তালেবান মুক্তিযোদ্ধা না বর্বর, সেই তর্ক থাক। ইতিহাসে জনজাতির হাতে বড় বড় সাম্রাজ্যের পরাজয় দেখা যায়। চীন-পারস্য-ইরাক এবং পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার একাংশ দখল করে নিয়েছিল যাযাবর মোঙ্গলেরা। রোমান সাম্রাজ্যের মরণ কামড় এসেছিল হুন-ভ্যান্ডালদের থেকে। আরব বেদুইন কিংবা রুশ নিম্নবর্গীয় জনতা উড়িয়ে দিয়েছিল রাজতন্ত্রকে। বাইজানটাইন সাম্রাজ্যকে উচ্ছেদ করেছিল যাযাবর তুর্কিরা। তেমন করে ভিয়েতনামের পরে পৃথিবী আবারও দেখল স্থানীয় প্রতিরোধে কীভাবে দখলদারের পতন ঘটে। বিমানে করে আসা সভ্যতার দেমাগ বিমানে করেই পালাল। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরানোর ঘোষণা দেওয়ার সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘সকলেই ক্লান্ত, আমরাও ক্লান্ত’। সাম্রাজ্য সত্যিই বড় ক্লান্ত। আফগানিস্তানে দেখা গেল ক্লান্ত পশ্চিমা সাম্রাজ্যের সেই শেষের শুরুয়াৎ।
ওদিকে নতুনের শুরু হচ্ছে সাংহাইতে। তালেবানরা ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই রুশ নিরাপত্তা পরিষদের সচিব নিকোলাইভ পাত্রুশেভ ইরানি নিরাপত্তাকর্তা অ্যাডমিরাল আলী শামখানিকে ফোন করেন। পাত্রুশেভ ক্রেমলিনের পলিটব্যুরোর প্রবীণ সদস্য। তাঁরা আফগানিস্তান, সিরিয়াও উপসাগরীয় এলাকা নিয়ে আলাপ করেন। মুহূর্তটা ঐতিহাসিক। ওই সময়ই রাশিয়া ইরানকেও চীন-রাশিয়ার সহযোগিতা জোট সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) পূর্ণ সদস্য করার প্রস্তাব দেয়। পাশাপাশি আফগানিস্তানকেও ডাকা হবে বলে তিনি জানান। চীন-রাশিয়া মূল শক্তি হলেও ভারত-পাকিস্তানও এর সদস্য। (যদিও ভারত আমেরিকার নেতৃত্বাধীন কোয়াডেই বেশি স্বচ্ছন্দ)। ইরান-আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার ‘স্তান’ রাষ্ট্রগুলোকে এসসিও হয়ে উঠবে ন্যাটোর বিপরীতে ইউরোশিয়ান ন্যাটো। এটাই হয়ে উঠছে ইউরোশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ)।
রাশিয়া ও চীন ইরানকে নিয়ে যে ত্রিফলা শক্তি তৈরি করছে, তাদের উদ্দেশ্য আফগানিস্তানকে স্থিতিশীল রাখা, যাতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড ওয়ে প্রকল্প চালিয়ে নেওয়া যায়। রাশিয়া চায় তার প্রতিবেশী উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমিনিস্তান যাতে তালেবান মতাদর্শ না ছড়ায়। তালেবানও এখন মনে হয় শান্তির বিনিময়ে আন্তর্জাতিক বৈধতা খরিদ করতে ইচ্ছুক। মধ্য এশিয়ায় যাতে আমেরিকা আর ঘাঁটি চালাতে না পারে, সেটাই এখন তাদের সবার চাওয়া।
নতুন চীনা বিশ্বায়নের এই যাত্রায় আফগানিস্তান এক বিরাট জংশন হয়ে উঠতে পারে। চীন-রাশিয়া-ভারত-পাকিস্তান-ইরান-তুরস্কের মাঝখানের এই দেশের শান্তি ও উন্নয়ন বিশ্বের শান্তি ও উন্নয়নেরও শর্ত। ন্যাটো জোটের পরাজয়েরও সেটাই কারণ। তারা দেশটাকে সামরিক দখলদারি বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কৌমভিত্তিক, রক্ষণশীল, অভাবী আফগানদের সামনে নতুন ভবিষ্যৎ তারা দেখাতে পারেনি; যে ভবিষ্যতের টোপে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে ২০০ বছর আটকে রেখেছিল। ব্রিটিশদের কায়দায় সেই অর্থনৈতিক টোপ নিয়ে হাজির চীন। আর স্থিতিশীলতা ও ক্ষমতা টেকাতে তালেবানরাও আপাতত বহুপক্ষীয় সরকার ও মধ্যপন্থী শাসন চালাতে রাজি। এই কৌশলের কাছেই পরাজিত হয়েছে ন্যাটো।
বিনা রক্তপাতে কাবুল বিজয়ের রহস্য এখানেই। কাবুল থেকে কান্দাহারে, দিগন্তে তালেবান ক্যারাভান দেখা দেওয়ার আগেই সক্রিয় হয় ভেতরের তালেবান। গোয়েন্দা পরিভাষায় এদের বলা হয় ‘স্লিপিং সেল’। আর তাতেই হতবাক হয়ে গিয়েছিল কাবুলের গনি সরকার ও ন্যাটো উপদেষ্টারা। অবাক হতে হলে বোকাও হতে হয়। এটাই ন্যাটো ও তাদের পুতুল সরকারের গোয়েন্দা-ব্যর্থতা। এত টাকা এত সরঞ্জাম এত প্রশিক্ষণ কোনোই কাজে এল না। কারণ, দখলদারি শাসন বেশি দিন টেকে না।
২০০১ সালে তালেবান যুদ্ধেও হেরেছে, গল্প বানানোতেও হেরেছে। ২০২১ সালে সমর ও সোশ্যাল মিডিয়া—দুই জায়গাতেই তাদের জিৎ। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, সিগন্যাল ব্যবহার করে নিজেদের তারা দেশপ্রেমিক হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রচার দিয়েছে। অন্তত আফগানদের বড় অংশকে বিশ্বাস করিয়েছে, পশ্চিমারা দখলদার, তাদের দেশীয় মিত্ররা রাজাকার।
তালেবানের গোপন অস্ত্র চোরাচালান নয়। তাদের গোপন অস্ত্রের নাম ‘নিরাপত্তা’। প্রভাবিত অঞ্চলে তারা ছায়া সরকার চালাত। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি নির্মাণ প্রকল্পকে সেই ছায়া সরকারের কাছে নিরাপত্তা-খাজনা দিতে হতো। টাকা দাও, নিরাপদ থাকো।
অথচ পশ্চিমা গণমাধ্যম বলে গেছে, পপি চাষ, হেরোইন পাচার থেকে টাকা বানাত তালেবান। তবে ২০০৯ সালের জাতিসংঘের ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম দপ্তরের রিপোর্ট বলছে, ১০-১৫ শতাংশ ছিল ড্রাগ মানি। যুদ্ধকালে নিরাপত্তার বিনিময়ে অর্থ সংগ্রহের এই কৌশল আন্তর্জাতিক স্তরেও সফল। প্রতিবেশীদের বার্তা দেওয়া হয়েছে, আমাদের সাহায্য করলে তোমাদের নিরাপত্তা আমরা দেখব। এর অনুবাদ করা যায় এভাবে যে তালেবান তো বটেই, আইএস কিংবা আল-কায়েদাও আফগান মাটি ব্যবহার করে যাতে বিদেশে হামলা চালাতে না পারে তা নিশ্চিত করার পথ ধরবে তালেবান। গত ২০ বছরে এই ভূরাজনীতিই শেখার কথা তালেবানের নতুন নেতৃত্বের।
তালেবান ১.০ ছিল পশতুন ছাত্রদের গ্রামীণ দল। তালেবান ২.০ ফেসবুক যুগের ‘স্মার্ট’ প্রজন্ম। ক্ষমতা গ্রহণের পর সাধারণ ক্ষমা, সবার অংশগ্রহণমূলক সরকার, সরকারে নারীর অংশগ্রহণমূলক যে বাণী তারা দিয়েছে, তা বাস্তব না হলেও চমকপ্রদই বটে। কিন্তু তাদের এসব প্রতিশ্রুতিতে কি বিশ্বাস করা যায়?
তালেবান একটা গেরিলা দল। কোনো দেশে সামরিক অভিযান করার সামর্থ্য তাদের নেই। প্রতিবেশীদের তাই এখন আর ভয় পাওয়ার কথা নয়। দেশের ভেতরে আগেরবারের মতো নারী নিপীড়ন, জনমত দমন, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করে আবারও আন্তর্জাতিক শোরগোল তোলার মতো আহাম্মকিও তারা করবে বলে মনে হয় না।
চীনও চাইবে না তালেবানি ঢেউ উইঘুর মুসলমানদের মধ্যে ছড়াক। সমাজতন্ত্র বিরোধিতা করতে গিয়ে সিআইএ ও পাকিস্তানের আইএসআই সৌদি অর্থায়নে যে তালেবান বানিয়েছিল, সেই যুক্তরাষ্ট্রও আর ওয়ার অন টেররের লাইনে নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিংবা বর্তমান ইমরান খানের সরকারও অভ্যন্তরীণ চরমপন্থীদের নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। নারীবিদ্বেষী চরমপন্থার মুরব্বি সাজার খায়েশ তাদেরও থাকার কথা নয়।
সামাজিক অধিকার কেবল বক্তৃতায় আসে না, বোমা ফেলেও গণতন্ত্রের বীজ রোপণ করা যায় না। তার জন্য চাই এমন অর্থনীতি, যা কোটি কোটি আফগানকে স্বাবলম্বী করবে, তারা আরও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখবে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি মানে মধ্যবিত্তের আকার বড় হওয়া এবং নিজেদের স্বার্থেই গণতান্ত্রিক পরিসর বাড়ার দাবি তোলা। ৪০ বছরের গৃহযুদ্ধে আফগানিস্তান সেই সুযোগ পায়নি। এশিয়াকেন্দ্রিক যে সামরিক-অর্থনৈতিক পালাবাদল চলছে, তাতে আফগানিস্তানের মতো গুরুত্বপূর্ণ মধ্যাঞ্চলকে চরমপন্থী দেখতে চাইবে না কেউই।
ইতিমধ্যে তুরস্কের এরদোয়ান পাকিস্তানের ইমরান খানের সঙ্গে নতুন পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেছেন। তালেবান প্রতিনিধিদল আগেই চীন সফর করে এসেছে। ট্রাম্প যেমন বলেছেন, তালেবানরাও ক্লান্ত। অনন্ত যুদ্ধ থেকে এখন তাদের ঘরে ফেরার সময়। দখলদার হটানোর পর জিহাদি জোশ স্তিমিত হয়ে আধুনিক দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধার দিকে তাদেরও মন যাবে। কিন্তু আমেরিকার কী হবে? আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরানো মানে অন্য কোনো দিকে নিশানা করা।
ইরান নিয়ে পরমাণু-সংকটের মীমাংসা যদি না হয়, ইরান যদি সামরিক পারমাণবিক বোমা বানাতে বদ্ধপরিকর হয়, তবে ইসরায়েল বলছে যুদ্ধ অনিবার্য। সাম্রাজ্যের পতনকালে নৈরাজ্য দেখা দেয়। বিশ্ব হয়তো আরও কিছুকাল নৈরাজ্যের মধ্য দিয়েই যাবে।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com