সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান হিসেবে মোশাররফের শেষ ইচ্ছায় বাধা হয়ে দাঁড়ানো পাকিস্তানে যে কারও পক্ষেই দুরূহ
সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান হিসেবে মোশাররফের শেষ ইচ্ছায় বাধা হয়ে দাঁড়ানো পাকিস্তানে যে কারও পক্ষেই দুরূহ

‘শেষ ইচ্ছা’ পূরণে জেনারেল এখন বাড়ি ফিরতে চান

ইতিহাস বেশ কৌতুকপ্রিয়। অনেকের কাছে অনেক সময় তাতে শামিল হওয়া কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে। যেমন ঘটছে এখন পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের জীবনে। সোনালি দিনগুলোতে এই চার তারকা জেনারেল নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এখন শরিফদের মুসলিম লিগ আবার সেখানে ক্ষমতায়। ঠিক তখনই মোশররফ নির্বাসন থেকে ‘দেশের মাটিতে ফিরে’ মৃত্যুর সুযোগ চাইছেন। এ রকম সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে কি না, এ নিয়ে পাকিস্তানে এ মুহূর্তে চলছে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক। যদিও সব মানুষের নিজ ভিটায় ফেরার অধিকারে বিশ্ব স্বীকৃতি আছে।

ক্ষমতার দিনগুলোতে মোশাররফ অন্তত চারবার চোরাগোপ্তা হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান। যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০০৩ সালের ডিসেম্বরের জোড়া আত্মঘাতী হামলা। কিন্তু এখন তিনি প্রকৃতই মৃত্যুর মুখোমুখি। দুরারোগ্য রোগে কাবু হয়ে পড়েছেন।

রাজনীতিবিদেরা যে যা ভাবছেন

২০১৬ থেকে দেশের বাইরে জেনারেল মোশাররফ। এখন তিনি দেশে আসতে চান। তাঁকে সেই সুযোগ দেওয়া হবে কি না এই আলোচনায় অংশ নিয়ে পাকিস্তানের সিনেট সদস্য জামায়াত নেতা মুস্তাক আহমেদের বক্তব্য উল্লেখ করার মতো। তিনি বলেন, মোশাররফকে যদি দেশে এসে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দেওয়া হয় তাহলে স্থানীয় সব কারাগারের দরজা খুলে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি আদালতগুলোও বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

তবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মুস্তাক আহমেদ সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধি নন। সিনেট আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা গেছে মুসলিম লিগ ও পিপলস্ পার্টি উভয়ে ক্ষমতাচ্যুত জেনারেলকে ফেরার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে। সিনেট বিতর্কে পিপিপির ইউসুফ রাজা গিলানির বক্তব্য ছিল খুবই করুণ। তিনি বলেন, পারভেজ মোশাররফের দেশ ছেড়ে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারেনি। তাঁর আসাও হয়তো কেউ ঠেকাতে পারবে না। গিলানির ইঙ্গিত স্পষ্ট। সেনাবাহিনী যে এখনো তাদের সাবেক এই ‘বস’র প্রতি সহানুভূতিশীল, সেটাই বোঝাচ্ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে বিচার শুরুর পর সেনা সহায়তাতেই দেশ ছাড়েন মোশাররফ। তবে তাঁর প্রতি সবচেয়ে বেশি ক্রোধ যাঁর থাকার কথা, সেই নওয়াজ শরিফও তাঁকে দেশে ফেরার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে এখন। এর কারণও সেনাবাহিনীর সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা। নওয়াজও লন্ডনের স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন। মোশাররফের জন্য নওয়াজ শরিফের সহানুভূতি তাই ইতিহাসের দিক থেকে কৌতুকময়। গিলানির বক্তব্যও তাই। পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় থাকার সময়ই পিপিপির নেত্রী বেনজির ভুট্টো রাজপথে নিহত হন। অথচ আজ এই দলকেও মোশাররফের প্রতি করুণা দেখাতে হচ্ছে। বেনজির ভুট্টোর বাবাকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছিলেন সেনাবাহিনীর আরেক প্রধান। কিন্তু সেসব বেদনার কথা ভুলেই রাজনীতি করতে হচ্ছে দলটিকে এখন।

পিপিপি এবং মুসলিম লিগ উভয়ে রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধী। কিন্তু তেমন হস্তক্ষেপের অন্যতম জনক মোশাররফের বিরুদ্ধে তারা আর কঠোর নেই। কথা ও কাজের এই ব্যবধানের কারণ বোঝা পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে মোটেই কঠিন কিছু নয়।

উপরন্তু বাড়তি প্রশ্ন হলো, দেশে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলে এই অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কবরস্থ করা হবে কি না? এ ক্ষেত্রে পুরোনো দৃষ্টান্ত বলছে, ইতিহাস মোশাররফের পক্ষে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নিষ্ঠুরতার জন্য হামুদুর রহমান কমিশন যখন ইয়াহিয়া খানকে বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করে, তখনো মৃত্যুর পর ওই জেনারেলকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই দাফন করা হয়।

অ্যামাইলয়েড জেনারেলকে কাবু করে ফেলেছে

এই লেখা যখন তৈরি হচ্ছে, তখন মোশাররফ আরব আমিরাতে আছেন। তবে তাঁর শরীর ভালো নেই। অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভালো কাজ করছে না। অ্যামাইলয়েডোসিস নামের বিরল এক রোগে ভুগছেন তিনি। যে রোগের মূল কারণ অ্যামাইলয়েড নামের অস্বাভাবিক এক প্রোটিন। এই প্রোটিন শরীরের শাখা-প্রশাখাকে স্বাভাবিক কাজ করতে দেয় না। যা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে টেনে নেয় রোগীকে। এই রোগ সারানোর নির্ভরযোগ্য উপায় আবিষ্কৃত হয়নি এখনো। তবে মোশাররফের দেহে নতুন একটা ওষুধের নিরীক্ষা চলছে। জেনারেল এখন চাইছেন জীবনের শেষ দিনগুলো পাকিস্তানে নিজ মাটিতে কাটাতে।

সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান হিসেবে মোশাররফের শেষ ইচ্ছায় বাধা হয়ে দাঁড়ানো পাকিস্তানে যে কারও পক্ষেই দুরূহ। তবে তাঁর ‘শেষ ইচ্ছা’ পুরো পাকিস্তানকে এই শতাব্দীর প্রথম বছরগুলোর দুঃসহ রাজনৈতিক বন্দিদশার দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়েছে আবার। মোশাররফের ফিরে আসার প্রধান প্রতিবন্ধকতা এখনো তিনিই। কারণ পাকিস্তানে তাঁর প্রত্যাশিত চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। আবার এমনও হতে পারে, হাতের কাছে পেয়ে জনতার ধিক্কারে পাত্র হতে পারেন তিনি। তবে পাকিস্তানের আইনে যেকোন নাগরিকের দেশে ফেরার অধিকার আছে।

দুঃশাসকদের দেশপ্রেম

মোশাররফ সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন ১৯৯৯-এ। আবার ২০০৭ সালে ক্ষমতায় টিকে থাকার মরিয়া চেষ্টায় জরুরি অবস্থা জারি করেন। আইনগত অনিয়মের জন্য ২০১৯ সালে আদালতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। তবে রায়ের সময় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। সেনাবাহিনীর অদৃশ্য ভূমিকায় ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার এড়িয়ে বিদেশে চলে যেতে পেরেছিলেন। পরে লাহোর হাইকোর্ট এই মর্মে মতামত দেয়, ইসলামি বিধান মতে, কারও অনুপস্থিতিতে এ রকম রায় দেওয়া যায় না। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা আছে। তবে সেই আবেদনের শুনানি হয়নি এখনো এবং সেই থেকে মোশাররফ আছেন বিদেশে। মাঝেমধ্যে টুইটারে কিছু লিখতেন তিনি। জীর্ণশীর্ণ শরীরের কিছু ছবিও তাঁর মাঝেমধ্যে প্রকাশ পেত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাঁর ‘উপস্থিতি’র শেষ অধ্যায় ছিল এ রকমই।

অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর শঙ্কার মুখে মোশাররফের দেশে ফেরার হাহাকার এবং শান্তিপূর্ণভাবে কবরস্থ হওয়ার আকুতি অনেককে দেশটির প্রথম সামরিক শাসক ইসকান্দার মির্জার কথাও মনে করিয়ে দিতে পারে। ইসকান্দার মির্জাকে দেশছাড়া করেছিলেন আইয়ুব খান। অথচ ইসকান্দার মির্জার হাতে তৈরি সেনাপ্রধান ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে লন্ডনে প্রায় কপর্দক শূন্য অবস্থায় মির্জা যখন মারা যান আইয়ুব খানও তখন করুণভাবে ক্ষমতাচ্যুত। মির্জার মৃত্যুর পর তাঁর লাশ দেশে ঢুকতে বাধা দিয়েছিলেন আইয়ুবের প্রিয়ভাজন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সেই ইয়াহিয়া খানেরও মৃত্যু হয় দীর্ঘ গৃহ বন্দিত্বের পরপর একাকী। তারও আগে চুয়াত্তরের এপ্রিলে আইয়ুবের মৃত্যু দিনে তখনকার নির্বাহী প্রধান ভুট্টো লাশের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যাননি। আর মির্জার লাশ নিজ দেশে নিয়ে দয়াপরবশ হয়ে কবরস্থ করেছিলেন যে ইরানি শাসক রেজা পাহলভী, তাঁরও মৃত্যুর পর দেশে সমাহিত হওয়ার সুযোগ হয়নি। জনরোষের মুখে কায়রোর আল-রিফাই মসজিদের পাশে শেষশয্যা পাততে হয় তাঁকে। মৃত্যুকালে তাঁর সংগ্রহে দেশের এক ব্যাগ মাটি পাওয়া যায়। দুঃশাসকদের এ রকম দেশপ্রেমের নজির ইতিহাসে আরও বেশ আছে। মোশাররফ অবশ্যই সেই তালিকায় শেষজন নন।

তারপরও পাকিস্তানের ‘ইতিহাস’ মোশাররফের পক্ষে

১৯৫১ সালের বামপন্থী অভ্যুত্থানটি ছাড়া পাকিস্তানে কোনো সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়নি। শেষ জীবনের করুণ পরিণত সত্ত্বেও সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় থাকাকালে সিংহের মতোই দাপটের সঙ্গে দেশ চালান। তবে বারবার নির্বাচিত সরকারও ফিরে এসেছে। পুরোনো দিনের দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দেশটিতে বন্দুক ও ভোটের শাসনের আসা-যাওয়া চলছে। তবে অভিনব এই চক্রের প্রায় স্থায়ী এক ফল সামরিক আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্বপনা। সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য কোন জেনারেলকে সাজা ভোগ করতে হয়নি, কারণ সেনাবাহিনী সেরকম কিছু দেখতে চায় না। মূলত সে কারণেই পিপিপি ও মুসলিম লিগ যৌথভাবে সরকারে থাকার পরও ৭৯ বছর বয়সী মোশাররফকে নির্দোষ হিসেবে দেশে ফেরায় সম্মতি দিতে হচ্ছে। অথচ তাঁর ৯ বছরের শাসনে পাকিস্তানে যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পেন্টাগনকে সহযোগিতার নামে নিজ দেশে ড্রোন হামলার দ্বার খুলে দিয়ে অসংখ্য বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হন তিনি। আবার একই সময় ওসামা বিন লাদেনকেও গোপনে আশ্রয় দিয়ে রেখেছিলেন।

বালুচিস্তানে এখনকার অসন্তোষের আগুনও নতুন করে উসকে উঠেছে মোশাররফ সরকার বালুচ নেতা নওয়াব আকবর বুগতিকে হত্যার পর। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানি স্টাবলিশমেন্টে তাঁর প্রতি দরদ আছে। তবে মোশাররফকে দেশে আসতে হলে তাঁর আইনজীবীকে আদালতে গিয়ে অনুমতি নিতে হবে। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিচার চলাকালে বহুদিন আদালতে হাজির হননি তিনি। তারও আগে একসময় দেশের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মুহাম্মদ চৌধুরীকে চাকরিচ্যুত এবং গৃহবন্দী করার দম্ভও দেখিয়েছিলেন, যা ছিল পাকিস্তানের ৬০ বছরের ইতিহাসে অভিনব। কিন্তু এখন ইতিহাস নতুন বার্তা নিয়ে হাজির। আইনজীবীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় বিবৃতির পরই কেবল আদালত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইঙ্গিতে স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে ফিরতে চাওয়া জেনারেলকে দেশে প্রবেশের সুযোগ দেবে। বিষয়টি অবশ্যই আইনের শাসনের জন্য পাকিস্তানে একটা খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে চিরকালের জন্য।

উপরন্তু বাড়তি প্রশ্ন হলো, দেশে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলে এই অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কবরস্থ করা হবে কি না? এ ক্ষেত্রে পুরোনো দৃষ্টান্ত বলছে, ইতিহাস মোশাররফের পক্ষে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নিষ্ঠুরতার জন্য হামুদুর রহমান কমিশন যখন ইয়াহিয়া খানকে বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করে, তখনো মৃত্যুর পর ওই জেনারেলকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই দাফন করা হয়।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক