শুধুই একটা হাতির গল্প নয়

‘কাভান’ যখন পাকিস্তানের চিড়িয়াখানায় িছল
‘কাভান’ যখন পাকিস্তানের চিড়িয়াখানায় িছল

পাকিস্তান অনেক সময়ই আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম হয় আত্মঘাতী হামলা আর ধর্মীয় হানাহানিতে। এ সপ্তাহটা ছিল ভিন্ন। একটা হাতি তাদের ভাবমূর্তি সাময়িকভাবে হলেও অনেকখানি পাল্টে দিয়েছে। পাকিস্তানের জাতীয় পশু মার্কখর বিরল প্রজাতির একধরনের বন্য ছাগল। কিন্তু বহুদিন দেশটির প্রচারমাধ্যম দখল করে আছে ‘কাভান’ নামের একটি হাতি। চিড়িয়াখানার বাসিন্দা ছিল কাভান। কিন্তু একাকী। তার একাকিত্ব অমানবিক বলে সোচ্চার ছিল দেশটির পশুপ্রেমীরা। সেই সূত্রেই ঘটেছে পরবর্তী কাহিনি।

জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে শ্রীলঙ্কা শিশু কাভানকে উপহার হিসেবে দেয়। ১৯৮১ সালে জন্ম কাভানের। চিড়িয়াখানায় শিশু কাভান ছিল একমাত্র হাতি। সে যত বড় হচ্ছিল ততই সঙ্গীর জন্য মাঝেমধ্যেই চিড়িয়াখানার চৌহদ্দি তোলপাড় করত। তার এই আহাজারির ভাষা বুঝতেন কেবল দেশটির গুটিকয়েক প্রাণী বিশেষজ্ঞ।

হাতি দল বেঁধে থাকতে অভ্যস্ত। হাতির পালে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ নারী হাতি নেতৃত্ব দিয়ে চলে। দিনে ১০ থেকে ২০ মাইল হাঁটে একটা হাতির পাল। পালের একজনের মৃত্যু হলে অন্য হাতিরা রীতিমতো সভা করে কাঁদে। এসবই প্রচণ্ড আবেগের স্মারক। কিন্তু কাভানকে তার প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। বন্দী কাভান ছিল মানুষের নিষ্ঠুরতার চিহ্ন। বিশ্বের বহু চিড়িয়াখানায় বহু প্রাণীর সঙ্গে এ রকম আচরণ চলছে আজও।

পাকিস্তানে হাতি বিশেষজ্ঞদের চেঁচামেচিতে একপর্যায়ে কাভানের একাকিত্ব ঘোচানো হয় ‘সাহেলি’ নামের একটা নারী হাতি এনে। পাকিস্তানের কিছু কিছু সংবাদপত্রে লেখা হয়, সাহেলিকে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গার্ডিয়ান ভ্যানিটি ফেয়ার–এর মতো আন্তর্জাতিক কাগজও তাই লিখেছে। তবে পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন এবং আন্তর্জাতিক ‘এলিফ্যান্ট আর্কাইভ’ বলে, সাহেলিকে নেওয়া হয় শ্রীলঙ্কার পিন্নাওয়েলা হাতি-এতিমখানা থেকে। ওই এতিমখানায় সাহেলি ‘মনিকা’ নামে পরিচিত ছিল।

সাহেলিকে যে দেশ থেকেই নেওয়া হোক নাÑ কেন নিশ্চয়ই তাকেও জন্মস্থান থেকে তুলে নেওয়া হয়। তবে তাকে পেয়ে কাভানের জীবন কিছুটা আনন্দময় হয়ে উঠেছিল। সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তাদের সংসার টেকে মাত্র ১২ বছর। ২০১২ সালে সাহেলি পায়ের অসুখে মারা যায়।

সাহেলিকে হারিয়ে গত আট বছরে কাভান আগের চেয়েও উন্মত্ত হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে গভীর বিষণ্নতায় ভুগত এবং মোটা হয়ে যাচ্ছিল। অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধির বড় কারণ ছিল তাকে পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা হতো। বৈশ্বিক চিড়িয়াখানা ব্যবসার সেটা আরেক বর্বরতা। চলতি মহামারিতে অনেক দেশেই মানুষ দু-তিন মাস কোয়ারেন্টিন থেকে অস্থির হয়ে আন্দোলনে নেমেছে লকডাউন তুলে নেওয়ার জন্য। করোনা-পজিটিভে ১৪ দিন ঘরে থেকেই আমরা হাঁপিয়ে উঠি। কাভান গত আট বছর বলা যায় শিকল পায়ে কোয়ারেন্টিনেই ছিল। একই রকম কোয়ারেন্টিনে আছে আজও বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার পশু-পাখি।

৩৫ বছরের বন্দিত্ব এবং বর্বরতা থেকে কাভান এভাবে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেতে চলেছে। সুস্থ থাকলে তার জীবন আরও ৩৫ বছর দীর্ঘ হতে পারে। হাতিরা ৭০-৮০ বছর বাঁচে।

তবে কাভানের ভাগ্য ভালো। তার শিকলমুক্তির জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানে যথেষ্ট শোরগোল হয়। অনেকে জানেন, হাতিদের রক্ষায় কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ভালো কাজ করছে। যদিও তৃতীয় বিশ্বের খুব কম দেশেই শাসকেরা এ রকম প্রাণীপ্রেমীদের সহায়তা করে। কাভানকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিতে আমেরিকার পপস্টার শেরেরও ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। শেষ পর্যন্ত এসবে কাজ হয়। ইসলামাবাদ হাইকোর্টের আদেশে গত সপ্তাহে কাভানকে পাকিস্তান থেকে আড়াই হাজার মাইল দূরে কম্বোডিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার আগে অভয়ারণ্যে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করার উপযোগী করে তুলতে কাভানকে বেশ ডায়েট করানো হয়।

আন্তর্জাতিক একটা সংস্থা এসব কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে, এ জন্য তারা চার লাখ ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছে। কম্বোডিয়ায় অভয়ারণ্যে হাতির পালের মধ্যে কাভানকে ছেড়ে দেওয়া হবে। প্রায় ১০ লাখ একর জায়গার ওপর কম্বোডিয়া এক অভয়ারণ্য সংরক্ষণ করছে। কাভানকে আবার সংসার গড়ার সুযোগ করে দিতে সেখানে এমন একটি হাতির পালও শনাক্ত করা হয়েছে, যেখানে একাধিক নারী হাতি আছে। ৩৫ বছরের বন্দিত্ব এবং বর্বরতা থেকে কাভান এভাবে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেতে চলেছে। সুস্থ থাকলে তার জীবন আরও ৩৫ বছর দীর্ঘ হতে পারে। হাতিরা ৭০-৮০ বছর বাঁচে।

কাভানকে মুক্তি দেওয়া পাকিস্তানের তরফ থেকে সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। আমেরিকার পপস্টার শের জো বাইডেনের সমর্থক। ইমরান খান নানান কারণে কাভানের মুক্তিতে শামিল হওয়াকে জরুরি মনে করে থাকতে পারেন। এমনকি কাভানের পাশাপাশি ওই চিড়িয়াখানার অন্য সব প্রাণীকেও বনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে পাকিস্তান।

এ ঘটনা থেকে বিশ্ববাসীর জন্য একটা বড় বার্তা রয়েছে। বন্য পশুপাখি হত্যা বন্ধ করার পাশাপাশি উপহার হিসেবে দেওয়া-নেওয়াও বন্ধ করা জরুরি। এমনকি বিক্রি-বাট্টাও। হাতিপ্রেমীদের সক্রিয়তায় এর বেচাকেনা কিছু কমছে। এ রকম সব উপহার ও ব্যবসা প্রাণীদের জীবনকে চিরস্থায়ী এক দুর্বিষহতায় ভরিয়ে তোলে।

বাংলাদেশের জন্যও বার্তাটি জরুরি। এখান থেকে হরিণ ও হাতি উপহার দেওয়ার রেওয়াজ বহু পুরোনো। ঔপনিবেশিক শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ‘খেদা’ দিয়ে বহু হাতি ধরে বিশ্বের নানান দেশে উপহার দেওয়ার নজির আছে। যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের হাতি গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বহু শাসকও বাংলার হরিণ উপহার পেতেন। সেই সব প্রাণীর পরিণতি কী ঘটেছে, সে খবর কি বাংলাদেশ রেখেছে?

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন এবং তুলবেন, একটা হাতিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে এত ব্যয়বহুল আয়োজনের কী প্রয়োজন। আদতে এটা কোনো এক কাভানের জন্য করা হচ্ছে ভাবলে ভুল হবে। নিশ্চয়ই কাভান মাতৃভূমি শ্রীলঙ্কার বনে জীবনটা কাটাতে পারলেই সুখী হতো। তার ৩৫ বছরের বিভীষিকাময় জীবনের দায় অবশ্যই মানুষের। কাভানকে তারই প্রজাতির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলো মানবজাতির পাপমোচনের ক্ষুদ্র এক চেষ্টা এবং বৈশ্বিক এক বড় শিক্ষামূলক উদ্যোগ। পৃথিবী শুধু যে মানুষের নয়, এতে যে সব প্রাণের হক রয়েছে, তাদেরও স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্ক ও প্রজাতি উৎপাদনের অধিকার রয়েছে, কাভান অধ্যায়ে আমরা যদি সেটা শিখে থাকি, তাহলে চার লাখ ডলার সামান্য অর্থই। চাইলে অর্থ ছাড়াই আমরা বিশ্বকে সব প্রাণ–প্রকৃতির বাসযোগ্য করে তুলতে পারি।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক