বৌদ্ধরা এক বৈশাখী পূর্ণিমা থেকে আরেক বৈশাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কালকে এক বুদ্ধবর্ষ হিসেবে হিসাব করে থাকেন
বৌদ্ধরা এক বৈশাখী পূর্ণিমা থেকে আরেক বৈশাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কালকে এক বুদ্ধবর্ষ হিসেবে হিসাব করে থাকেন

শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা: বুদ্ধভূমি মর্ত্যলোকে মানুষ বড় মহীয়ান

খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্ম। তিনি চিরদুঃখ মুক্তির সন্ধানে ২৯ বছর বয়সে গৃহবাস ত্যাগ করেন। সংসার ত্যাগের পর টানা ৬ বছর ধ্যান-সমাধির পর ৩৫ বছর বয়সে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। এরপর জীব ও জগতের কল্যাণে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তাঁর সাধনালব্ধ নৈর্বাণিক ধর্ম প্রচার করেন। গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের পরবর্তী সময়ে বুদ্ধবর্ষ গণনাকাল শুরু হয়। গৌতম বুদ্ধ আজ থেকে (২০২২ + ৬২৩-৮০) ২ হাজার ৫৬৫ বছর আগে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। অর্থাৎ বুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪৩ অব্দে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।

জন্ম, বুদ্ধত্ব এবং মহাপরিনির্বাণ লাভ—এই তিন অনন্য ঘটনা একই দিনে তথা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘটিত হয়েছিল বলেই বৈশাখী পূর্ণিমা বিশ্বময় বুদ্ধপূর্ণিমা নামে সর্বাধিক পরিচিত। বৌদ্ধরা এক বৈশাখী পূর্ণিমা থেকে আরেক বৈশাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কালকে এক বুদ্ধবর্ষ হিসেবে হিসাব করে থাকেন। এটি বিশ্বজুড়ে বৌদ্ধদের কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদার জাতীয় ধর্মীয় দিবস। জাতিসংঘ সদর দপ্তরেও দিবসটি পালিত হয়। বিশ্বের সব বৌদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশি বৌদ্ধরাও যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে এবং মর্যাদায় বুদ্ধপূর্ণিমা পালন করে থাকেন। বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে এক দিনের সরকারি ছুটিও রয়েছে।

বুদ্ধের মতে, একত্রিশ লোকভূমি নিয়ে একটি চক্রবাল হয়। চার দুর্গতিভূমি—অসুর, তির্যক, প্রেত ও নরক। সাত কামসুগতি ভূমি—পর নির্মিত বসবর্ত্তী, নির্মাণরতি, তুষিত, যাম, তাবতিংস, চতুর্মহারাজিক স্বর্গ ও মনুষ্যলোক। মনুষ্যলোক ও স্বর্গলোকে উৎপন্ন সত্ত্বগণের পঞ্চকামগুণ সেবন ইচ্ছা বলবতী হয়ে থাকে। তাই তারা পূর্বজন্মের কৃত পুণ্যানুসারে দিব্য পঞ্চকামসুখ ইচ্ছেমতো ভোগ করে থাকেন। এ জন্য মনুষ্য ও স্বর্গলোককে কামাবচর কামসুগতি ভূমি বলা হয়ে থাকে।

এখানে ছয়টি স্বর্গ এবং মনুষ্যলোক মিলে সাতটিকে কামসুগতি ভূমি বলা হয়। চার অরূপ ব্রহ্মলোক এবং ষোল রূপ ব্রহ্মলোক মিলে মোট বিশটি ব্রহ্মলোক। দুর্গতিভূমি, সুগতিভূমি এবং ব্রহ্মভূমি সব মিলে একত্রিশ লোকভূমি হয়। কেবল দুর্গতি তথা দুঃখ ভোগ করার জন্যই এই চার ভূমিতে জন্ম হয় বলেই এর নাম দুর্গতিভূমি। পূর্বজন্মের পুণ্যফলে কেবল স্বর্গীয় সুখ আর সুখ ভোগ করার জন্যই এই ছয় স্বর্গের উৎপন্ন হয় বলেই এর নাম সুগতিভূমি। চার অরূপ ব্রহ্মভূমিতে জন্মলাভও সুখের নয় বলা হয়েছে।

ষোলোটি ব্রহ্মভূমির মধ্যে পাঁচটি সুদ্ধাবাস ব্রহ্মভূমি ছাড়া অবশিষ্ট এগারোটি ব্রহ্মভূমিতেও ব্রহ্মসুখ ভোগ করার জন্যই সত্ত্বগণ নিজ নিজ কর্মফল অনুসারে এখানে উৎপন্ন হয়ে থাকেন। এই ষোলো ব্রহ্মভূমিই হচ্ছে ধ্যানভূমি। তবে পাঁচটি সুদ্ধাবাস ব্রহ্মভূমি হচ্ছে অনাগামী মার্গফল লাভী সত্ত্বগণের ভূমি।

বৌদ্ধদর্শন মতে, সংসারচক্রের এই জন্মান্তর প্রক্রিয়ায় জন্ম-জন্মান্তরে বুদ্ধ হওয়ার পারমী পূরণ, অনন্য ত্যাগ স্বীকার আর সাধনা কেবল মানবপুত্রই করে থাকেন। বুদ্ধ মনুষ্যজীবন তথা মানুষকে এত বড় করে দেখেছেন যে বুদ্ধের মতে, সব মানুষের মধ্যে ‘বোধি’ বা বুদ্ধত্ব লাভের হেতু নিহিত থাকে।

সুদ্ধাবাস ব্রহ্মভূমিতে উৎপন্ন সত্ত্বগণ ধ্যানবলে নির্বাণ লাভ করে থাকেন। বুদ্ধের মতে, মোট একত্রিশ লোকভূমির মধ্যে পাঁচটি সুদ্ধাবাস ব্রজভূমি তথা লোকভূমি ছাড়া অবশিষ্ট ছাব্বিশটি লোকভূমিতে সত্ত্বগণের জন্মান্তর হয়ে থাকে। যার অপর নাম চ্যুতি-বিচ্যুতি। সব তৃষ্ণা ক্ষয়ে নির্বাণ লাভ না করা অবধি এই ছাব্বিশটি লোকভূমিতে সত্ত্বগণের নিরন্তর যাওয়া-আসার নামান্তরই জন্মান্তর প্রক্রিয়া। এটিকে সংসারচক্রও বলা হয়ে থাকে। বুদ্ধ এই সংসারচক্রকে দুঃখময় বলেছেন। এই সংসারচক্রের মূলে রয়েছে তৃষ্ণা। তৃষ্ণার কারণে জন্ম। জন্ম হলেই জরা, ব্যাধি, মৃত্যু অনিবার্য। জন্ম, জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুর এই সংসারচক্রে অনন্ত দুঃখ ভোগের তুলনায় ক্ষণিক সুখ লাভকে বুদ্ধ বড় করে দেখেননি। তিনি এই চক্র থেকে বের হয়ে আসার জন্যই অতুলনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। এক চক্রবর্তী রাজার একমাত্র পুত্রসন্তান জাগতিক দুঃখ যাকে কোনো দিন স্পর্শ করতে পারেনি, তিনি কেন সংসার দুঃখময় বলে জানলেন?

তিনি আসলে সংসার আবর্ত, তথা জন্মান্তর প্রক্রিয়ার পুরো চক্রের কথাই বলেছেন। এই জন্মে নাহয় রাজপুত্র হলাম, রাজা হলাম, তারপর কী হবে! রাজপুত্র কিংবা রাজার জীবনেও তো জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু হানা দেবে! এভাবে চলতে দিতে পারা যায় না। এর চির নিবৃত্তি দরকার। এই চির নিবৃত্তি আসবে তৃষ্ণার মূলোৎপাটনের মধ্য দিয়ে। নিরন্তর বিদর্শন সাধনার মাধ্যমে যাবতীয় তৃষ্ণার নিবৃত্তিই হলো নির্বাণ। বাণের অপর নাম তৃষ্ণা। এই বাণ মুক্ত হওয়ার অবস্থাটাই মূলত নির্বাণ। তৃষ্ণার প্রজ্বলিত শিখা চিরতরে নিভে যাওয়া। বুদ্ধ জগতবাসীকে সে পথেরই সন্ধান দিয়েছেন।

সিদ্ধার্থ বোধিসত্ত্বের আবির্ভাব, বুদ্ধত্ব লাভ এবং মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্তির ঘটনা সবটাই এই মনুষ্যলোকে তথা মর্ত্যলোকেই সংঘটিত হয়েছিল। কারণ, বুদ্ধগণের আবির্ভাব কেবল মনুষ্যলোকেই ঘটে থাকে। দেবলোক কিংবা ব্রহ্মলোক অন্য কোনো ভূমিতে বুদ্ধের উৎপত্তি হয় না। তাই মনুষ্যভূমি হলো বুদ্ধভূমি। স্বর্গ ব্রহ্ম লোক, কিন্তু বুদ্ধভূমি নয়। যুগে যুগে জীব ও জগতের কল্যাণে যেসব বুদ্ধগণ আবির্ভূত হয়েছিলেন, হবেন তাঁরা সবাই এই মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতেও এখানেই উৎপন্ন হবেন। অন্য কোথাও নয়। আবার কেবল মানবপুত্রই বুদ্ধ হয়ে থাকেন। কোনো দেবপুত্র কিংবা ঈশ্বর প্রেরিত সত্ত্বের¦বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেই। কেবল মায়ের গর্ভজাত মানবপুত্রই বুদ্ধ হয়ে থাকেন।

বৌদ্ধদর্শন মতে, সংসারচক্রের এই জন্মান্তর প্রক্রিয়ায় জন্ম-জন্মান্তরে বুদ্ধ হওয়ার পারমী পূরণ, অনন্য ত্যাগ স্বীকার আর সাধনা কেবল মানবপুত্রই করে থাকেন। বুদ্ধ মনুষ্যজীবন তথা মানুষকে এত বড় করে দেখেছেন যে বুদ্ধের মতে, সব মানুষের মধ্যে ‘বোধি’ বা বুদ্ধত্ব লাভের হেতু নিহিত থাকে।

সেটাকে বিকশিত করে তোলার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। তাই বুদ্ধ বলেছেন, ‘আত্তদীপ বিহারতি’। অর্থাৎ আত্মদীপ হয়ে অবস্থান করো। নিজেই নিজের শরণ লও, নিজেই নিজের আশ্রয় গ্রহণ করো। দুঃখমুক্তির সাধনা নিজেকেই করতে হবে। যার জলন্ত প্রমাণ বুদ্ধ নিজেই। বৌদ্ধদর্শন মতে, সব লোকভূমির মধ্যে মনুষ্যভূমি হলো শ্রেষ্ঠ ভূমি এবং সব জীবনের মধ্যে মানবজীবন হলো শ্রেষ্ঠ জীবন। সোনা ফলা জীবন মানবজীবন। দুর্লভ জীবন হলো মানবজীবন। বুদ্ধ এক উপমা দিয়ে বলেছেন, ব্রহ্মলোক থেকে একটি সুতা নিচের দিকে ছুড়ে মারলে এবং মর্ত্যলোকের মাটিতে একটি সুই ফেলে রাখলে ওই সুতা মর্ত্যলোকের মাটিতে পড়ে থাকা সুইয়ের ছিদ্র দিয়ে ঢুকে যেতেও পারে, কিন্তু মানবজীবন একবার হারালে তা আবার ফিরে পাওয়া আরও দুষ্কর। আদৌ ফিরে পাওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। বুদ্ধ আবার এ-ও বলেছেন যে শুধু মানুষ হয়ে জন্ম নিলেই জীবনটা দুর্লভ হয়ে যায় না। জীবনটাকে দুর্লভ করে তুলতে পারলে তবেই মানবজীবন দুর্লভ জীবন হয়। চিনি আর লবণ দুটোর চেহারাই এক। কিন্তু স্বাদ আর মান এক নয়। সব সময় লোভ, হিংসা, মোহে আচ্ছন্ন জীবন প্রকৃত মানবজীবন হয়ে উঠতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষার সাধনা। জীবনে ত্যাগ থাকা চাই। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবনে পঞ্চশীলের অনুশীলন এবং প্রয়োগ ছাড়া প্রকৃত মানবজীবন গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব নয়। এটি কেবল নিছক ধর্মকথা নয়, একটি উচ্চমার্গীয় নৈতিকতাসম্পন্ন, বোধসম্পন্ন, সুখী, সমৃদ্ধ এবং শান্তিময় জীবনের বিধানও বটে। হিংসাহিংসি, হানাহানি, রক্তারক্তি, খুনোখুনি, ভেদাভেদ এবং পশুত্বকে ধারণ আর লালন করার জন্য এই মানবজীবন এবং মর্ত্যলোক নয়।

এখানে মাটি ভেদ করে বোধিবৃক্ষ গজায়, পদ্ম ফোটে, মানবীর গর্ভে বোধিসত্ত্ব জন্মায়, মানবপুত্র বুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তাঁর মৈত্রী-করুণায় মর্ত্যলোক ভেসে যায়। মানুষ পায় অমৃতের সন্ধান।

জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবাইকে শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাই।

সুখী হোক সব প্রাণী, চিরজীবী হোক বাংলাদেশ। একটি সুখী, সমৃদ্ধ এবং শান্তিময় বাংলাদেশের প্রত্যাশায় প্রার্থনা নিরন্তর।

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার