শিশুর নির্যাতন প্রতিরোধ–সম্পর্কিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২০ অনুসারে, প্রতিবছর বিশ্বের অর্ধেক শিশু (প্রায় ১০০ কোটি) শারীরিক, যৌন এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার। এর ফলে তারা আহত তো হয়ই, কেউ কেউ প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, কখনো কখনো শিশুদের মৃত্যুও ঘটে। এ বছরের জুন মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউনেসকো এবং শিশুর নির্যাতন অবসানে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি কর্তৃক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। এতে বাংলাদেশসহ ১৫৫টি দেশে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও সাড়াদানের সাতটি কৌশলসংবলিত ‘ইন্সপায়ার’ (INSPIRE)–এর অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য আছে। এই প্রথম, দেশগুলোর সরকার শিশু নির্যাতন মোকাবিলার জন্য তাদের কাজের বিষয়ে নিজস্ব প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কিছু পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা থাকার পরও প্রতিবেদনটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের জন্য শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে দেশগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং এতে ভবিষ্যতের জন্য বেশ কিছু পরামর্শ আছে।
নির্যাতন শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন, যা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর মারাত্মক অর্থনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। একটি হিসাবে দেখা যায়, শিশু নির্যাতনের ফলে বিশ্বে জিডিপিতে প্রতিবছর এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রায় সব দেশেই (৮৮ শতাংশ) নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য আইন রয়েছে, তবে অর্ধেকের কম দেশগুলোতে (৪৭ শতাংশ) আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অপরাধীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা হয়; যার কারণে শিশু নির্যাতন ঘটেই চলেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখিত এক হিসাবে, জরিপের আগের মাসে বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছরের শতকরা ৮৯ ভাগ শিশুকে ‘শৃঙ্খলা’ বা কোনো কিছু শেখানোর নামে নির্যাতন করা হয়েছে। শিশু সুরক্ষা নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে আমাদের দেশে শিশুদের শাস্তি বেশির ভাগ মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য। এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সচেতনতা খুব কম। সব শিশুই নির্যাতনের ঝুঁকিতে আছে, তবে শিশুশ্রমিক, পথে বসবাসকারী শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, প্রতিষ্ঠানে বসবাসকারী শিশুসহ অনেক শিশু তাদের অবস্থানের কারণে অতিরিক্ত ঝুঁকিতে থাকে। শিশুরা ভয়ংকর নির্মমতার শিকার হলে মিডিয়ায় খবর হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সবাই ভুলে যাই। শুধু ভয়াবহ ঘটনাগুলো আমরা জানতে পারি। প্রতিদিন অসংখ্য শিশু ঘরে এবং বাইরে নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করছে। তাদের খবর কে রাখে?
বাংলাদেশে শিশু, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের অভাব সামগ্রিকভাবে শিশুর নির্যাতন মোকাবিলাকে কঠিন করে তুলেছে। তার সঙ্গে রয়েছে অপর্যাপ্ত পেশাদারি দক্ষতা এবং সীমিত বিনিয়োগ। বিভিন্ন বয়সী শিশুদের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি আলাদা হয়। শিশু বিকাশের পর্যায়গুলো বুঝে তাদের বয়স উপযোগী ভালোবাসা এবং উষ্ণতা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষের দক্ষতা এবং আন্তরিকতার অভাব আছে। মনোযোগ দিয়ে শিশুদের কথা শোনা, কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে তাদের বুঝিয়ে বলা যে গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিষয়ে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই।
বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩২ থেকে ৩৭ শতাংশ দেশ নির্যাতনের শিকার শিশুদের সেবা দেয়, এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। তবে বেশির ভাগ শিশুই থেকে যায় এর আওতার বাইরে।
বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩২ থেকে ৩৭ শতাংশ দেশ নির্যাতনের শিকার শিশুদের সেবা দেয়, এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। তবে বেশির ভাগ শিশুই থেকে যায় এর আওতার বাইরে। ২৬ শতাংশ দেশ মা–বাবা ও যত্নকারীদের সহায়তাবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং ১৫ শতাংশ দেশ শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো প্রকল্প নেই।
প্রতিবেদনটি এমন এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছে, যখন বেশির ভাগ দেশ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ব্যস্ত। এই বৈশ্বিক মহামারি প্রাথমিকভাবে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা হলেও শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষার ওপর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ, চলাচলে নিষেধাজ্ঞা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণে শিশুরা তাদের নিয়মিত জীবন হারিয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের মূলে আছে নারী–পুরুষের মধ্যে ক্ষমতার বৈষম্য এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। বিভিন্ন দুর্যোগে তারা অতিরিক্ত ঝুঁকিতে থাকে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন নারী ও শিশু অধিকার সংগঠন এবং মিডিয়া প্রতিবেদনগুলো থেকে আমরা জানি যে কোভিড-১৯–এর সময় নারী ও শিশু নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, সাইবার অপরাধ, পাচার ইত্যাদি বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র এক-পঞ্চমাংশ দেশ শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করেছে। প্রতিটি দেশের নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়ে আরও কাজ করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন।
আমরা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুদের প্রতি সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করতে চাই (এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ২), তবে আমাদের কাজে আরও অনেক বেশি গতি আনতে হবে।
প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে যে আমরা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুদের প্রতি সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করতে চাই (এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ২), তবে আমাদের কাজে আরও অনেক বেশি গতি আনতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দেন, তাহলে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।
প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন এমন বেশ কিছু সুপারিশ রয়েছে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিশু নির্যাতন বন্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। নিয়মিত এসডিজি প্রতিবেদনের অংশ হিসেবে নির্যাতন–সম্পর্কিত প্রধান সূচকগুলোর ওপর তথ্য সংগ্রহকে অগ্রাধিকার দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে শিশু নির্যাতন কমে, তা আমরা জানি (ইন্সপায়ার-এ সেগুলো বিস্তারিতভাবে আছে)। তার ওপর ভিত্তি করেই কার্যক্রমের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো এবং তা যথাযথভাবে খরচ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।
সব স্তরে একটি কার্যকর শিশু সুরক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মা-বাবা, শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম—সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশু–সংবেদনশীল একটি সমাজ গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। শিশুদের অধস্তন করে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। শিশুদের সম্মান করার বিষয়টি বড়দের শেখা উচিত। প্রশ্ন হলো, শিশু নির্যাতন অবসানে আমরা কি আন্তরিক।
লায়লা খন্দকার: শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ