যাংক নোট ছাপানো, গুরুত্বপূর্ণ পদে ক্ষমতাসীনদের স্বজনদের বসানো আজকের এই পরিণতির মূলে আছে। এ কারণেই দেশটির কোমর ভেঙে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে সহায়তা পেতে যেসব শর্ত পূরণ করতে বলা হয়েছিল, সেসব শর্ত শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করে গোতাবায়া মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। ফল হিসেবে শ্রীলঙ্কা এখন ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ খেলাপি।

তবে এ অবস্থা এক দিনে নয়, বরং গত কয়েক বছরে তলেতলে তৈরি হয়েছে। রাজাপক্ষে প্রশাসনের দুর্নীতি, জাতীয়তাবাদ এবং কর্তৃত্ববাদের কথা সুবিদিত ও প্রমাণিত। দেশটির আড়াই দশকের বেসামরিক শাসনামলে তামিল জনগোষ্ঠীর ওপর রাজাপক্ষের যুদ্ধাপরাধের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের তদন্ত ক্রমাগত খারিজ করা হয়েছে। আর এখন সাধারণ শ্রীলঙ্কানরা যখন অনাহারে কাতরাচ্ছে, যখন অভিজাতরা মোটা হচ্ছে। এ কারণে সাধারণ মানুষের মনে হচ্ছে, অনেক হয়েছে। এই শাসনের পতন ঘটাতে হবে। প্রশ্ন হলো, সেই পতন কীভাবে ঘটাতে হবে।

শ্রীলঙ্কার নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি (যিনি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও সদ্য পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের ভাই বাসিল রাজাপক্ষের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন) সম্প্রতি ওয়াশিংটনে এসেছিলেন। তিনি আইএমএফের সঙ্গে আর্থিক ঝামেলা মিটিয়ে পুনরায় একটি মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। আইএমএফ আলি সাবরিকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, শ্রীলঙ্কা নতুন করে ঋণ পেতে চাইলে দেশটিতে অবশ্যই একটি স্থিতিশীল সরকার থাকতে হবে, যা এই মুহূর্তে সেখানে নেই। যদি বিরোধী দলগুলো বা প্রতিবাদকারীরা সরকারকে বিশ্বাস না করে, তাহলে বিক্ষোভ কেবলই ফুলেফেঁপে উঠতে থাকবে। সে পরিস্থিতিতে আইএমএফ ঋণ দিতে পারে না।

আইএমএফ প্রকাশ্যে রাজাপক্ষের শাসনের নিন্দা করতে পারে না। তারা সৃজনশীলভাবে তাদের উদ্বেগের কথা জানাতে পারে। যেকোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, সুশাসন ও স্বাধীন কমিশন এবং তদারকি কমিটির মতো ভারসাম্য নিশ্চিত করা কর্তৃপক্ষ থাকা অনস্বীকার্য—এটি আইএমএফ জানিয়ে দিয়েছে। আইএমএফ যখন অর্থমন্ত্রী সাবরিকে এই গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, তখন শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভরত হাজার হাজার মানুষ সে বার্তার অর্থ বুঝতে পারে। তারা বুঝতে পারে আইএমএফ সরকার পরিবর্তন করে সেখানে একটি স্বচ্ছ সরকার দেখতে চায়।

শ্রীলঙ্কায় গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিরোধিতার এই ব্যাপকতা অস্বাভাবিক। কারণ দুই বছরের কম সময় আগে তিনি পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এখন প্রতিবাদকারীদের মধ্যে তৃণমূল থেকে সমাজের উচ্চ স্তরের মানুষকে দেখা যাচ্ছে। সিংহলি, তামিল এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে বিক্ষোভে শামিল হতে দেখা যাচ্ছে।

সংবিধান অনুসারে রাজাপক্ষে পদত্যাগ না করলে ২০২৩ সালের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে তাঁকে অভিশংসনের মাধ্যমে অপসারণ করা যেতে পারে। কিন্তু সেটি সময়সাপেক্ষ। সে কারণে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মাধ্যমে রাজাপক্ষেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করতে হবে। এটি করা গেলে পার্লামেন্ট দ্রুত তার অন্তর্বর্তী উত্তরসূরি নিয়োগ করতে পারবে, আইএমএফ চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে এবং দ্রুত নির্বাচন দেওয়া সম্ভব হবে। এ অবস্থায় আমরা শুধু আশা করতে পারি, বিরোধীরা তাদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা সরিয়ে রেখে লাগাতার আন্দোলনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার আনবে এবং আইএমএফ ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতা করার সুযোগ তৈরি করে দেবে।

নিউজ উইক থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ড. পাকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভস-এর নির্বাহী পরিচালক