তিন মাস ধরে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বলছে, করোনা মহামারি কেড়ে নেবে ১৬০ কোটি মানুষের চাকরি। তবে এত দিন ধরে গৌরব করা এবং বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় গার্মেন্টস খাতের মূল কারিগর শ্রমিকেরা তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি শুনেছে মাত্র দুদিন আগে। গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, এই বৈশ্বিক মহামারির নেতিবাচক প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সর্ববৃহৎ খাত গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে আনুষ্ঠানিক শ্রমিক ছাঁটাই চলতি জুন মাসেই শুরু হবে। তিনি আরও বলেছেন, শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। বলেছেন, চাহিদা না থাকায় ৫৫ ভাগ সক্ষমতায় কারখানাগুলো বর্তমানে চলছে।
চার দশকে প্রতিষ্ঠিত দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাতের এই ধরনের শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণা আদতে এটি জানান দিয়েছে যে এই ছাঁটাই কয়েক লাখ ছাড়াবে। তবে ঘোষণার আগেই গত দুই মাসে দুই লাখ শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে বলেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে এবং বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকেরা এই করোনার অঘোষিত লকডাউনেও রাজপথে ছিলেন।
রুবানা হক আরও কারণ দেখিয়েছেন। দেশের সাড়ে তিন হাজারের মতো গার্মেন্টস কারখানার মধ্যে এক হাজারের বেশি কারখানায় কোনো কাজ না থাকায় সেগুলো কার্যত বন্ধ রয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিও আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। চার দশকের মধ্যে এতটা সংকট গার্মেন্টস খাত আর কখনোই দেখেনি। এবার আসি তাহলে এই তিন মাসে আমরা আসলে গার্মেন্টস খাতে কী কী দেখেছি? সাধারণ ছুটিতেও গার্মেন্টস যখন খোলা ছিল, তখন হঠাৎ ১০ দিনের জন্য বন্ধ বললেন। আবার তিন-চার দিন পর থেকে বিভিন্ন মালিকের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের আসার জন্য খুদে বার্তা পাঠানো হলো। এই দুর্দিনে শ্রমিকেরা সুদীর্ঘ পথ হেঁটে কাজে যোগ দিতে এলেন। কেন? কারণ তাঁরা জানেন, তাঁরা না এলে তাঁরা ছাঁটাই হবেন। আসার পর আবারও ঘোষণা হলো বন্ধের। সেই শ্রমিকেরা তখন কী করবেন? আবারও শুরু হলো ফিরে যাওয়া অথবা বকেয়া বেতন পাওয়ার দাবিতে আন্দোলনের ময়দানে।
এপ্রিলের শেষ থেকেই খুলল গার্মেন্টস। অনেক মালিক বললেন, শ্রমিকরাই চাচ্ছেন গার্মেন্টস খোলা থাকুক। হ্যাঁ, তারা চেয়েছেন, কারণ তাঁদের ছাঁটাইয়ের ভয় তখন থেকেই যে তৈরি হয়েছিল।
এখন কথা হলো, যে চার দশকের মেহনতে এই শিল্প বাংলাদেশের মেরুদণ্ড হয়ে উঠেছে, সেই কারিগরদের ছাঁটাইয়ের ঘোষণা নৈতিকভাবে কি এত সহজ? না মানলেও জানি, মালিক-শ্রমিকের ক্ষমতা সম্পর্ক অনেক কিছুই করা যায়, কিন্তু এই চার দশকে এই বাংলাদেশেই শ্রমিকের শ্রমের ইতিহাস এক দিনের একটি ঘোষণায় গায়েব করার শক্তি কোনো মালিকের কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়।
গার্মেন্টস ব্যবসার এই দুর্দিনে মালিকেরা যদি শ্রমিক ছাঁটাই করা ছাড়া অন্য কোনো পথ খুঁজে না পান, তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, গার্মেন্টস ব্যবসার লাভের অংশীদারত্ব কি কোনো শ্রমিক পেয়েছেন? বরং উল্টোটিই বেশি ঘটেছে। শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতনের জন্যও আন্দোলনে নামতে হয়। এর বাইরে আছে রানা প্লাজা ধসসহ বিভিন্ন ধরনের অনিরাপত্তার খানাখন্দ। একটি বিনীত জিজ্ঞাসা, একটি ঘোষণা দিয়ে ছাঁটাই চললেই কি সেটি নৈতিক হয়ে যাবে? শ্রমিকেরা প্রতিবছর এই খাতে তাঁদের সর্বোচ্চ শ্রম দিয়েছেন, তাহলে এই ছাঁটাইকালে তাঁদের যদি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকও করা হয়, তাহলে তাঁদের কত করে টাকা দেওয়া হবে, সেটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। বলে রাখা প্রয়োজন, এগুলো ছাড়া কোনো ছাঁটাই একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
বিজিএমইএর সভাপতির তথ্য অনুযায়ী ৫ জুন পর্যন্ত ২৬৪ জন শ্রমিক করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, যে তুলনায় শ্রমিকদের করোনায় সংক্রমিত হওয়ার কথা ছিল, সংখ্যাটি কিন্তু সেই তুলনায় খুবই কম। কারণ গরিব মানুষের একধরনের শক্তি থাকে। তাঁরা লড়তে জানেন। তাঁরা সচেতন এবং তাঁরা অসুস্থ হবেন না বলেই ধরে নেন। সেই শক্তি নিয়েই তাঁরা কাজ করেন।
করোনা মোকাবিলায় গরিবি শক্তির বাহবা করছেন তিনি। অথচ লাখ লাখ শ্রমিকের এই শক্তি এই খাতে আর কোনো কাজে লাগবে না বলেও তিনি বলতে চাইছেন। তিনি আরও বলেছেন, যদি এই খাতে সুদিন ফিরে আসে তাহলে এই ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের কাজে নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সেটিও কোনো বাড়তি সুযোগ নয়, বরং এই অভিজ্ঞ শ্রমিকদের ছাড়া তাঁদের চলবে না। বিষয়টি এখন এমন হয়ে গেছে যে মালিক বললে এক্ষুনি কাজে আসতে হবে, আবার ছাঁটাই ও হয়ে যেতে পারেন, বেতন-বোনাস সবই বকেয়া থাকতে পারে। শ্রমিকেরা শ্রমদুনিয়ার সবচেয়ে বড় পুতুল।
শ্রমিক যদি ছাঁটাই করতেই হয় তাহলে তাকে কী কী প্রাপ্য দিতে হবে, সেই বিষয়ে আলোচনা হোক। তার আগে প্রথম আলাপ হতে পারে বিকল্প অনুসন্ধান নিয়ে। আমি বিশ্বাস করি, মালিক এবং সরকারের সদিচ্ছা থাকলে শ্রমিকদের গণছাঁটাইয়ের বিকল্প খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হবে না। আর সেটি না হলে তাঁকে তাঁর সব বাকি পাওনা পরিশোধ, এককালীন বেশ কিছু টাকা (এটা তাঁর শ্রমের কারণেই প্রাপ্য) কিংবা কর্মহীন অবস্থায় শ্রমিকদের মাসোহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোভাবেই সম্মানজনক উপায় ছাড়া কোনো শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না।
পৃথিবীজুড়ে শ্রমদুনিয়ায় একটা কথা খুব প্রচলিত। তা হলো, পেশাদারির বাইরেও মানবিক চেহারা দেখা এবং দেখানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: zobaidanasreen@gmail. com