৬ ডিসেম্বর ঘিরে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভিন্ন ভিন্ন নামে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে থাকে। কেউ স্বৈরাচার পতন দিবস, কেউবা গণতন্ত্র মুক্তি দিবস হিসেবে পালন করে। তবে এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি দিনটি পালন করে ভিন্ন আঙ্গিকে, ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে। জাতীয় পার্টি যদিও সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য অস্থায়ী সরকারের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল বলে দাবি করে। কিন্তু ইতিহাসের সত্যের স্বাক্ষর হলো, গণ-আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তারপরও তিনি সেনানিবাসের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে জিম্মি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে দুই দিন পর ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডা. মিলন হত্যার পর দেশের পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটে যে শেষ পর্যন্ত সেদিন অপরাহ্ণে সরকার দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং কয়েকটি শহরে কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়। কারফিউ ঘোষণার পরও আন্দোলন অব্যাহত থাকে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূরউদ্দীন খান যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সম্মিলিত আন্তর্জাতিক সামরিক বাহিনী ইরাকের সঙ্গে যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, সেই ‘অপারেশন মরু প্রান্তর’-এ নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাদলের সঙ্গে দেখা করতে সৌদি আরবে এক সরকারি সফরে ছিলেন।
সেনাপ্রধানের সৌদি আরব সফরের ঠিক আগে ২৫ নভেম্বর জেনারেল এরশাদ সেনা সদর দপ্তর কনফারেন্স হলে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ফরমেশন কমান্ডার ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকে বসেন। বৈঠকে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকা চলমান আন্দোলনের পক্ষে প্রকৃত গণমানুষের কোনো সমর্থন নেই। অস্ত্রধারী কিছু সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে দলগুলো দেশে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সংবিধান সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনে তিনি বল প্রয়োগ করতে দ্বিধা করবেন না। তাঁর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তিনি সামরিক বাহিনীর সহায়তা কামনা করেন। এরশাদের এই বক্তব্যের পর যেন কবরের নীরবতা নেমে আসে। কেউ কোনো কথা বলেন না। খানিক পর উপস্থিত জেনারেলদের মধ্যে দু-একজন সম্মতিসূচক ইঙ্গিত দিলেও উপস্থিত অধিকাংশ কর্মকর্তাই কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।
১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখলের পর সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করলেও এরশাদের ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ছলচাতুরী ইত্যাদি কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ভেতর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং এরশাদের প্রতি তাঁদের সহানুভূতি ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। ১ ডিসেম্বর জেনারেল নূরউদ্দীন খান সৌদি আরবের সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন এবং পরদিনই সেনাসদরের অফিসারদের নিয়ে এক জরুরি বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সব স্তরের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে তৎকালীন অর্ডন্যান্স কোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল আতা, আর্টিলারি কোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল আনোয়ার, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমতিয়াজ প্রমুখ সেনাপ্রধানকে বলেন, ‘স্যার, সেনাবাহিনী যেন কারও ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা না হয়। সেনাবাহিনীর সঠিক ও ইতিবাচক সিদ্ধান্তের ওপর এ দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সমগ্র জাতি সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে। আপনি সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ অফিসার, আমরাও আপনার সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি।’
জেনারেল নূরউদ্দীন কর্মকর্তাদের মনোভাব বুঝতে পেরে এ ব্যাপারে তাঁর নৈতিক সমর্থন রয়েছে জানিয়ে সেভাবেই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন বলে সবাইকে আশ্বাস দেন।
অপর দিকে তিন জোটের যুগপৎ আন্দোলনের ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দেশে সামরিক আইন জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে পারে বলে জনসাধারণের মনে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় এরশাদ জেনারেল সালামকে তাঁর বাসায় ডেকে পাঠান। জেনারেল সালাম সেনাপ্রধানকে জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে যান। বর্তমানের সেনাপ্রধানের বাসভবনটিতেই তখন এরশাদ থাকতেন। রাষ্ট্রপতি ভবনে এরশাদের মুখোমুখি হতেই এরশাদ জেনারেল সালামকে অনুরোধ করে বলেন, ‘দেশের ও আমার এই অবস্থায় আমার জন্য তোমরা একটা কিছু করো! আমি অনেক বছর ধরে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে অনেক কষ্ট করে সেনাবাহিনীকে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। আজ আমার এই দুর্দিনে সেই সেনাবাহিনী কি কিছুই করবে না?’ প্রত্যুত্তরে জেনারেল সালাম বলেন, ‘যে যত্ন করে আপনি সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলেছেন, আপনি কি চান আপনার কারণে সেই সেনাবাহিনী ভেঙে যাক?’ সিজিএসের কথা শুনে এরশাদ মনঃক্ষুণ্ন হন এবং ক্ষোভমিশ্রিত কণ্ঠে বলেন, ‘এই কি তোমাদের শেষ কথা?’ এরশাদের এ কথা শুনে জেনারেল সালামের বুঝতে সমস্যা হয় না যে এরশাদ হয়তো ইতিমধ্যে সেনাপ্রধানের কাছে অনুরূপ অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েই তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সুতরাং এরশাদের শেষ কথাটির উত্তরে তিনি হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন এবং এরশাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন। অতঃপর সেদিন রাত ১০টার বিটিভির ইংরেজি সংবাদে এরশাদের পদত্যাগের সংবাদ ঘোষণা করা হয়।
পদত্যাগের সংবাদে রাজপথে জনগণের ঢল নামে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীসহ সমাজের সব স্তরের মানুষ আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। ওদিকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েও এরশাদ চুপ করে বসে থাকেননি। রাষ্ট্রপতি ভবনের কারও চোখে ঘুম নেই। উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠায় প্রতিটি মুহূর্ত কেটে যাচ্ছে। রাত তিনটায় সেনাপ্রধান জেনারেল সালামকে ফোন করে জানান, প্রেসিডেন্ট তাঁকে ও জেনারেল সালামকে ডেকেছেন। তিনি রওনা হচ্ছেন, জেনারেল সালাম যেন দ্রুত রাষ্ট্রপতি ভবনে চলে আসেন। জেনারেল নূরউদ্দীন খান এবং জেনারেল সালাম রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে এরশাদ, রওশন এরশাদ ও সহকারী সামরিক সচিব লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল হককে দেখতে পান। ড্রয়িংরুমে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এরশাদ সেনাপ্রধান ও সিজিএসকে দেশব্যাপী সামরিক আইন জারি করতে অনুরোধ করেন। প্রত্যুত্তরে দেশের পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে ওই সময় সামরিক আইন জারি করা ঠিক হবে না বলে তাঁরা উভয়েই এরশাদকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এরশাদ তাঁদের কোনো কথায় কর্ণপাত না করে সামরিক আইন জারির পক্ষে জোর অনুরোধ করতে থাকেন। সেনাপ্রধান ও সিজিএস সামরিক আইন জারি করলে দেশ-বিদেশে, এমনকি সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে কী ধরনের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা উল্লেখ করে সামরিক আইন জারির জন্য আর অনুরোধ না করতে এরশাদকে বলেন। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব ও সহকারী সামরিক সচিবও এ সময় এরশাদকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এভাবে ঘণ্টাখানেক যুক্তিতর্কের পর একপর্যায়ে তাঁরা এরশাদকে নিবৃত্ত করতে সক্ষম হন এবং ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে আসেন। বাইরে তখন আরও এক ‘বিস্ময়’ অপেক্ষা করছিল। সেনাপ্রধান ও সিজিএস বাইরে বেরিয়ে এসে দেখেন, এরশাদের এক মন্ত্রী ও ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী নেতা বারান্দায় পায়চারি করছেন। তিনি সেনাপ্রধানকে কাছে ডেকে বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘নূরউদ্দীন ভাই, দেশে সামরিক আইন জারি করতে রাজি হয়ে যান, বাকি সব আমি সামলাব। এমনকি আন্তর্জাতিক সাহায্য, সহায়তা ও সমর্থনের ব্যবস্থাও আমি করব।’ এভাবে তিনি একবার জেনারেল নূরউদ্দীন খান আরেকবার জেনারেল সালামের দিকে তাকিয়ে সামরিক আইন জারির জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। সেনাপ্রধান ও সিজিএস তাঁর অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে দুঃখ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি ভবন ত্যাগ করেন।
৫ ডিসেম্বর। মেজর জেনারেল সালাম, মেজর জেনারেল মোক্তাদির ও তৎকালীন বাংলাদেশের টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার আমিন আহমেদ চৌধুরী (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল) সিজিএসের অফিসে বসে ছিলেন। সময় আনুমানিক সন্ধ্যা সাতটা। এমন সময় জেনারেল সালাম সেনাপ্রধানের টেলিফোন কল পেলেন। সেনাপ্রধান তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার জন্য এরশাদের কাছ থেকে জেনারেল সালাম কোনো টেলিফোন কল পেয়েছেন কি না। জেনারেল সালামের কাছ থেকে না-সূচক জবাব পাওয়ার পর সেনাপ্রধান জানালেন, এরশাদ তাঁকে রাষ্ট্রপতি ভবনে যেতে অনুরোধ করেছেন। সেনাপ্রধান জেনারেল সালামকে তাঁর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। জেনারেল সালামের সামনে বসা ব্রিগেডিয়ার আমিন তৎক্ষণাৎ সেনাপ্রধানসহ সিজিএসকে রাষ্ট্রপতি ভবনে যেতে নিষেধ করে বলেন, ‘আপনারা সেখানে গেলে কোনো বিপদ হতে পারে। আগে খোঁজ নিয়ে দেখেন, এরশাদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে আর কে কে আছেন।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাষ্ট্রপতি ভবনে গতকালের মন্ত্রী মহোদয়সহ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এবং সর্বশেষ অবসরে যাওয়া সাবেক সেনাপ্রধান অবস্থান করছেন। এতে জেনারেল সালামসহ উপস্থিত সবার বুঝতে সমস্যা হয় না যে সেনাপ্রধান ও সিজিএস একসঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে গেলে হয়তো কোনো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যেতে পারত এবং তঁাদের আটক করে ভূতপূর্ব সেনাপ্রধানের প্রভাব খাটিয়ে এরশাদ সেনাবাহিনীর মধ্যে দলাদলি ও কোন্দলের সৃষ্টি করে নিজ স্বার্থসিদ্ধির সুযোগ গ্রহণ করতেন। কিন্তু জেনারেল নূরউদ্দীন খান ও জেনারেল সালাম রাষ্ট্রপতি ভবনে না যাওয়ায় এরশাদের ক্ষমতা ধরে রাখার শেষ পরিকল্পনাটিও ভেস্তে গেল।
এ কে এম শামসুদ্দিন: সাবেক সেনা কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল