অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে ধন্যবাদ। তিনি সরকারের মন্ত্রী হয়েও সারা দেশে সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থার বিষয়টি প্রকাশ্যে সামনে নিয়ে এসেছেন। নিজের এলাকার সড়কের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘মানুষ আমাকে গালি দেয় প্রতিদিন। আমি গ্লাস (গাড়ির) নামাতে পারি না। আমি গ্লাস বন্ধ করে যাওয়ার চেষ্টা করি। তা–ও জোরে যেতে পারি না। রাস্তা খারাপ।’ টোল আদায়ের নামে সড়কে গাড়ি আটকে রাখারও সমালোচনা করেন মন্ত্রী।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জোর গলায় ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। কিন্তু ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে টোল আদায় কোনোটাই তাঁরা ডিজিটাল করতে পারেননি। ঢাকায় কোটি কোটি টাকা দিয়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি কেনার পরও ট্রাফিক পুলিশ কোথাও হাত উঁচিয়ে, কোথাও দড়ি টানিয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে। মহাসড়কের সেতুগুলোর টোল আদায় পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় করা হলে যানজট কিছুটা কমত। পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রি–পেইড বা আগাম টোল আদায়ের ব্যবস্থা থাকে। আমাদের দেশে করতে অসুবিধা কোথায়? তবে সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক হলো কাগজপত্র পরীক্ষার নামে মামলার ভয় দেখিয়ে যানবাহন থেকে পুলিশের উৎকোচ আদায়। কোনো যানবাহন সড়ক আইন না মানলে তারা মামলা করতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী জরিমানা করতে পারে। কিন্তু সেসব না করে গাড়ি আটকে টাকা আদায় করে।
অর্থমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর এনইসি সম্মেলনকক্ষে মহাসড়কের ‘আয়ুষ্কাল: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। সেই সভায় সাংসদ, আমলা, বিশেষজ্ঞ মিলে অনেকেই ছিলেন। অর্থমন্ত্রী প্রশ্ন রাখেন, সড়ক সংস্কারে প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তারপরও সড়কের এই বেহাল কেন? ওই সভায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কাজ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁর অভিযোগ, বিআরটিএ অফিসের লোকেরা কাজ করেন না। কেউ মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, কেউ পত্রিকা পড়েন।
সড়ক ও সেতু বিভাগের দায়িত্ব হলো দেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা সচল রাখা তথা যাত্রীসাধারণের নিরাপদে গন্তব্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। যাত্রীর নিরাপত্তার জন্য শুধু অবকাঠামো ঠিক হলেই হয় না, সেই অবকাঠামো যাঁরা ব্যবহার করবেন, তাঁদের অর্থাৎ চালকদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। গরু–ছাগল চিনলেই কেউ গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেতে পারেন না। সেই সঙ্গে তাঁরা যে গাড়ি সড়কে নামাবেন, সেটিও হতে হবে ত্রুটিমুক্ত। কিন্তু সড়ক ও সেতু বিভাগ কোনোটিই ঠিকমতো করতে পারছে না, যা অর্থমন্ত্রীর কথায় উঠে এসেছে। সড়কের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আয়োজিত এ সেমিনারে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উপস্থিত থাকলে অর্থমন্ত্রী ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর অভিযোগের জবাব দিতে পারতেন। মনে আছে, ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকারে যখন সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন, তখন অন্য সাংসদের সঙ্গে কাদের সাহেবও সড়কের বেহালের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এখন কী বলবেন?
বাংলাদেশে সড়ক যত বেহাল হোক না কেন, এর নির্মাণ ব্যয় সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কিলোমিটারপ্রতি সড়ক নির্মাণের ব্যয় ভারত ও চীনের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি। সংস্থাটির মতে, উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়া ও দরপত্রে প্রতিযোগিতা না থাকার কারণেই সড়ক নির্মাণের ব্যয় অনেক বেশি হয়। বিশ্বব্যাংক জানায়, চার লেন সড়ক নির্মাণের মধ্যে রংপুর-হাটিকুমরুল মহাসড়কের প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৬৬ লাখ ডলার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৭০ লাখ ডলার, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার খরচ নির্ধারিত হয়েছে। অন্যদিকে চার লেন সড়ক তৈরিতে ভারতে ১১ থেকে ১৩ লাখ ডলার ও চীনে ১৩ থেকে ১৬ লাখ ডলার খরচ হয়।
ওই সভায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতা ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন আরেকটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের দাবি, বৃষ্টির কারণে সড়ক নষ্ট হয়। কিন্তু মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্যেও সারা বছর বৃষ্টি থাকে। সেখানে সড়কগুলো টেকসই হয় কী করে?
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য যেদিন (২০ ডিসেম্বর, ২০১৯) সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সেদিনই প্রথম আলোর ভেতরের পাতায় সড়ক নিয়ে আরেকটি খবর, ‘সেতু দেবে উত্তরের পথে তীব্র যানজট’। ঢাকা–বগুড়া মহাসড়কের সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ভুয়াগাতী সেতুটি দেবে যাওয়ায় গত বুধবার সন্ধ্যা থেকে সেটির ওপর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে উত্তরবঙ্গের ১১ জেলায় যাতায়াতকারী যানবাহনের চালক ও যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
সরকার যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে সড়ক অবকাঠামোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। গত ৯ বছরে নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও ব্যয় হয়েছে ১৩ হাজার ৭০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭০৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। কিন্তু এরপরও সড়কের বেহাল দশা কাটেনি। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট-২০১৯’ প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক অবকাঠামোর মানের ভিত্তিতে প্রণীত সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল ছাড়া অন্য সব দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে। নেপাল পাহাড়ি দেশ। আর বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ এলাকা সমতল। তারপরও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ২। শ্রীলঙ্কার স্কোর ৪৬ দশমিক ৭, ভারতের ৫৭ দশমিক ৪ এবং পাকিস্তানের ৪৯ দশমিক ১। সামগ্রিকভাবে অবকাঠামো বিবেচনায় ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম।
কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগারের প্রতিবেদনেও সড়কব্যবস্থার যে চিত্র এসেছে, তা–ও স্বস্তিকর নয়। সরকারের হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স (এইচডিএম) হিসাব বলছে, সারা দেশে ‘দুর্বল’ সড়কের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৫২৮ কিলোমিটার; ‘খারাপ’ তালিকাভুক্ত সড়কের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ২৮২ কিলোমিটার, আর ‘খুব খারাপ’ সড়ক রয়েছে ১ হাজার ৮৪৩ কিলোমিটার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করার কারণেই এমনটি হয়েছে।
তবে দুই মন্ত্রীর সংক্ষুব্ধ বক্তব্য থেকে এ কথা ভাবার কারণ নেই যে দেশের সড়ক ও সেতুগুলোই শুধু বেহাল অবস্থায় আছে। কিংবা এই মন্ত্রণালয়েই দুর্নীতি হয়। কোনো মন্ত্রণালয়ই দুর্নীতি, অনিয়মের বাইরে নয়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অদক্ষতা। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ পরপর পাঁচ বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। একবার আওয়ামী লীগ আমলে। চারবার বিএনপির আমলে। কিন্তু আওয়ামী লীগ একটানা ১১ বছর দেশ শাসনের পরও দুর্নীতির মাত্রা কমেছে বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমরা এক ধাপ এগোই তো দুই ধাপ পিছিয়ে যাই। ২০১৮ সালের টিআইয়ের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম, ১৮০টি দেশের মধ্যে। অথচ ২০১৭ সালে আমরা ছিলাম ১৪৩তম।
শুদ্ধি অভিযানের আগে সরকারের কোনো মন্ত্রী প্রশাসনিক দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজির কথা স্বীকার করেননি। এখন করছেন। অভিযুক্তদের কাউকে কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান একাই গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক-তৃতীয়াংশ কাজ বাগিয়ে নিয়েছিল। এর পেছনে ছিল কোটি কোটি টাকার উৎকোচ–বাণিজ্য। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ভবনের কেনাকাটার দুর্নীতি রূপকথাকেও ছাড়িয়ে গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজসেবাসহ অনেক মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির কারণে সেবাপ্রার্থীরা অতিষ্ঠ। স্থানীয় সরকার সংস্থার কত বরাদ্দ কোথায় যায়, কেউ জানে না। কাঙ্ক্ষিত হারে দারিদ্র্য না কমার কারণ চিহ্নিত করতে গিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগই দরিদ্র মানুষ পায় না। লোপাট হয়ে যায়।
অর্থমন্ত্রী সড়ক ও সেতু খাতের বেহাল অবস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁর নিজের মন্ত্রণালয়টি খুব ভালো চলছে, তা বলা যাবে না। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার সময় তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার বেশির ভাগই পূরণ হয়নি। তিনি দ্রুততম সময়ে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। আসেনি। বলেছিলেন, খেলাপি ঋণের মাত্রা কমাবেন। কমেনি। আশ্বাস দিয়েছিলেন, ব্যাংকের সুদের হার এক অঙ্কে নিয়ে আসবেন। আসেনি। শেয়ারবাজারে স্থিতি আনার অঙ্গীকার করেছিলেন। এখন শেয়ারবাজারের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। ধারণা করা হয়েছিল, আমলা মন্ত্রীর স্থলে ব্যবসায়ী মন্ত্রী এলে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির বক্তব্যে মনে হচ্ছে, সেটিও সুদূর পরাহত।
সোহরাব হাসান: প্রথমআলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com