কাওয়াসাকি এ দেশে খুব জনপ্রিয় জাপানি ঘরানার মোটরসাইকেলগুলির মধ্যে অন্যতম ব্র্যান্ড। কিন্তু এটা একটা রোগেরও নাম। করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত দেশগুলোয় হঠাৎই বেড়েছে বিরল কাওয়াসাকি রোগের বিস্তার। কথিত কাওয়াসাকিতে আক্রান্ত শিশুদের প্রায় সবাই কোভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। দুই রোগের উপসর্গে আশ্চর্য ধরনের মিল থাকায় চিকিৎসকেরা ধাঁধায় পড়ে গেছেন। কঠিন হচ্ছে রোগ শনাক্তকরণ, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি। করোনা ও কাওয়াসাকির মধ্যে যোগসূত্র খতিয়ে দেখতে এরই মধ্যে গবেষণা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনসহ ছয়টি দেশ।
১৯৬৭ সালে জাপানি শিশু বিশেষজ্ঞ ও গবেষক টোমিসাকু কাওয়াসাকি পৃথিবীকে জানিয়ে দেন প্রাণঘাতী এক ভাইরাসের কথা। পরে তাঁর নামেই রোগটির নামকরণ করা হয়। এর আগে এই জাতীয় রোগকে মিউকোকিউটেনিয়াস লিস্ফ নোড সিনড্রোম বলা হতো।
কী দেখে কাওয়াসাকি চেনা যায়
শিশুর হঠাৎ করেই জ্বর আসে। জ্বরের সঙ্গে বা পরে দুই চোখ লাল হয়ে যেতে পারে (কনজাংটিভাইটিস সংক্রমণ)। সেই সঙ্গে শিশুর চামড়ায় বিভিন্ন ধরনের দানা হতে পারে। হাম বা স্কারলেট ফিভার যেমন হয় তেমন দানা, চুলকানি, প্যাপিউল ইত্যাদি। চামড়ার দানা প্রথমে শরীরে বা হাতে-পায়ে এবং কখনো কখনো ডায়াপার পরানো স্থানে হতে পারে। এটা পরে লাল হয়ে গিয়ে চামড়া উঠে উঠে আসে। মুখে বা মুখের ভেতরেও কিছু উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন মুখ আর জিবের রঙে পরিবর্তন। মুখটা লাল টকটকে দেখায়, ঠোঁট ফাটে যায়, জিব এমনই লাল হয়ে যায় যে পাকা স্ট্রবেরির মতো দেখায় (সাধারণভাবে একে স্ট্রবেরি জিব বলা হয়)। গলার ভেতর লাল হওয়া, হাত-পাও আক্রান্ত হতে পারে, যেমন হাত ও পায়ের পাতা লাল হওয়া বা ফুলে যাওয়া। হাত ও পায়ের আঙুলে পানি জমে ফুলে যেতে পারে। এরপর দু-এক সপ্তাহের মধ্যে হাত ও পায়ের আঙুলের মাথা থেকে চামড়া উঠে যেতে পারে। অর্ধেকেরও বেশি রোগীর গলার লসিকাগ্রন্থি ফুলে যায়। কখনো কখনো অন্যান্য গিরা ব্যথা, গিরা ফোলা, পেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানা, খিটখিটে মেজাজ বা মাথাব্যথা ধরনের উপসর্গ থাকতে পারে। যেসব শিশুকে বিসিজি (যক্ষ্মা প্রতিরোধমূলক) টিকা দেওয়া হয়েছে, সেসব দেশে টিকার দাগের জায়গাটা লাল হতে দেখা যায়।
কাদের বেশি হয়
পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা আক্রান্ত হয় বেশি। সবচেয়ে বেশি হয় ১৮ থেকে ২৪ মাস বয়সের শিশুদের। তিন মাসের নিচে বা পাঁচ বছরের ওপরে এই রোগ সাধারণত হয় না কিন্তু হলে হৃৎপিণ্ডের ধমনী প্রসারণের ঝুঁকি বেশি থাকে। এটা মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের বেশি হয়। যদিও কাওয়াসাকি বছরে যেকোনো সময়ই হতে পারে তবে শীতকালের শেষে এবং বসন্ত ঋতুতে এটা বেশি দেখা যায়। কিন্তু করোনাকালে সে আর গ্রীষ্ম-বর্ষা মানছে না।
করোনাকালে কাওয়াসাকির ছোটাছুটি
বিলেতে এটার বিস্তার প্রথম নজরে এলেও এখন ইউরোপের বাইরে মার্কিন মুলুকেও কাওয়াসাকি রাজত্ব করছে। নিউইয়র্কে শিশুদের দেহে কাওয়াসাকির উপসর্গ প্রথমে বাংলাদেশের মতো ‘অজ্ঞাত’ রোগ বলা হলেও এখন বোঝা যাচ্ছে আসলেই কাওয়াসাকির খপ্পরে আছে তারা। নিউইয়র্কের হাসপাতালে গত সপ্তাহে ২ থেকে ১৫ বছর বয়সের যে ১৫টি শিশু ভর্তি হয়েছিল, তাদের সবার দেহে বহুমাত্রিক প্রদাহজনিত উপসর্গ দেখা গেছে। এদের মধ্যে ৪ জনের রক্তের নমুনায় করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। বাকি ৬ জনের অবশ্য নেগেটিভ রিপোর্ট ছিল। তবে মনে করা হচ্ছে, বাকি যারা সুস্থ হয়ে উঠেছে, তারা আগে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে। নিউইয়র্ক সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের স্বাস্থ্য সতর্কতায় এ তথ্য জানিয়ে দেয়। কয়েক দিন পর ৬ মে বুধবার কাওয়াসাকির উপসর্গের ছায়া দেখা দেয় ৬৪টি শিশুর মধ্যে।
দুই দিন পর ৮ মে নিউইয়র্ক থেকে ৪৪৯০ কিলোমিটার দূরের শহর লস অ্যাঞ্জেলেসে তিনটি শিশুর মধ্যে কাওয়াসাকির আলামত নিশ্চিত করেন চিকিৎসকেরা। তারা সবাই করোনা পজিটিভ ছিল। লস অ্যাঞ্জেলেসে শিশু হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক জ্যাকুলিন এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনো রাখঢাক না করেই বলেছেন, ‘আমরা প্রতিদিনই শিখছি, এখনো জানার অনেক বাকি, নতুন সব উপসর্গ ভালো করে বুঝতে হবে।’ আহা আমরাও যদি সেভাবে বুঝতাম!
এসব জেনে আমাদের কী হবে
প্রথম দিকে শিশুরা মুক্ত শিশুদের ভয় নাই বলে প্রচার করা হলেও শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা সংখ্যা একদম কম না। মনে পড়ে, মধ্য ফেব্রুয়ারিতে কোনো এক টিভি চ্যানেলে টিভিতে স্কুল আংশিক বন্ধ রাখার প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়ায় করোনা বিশেষজ্ঞরা আমার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনলাইনেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) জানাচ্ছে, দেশে গত ৯ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৫২ শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি শিশু মারা গেছে। শুধু তা-ই নয় সংগঠনটির হিসাব অনুযায়ী খবরের বাইরে কমপক্ষে আরও ২৭টি শিশু করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তাঁরা এটা বলেছেন। এদিকে আরও ২৪টি শিশুর করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে কিন্তু এর ফল জানা যায়নি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়স্ক চার মাসের শিশু এবং সর্বোচ্চ ১৭ বছর ঊর্ধ্ব শিশুর দেহে করোনার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
অপ্রস্তুতি, অদক্ষতা, সম্পদের অপ্রতুলতা, চিকিৎসকের নিরাপত্তার অভাব, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নাজুকতা— প্রভৃতি কারণে আরোগ্যের এখন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নিজ গৃহ। বয়সভেদে শিশুদের দেখাশোনা ও শুশ্রূষার রকমফের আছে। লক্ষণ দেখে উপসর্গ বুঝে যখন শুশ্রূষা একমাত্র উপায়, তখন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সেগুলোর বয়সভিত্তিক তথ্য জানিয়ে দেওয়াটা জরুরি। আর সেটা তখনই সম্ভব, যখন আমরা বয়সভিত্তিক তথ্য রাখতে পারব।
শিশুদের ক্ষেত্রে এই বয়স বিভাজন কমপক্ষে চারটি স্তরে হওয়া উচিত—৫ বছরের নিচে, ১০ বছরের নিচে, ১৪ বছরের নিচে, ১৮ বছরের নিচে। ‘আইইডিসিআর (এখন অধিদপ্তর) সব শিশুকে দুটি ভাগে ভাগ করে প্রতিদিনকার আপডেট দিয়ে থাকে। ১০ বছরের নিচে আর ২০ বছরের নিচে। ২০ বছরের নিচের গ্রুপের মধ্যে শিশু-কিশোর যেমন আছে, তেমনি আবার সাবালক তরুণেরাও আছেন। ফলে প্রকৃতপক্ষে কতসংখ্যক শিশু আক্রান্ত হয়েছে, তার প্রকৃত সংখ্যা জানা যাচ্ছে না।
পরিবারের বড়দের থেকে শিশুরা আক্রান্ত হতে পারে আবার শিশুদের থেকে বড়দের বিশেষ করে প্রবীণদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। শিশুদের প্রতি নজরদারি তখনই কার্যকার হবে, যখন অভিভাবকেরা স্পষ্ট করে জানতে পারবেন কোন বয়সের কী লক্ষণ কী উপসর্গ। শিশু অধিকার ফোরামের পক্ষ থেকে আগে আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে তাঁরা জানিয়েছেন। সংবাদকর্মীদের কেউ কেউ শিশুদের স্বার্থের অভিভাবক মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে লিখিত অভিযোগ ও পরামর্শ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি সপ্তাহ দুই আগে বিষয়টি নিয়ে জনাব মীরজাদির (পরিচালক, আইইডিসিআর) দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, শিশুদের আক্রান্তের হার কম বলেই আলাদা করা হয় না। তিনি আরও বলেন সংখ্যানির্দিষ্ট করে প্রকাশ করতে কোনো বাধা নেই। প্রয়োজনে করা হবে।
প্রয়োজনটা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। নানা বয়সের শিশুদের নানা লক্ষণ আর চাহিদার বিষয়গুলো জানা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক
nayeem55o8@gmail.com