শ্রমিকেরা আক্রান্ত হলে ভয়াবহ বিপর্যয়

যখন প্রায় সারা দুনিয়াতে লকডাউন আর বাইরের যোগাযোগ বন্ধ, তাহলে সব কারখানা খোলা রাখতে হবে কেন? আমরা কি অপেক্ষা করব পোশাকশ্রমিকদের মধ্যে এর সংক্রমণ ঘটা পর্যন্ত? আর তখন কীভাবে সেটি সামাল দেওয়া হবে? এত দিন পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বলছিল যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটেনি। কিন্তু এখন তো পরিষ্কার, কোনো প্রবাসীর সংস্পর্শে না গিয়েই মারা গেছেন অন্তত একজন। ‘প্রবাসী তত্ত্ব’ এখন অনেকটাই দূরে সরে যাচ্ছে। কোনোভাবে করোনা কোনো শ্রমিকের শরীরে ছড়িয়ে পড়লে সেটি দিনেই হাজার শ্রমিকে পৌঁছে যাবে। বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকেরা এসেছেন বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রাম থেকে। সেখানেও ছড়িয়ে যাবে মুহূর্তের মধ্যে।

করোনার ছোবলে বিশ্বের প্রায় সবকিছু অচল হয়ে পড়লেও চালু আছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত। সে সময়ে নতুন অর্ডার আসা ও ডেলিভারির সুযোগ সীমিত। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১ হাজার ৮৯টি কারখানার ৮৭ কোটি ৩২ লাখ ৩৬ হাজার ৬২২টি অর্ডার বাতিল হয়েছে। যার আর্থিক পরিমাণ ১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এসব কারখানার মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১২ লাখ। সব ধরনের নিরাপত্তার দিক থেকেই সবচেয়ে নাজুক এই শ্রমিকদের জীবন বাঁচানোর প্রশ্নে দেশের সব গার্মেন্টস কারখানা বন্ধের দাবি তুলেছেন শ্রমিকনেতারাসহ অনেকেই।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খাত এই গার্মেন্টস সেক্টরে রয়েছে প্রায় ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক এবং এর ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভর করে প্রায় ২ দশমিক ৫ কোটি মানুষ। পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি বলছেন, ‘আমরা গার্মেন্টস চালু রাখার পক্ষে। তবে যেভাবে প্রতিদিন অর্ডার বাতিল হচ্ছে, এ ছাড়া আমদানি কাঁচামাল-সংকট, তাতে গার্মেন্টস চালু রাখাই কষ্টকর।’ তাঁরা মনে করছেন, গার্মেন্টস বন্ধ হলে বেতন-বোনাস নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের পাশাপাশি সমাজে একধরনের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এখন কথা হলো এই লাভ-ক্ষতির হিসাব দিয়ে কি এত শ্রমিকের জীবন মাপা হবে?

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যদি অনেক দেরি করে ফেলি, তাহলে বরং দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের এই পোশাকখাতই অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। করোনা-উত্তর নতুন বাস্তবতায় আমরা কি চাইব একটা অসুস্থ, ধুঁকতে থাকা শ্রমিকশ্রেণি, নাকি সুস্থ-সবল শ্রমিক, যাঁরা শুধু দেশের চাহিদা নয়, করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত বাকি দুনিয়ার জন্য পোশাকের জোগান দেবেন?

করোনা সংক্রমণের মাত্র কয়েক সপ্তাহের এই বিপদের দিনে যদি আমরা মুনাফার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। প্রার্থীদের টাকা নষ্ট হবে বলে এই সংকটময় সময়ে হয়েছে নির্বাচন। এখন এই মুনাফার কথা ভেবে পোশাকশ্রমিকদের ছুটি দিচ্ছি না। দীর্ঘ মেয়াদে লাভের কথাও যদি ভাবি তাহলেও এই মুহূর্তে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার বিকল্প নেই। এ সময় শ্রমিকদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা এবং তা সরাসরি শ্রমিকদের কাছে পৌঁছার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

এই কঠিন সময়ে এই খাতে বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারের প্রণোদনা প্রদানও আবশ্যক। তবে শ্রমিকদের কাছে সরাসরি বেতন-ভাতা পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত আর এই প্রণোদনা প্রদান সমন্বিতভাবে বিবেচনায় নেওয়া বাঞ্ছনীয়। এ সময় ‘কারখানা খুললে দেব, পরে দেব’-জাতীয় কথা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

করোনা-উত্তর বিশ্ব নতুন অর্থনৈতিক চিন্তা দাবি করে। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যবস্থায় ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসন্ন বলেই মনে হয়। গত শতকের ৭০ ও ৮০-র দশকের নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ এবং তার পরবর্তী বিশ্বায়নের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ ইউরোপের বহু দেশ তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং খাত অনেকাংশে ধ্বংস করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তা অনেকাংশে সত্য। চীনসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে ব্যাপক মাত্রায় ম্যানুফ্যাকচারিং স্থানান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশে শিল্পায়নের জোরদার কোনো ভিত্তি না দাঁড়ালেও আমরা ওই ব্যবস্থার অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়েছি মূলত তৈরি পোশাক খাত এবং প্রবাসী শ্রমিকদের অবদানের কারণে। মোটাদাগে দেখা যাচ্ছে যে করোনা প্রতিরোধে চীন নেতৃত্ব দিয়ে এখন করোনা-উত্তর বিশ্বের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে চীন। আক্রান্ত বিভিন্ন দেশে সহায়তা পাঠানোর মাধ্যমে নৈতিক-রাজনৈতিক দিক থেকেও দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে। যে সময়ে পশ্চিমা বিশ্ব লড়াই করবে করোনার ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য, তখন চীন ও আরও কয়েকটি রাষ্ট্র সারা দুনিয়াকেই জোগান দেবে আবশ্যকীয় নানা দ্রব্য। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থানটা ঠিক কোথায় হবে?

আমরা আমাদের প্রবাসীদের অপমান করছি। পোশাকশ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নতুন কোনো আশা কি তৈরি হচ্ছে আমাদের জন্য? হলে সেটা কোন পথে? নিশ্চয়ই স্বল্পমেয়াদি লাভের আশায় দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে নয়।

করোনা সংক্রমণে অল্প বা মধ্যবয়সীদের মধ্যে মৃত্যুহার কম বলে যাঁরা ভাবছেন, পোশাকশ্রমিকদের ওপর করোনার থাবা তীব্র হবে না, তাঁরা গুরুতর ভ্রান্তির মধ্যে বসবাস করছেন। এই ভাবনা অত্যন্ত অমানবিকও বটে। একে তো যেকোনো বয়সী মানুষ এই সংক্রমণে মারা যেতে পারে, অন্যদিকে, পোশাকশ্রমিকদের পরিবারে শিশু থেকে বৃদ্ধ নানা বয়সী মানুষ আছেন। কর্মক্ষেত্রে একজন পোশাকশ্রমিকের মধ্যে সংক্রমণ হওয়ার মানে তার গোটা পরিবারকেও বিপন্ন করা। করোনা সংকট-উত্তর বিনিয়োগের পরিকল্পনা কি আমাদের আছে? সেখানে এ দেশের পোশাকশিল্পের চেহারাটা কী হবে? পোশাকশ্রমিকের অবস্থানই-বা সেখানে কী হবে?

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই কঠিন সময়ে আমাদের দরকার জাতীয় ঐক্য। পোশাকশ্রমিক ও অন্য শ্রমজীবী মানুষদের বাদ দিয়ে সেই ঐক্য হতে পারে না।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com