সরকার সম্প্রতি ‘শিক্ষা আইন’ চূড়ান্ত করার কাজ শুরু করেছে। সংবাদপত্রের তথ্যমতে, আইনের খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করা গেছে এবং আনুষঙ্গিক কিছু কাজ শেষে তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট অতি গুরুত্বপূর্ণ আইনটির অনুমোদন হতে যাচ্ছে, এমন একটি খবরে মন আনন্দে ভরে উঠলেও একই সঙ্গে কিছু উদ্বেগও জেগেছে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১০ সালে আমরা একটি জাতীয় শিক্ষানীতি পেয়েছিলাম। এই শিক্ষানীতি প্রস্তুত করা হয়েছিল সংবিধানের চারটি মূলনীতি ও ১৯৭৪ সালের কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের ওপর ভিত্তি করে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের বিভিন্ন দিকের একটি সমন্বিত প্রতিফলন ঘটেছিল।
শিক্ষানীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে সবার জন্য বৈষম্যহীন গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, একই সঙ্গে যুগোপযোগী বিজ্ঞানমনস্ক একটি আধুনিক জাতি তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একটি ‘সমন্বিত শিক্ষা আইন’ প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে শিক্ষানীতির মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়নের আইনি কাঠামো তৈরি হবে। সরকার ২০১১ সালে এই শিক্ষা আইন তৈরির কাজ শুরু করলেও গত এক দশক ধরে ‘হবে, হচ্ছে’ করে ঢিমেতালে এগিয়েছে। কোনো কোনো সময় অনেক দূর এগিয়েও এর চূড়ান্ত অনুমোদন থেমে গেছে।
শিক্ষা আইন ‘মানসম্মত, সমতাভিত্তিক এবং সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার’ প্রতিষ্ঠায় আইনি কাঠামো হবে, এটাই সবার কাছে কাম্য। যেমনটি হয়েছে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে। শিক্ষা আইনকে হতে হবে শিক্ষায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার, যার মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকৃত ও জবাবদিহিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
কিন্তু প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে সহায়ক বইয়ের নামে ‘গাইড বই’ এবং এদিক-সেদিক করে কোচিং সেন্টারের বিষয়টি রেখেই দেওয়া হচ্ছে। কোচিং সেন্টার ও গাইড বইয়ের এই সুযোগ একদিকে গুণগত শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করবে, অপরদিকে গড়ে তুলবে তোতাপাখির মতো মুখস্থনির্ভর মানহীন একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
শিক্ষা আইনের এই সুযোগের অপব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ ও শিক্ষায় বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে এবং আগের মতো প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গর্হিত অসাধুতার সঙ্গে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়বে। এই সুযোগ শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইবিমুখ করে তুলবে এবং ২০১০ সাল থেকে জনগণের কষ্টের টাকায় সবার জন্য বিনা মূল্যে বই বিতরণে সরকার যে সাফল্য অর্জন করেছে, তাতে জল ঢেলে দেবে।
সর্বোপরি এটি আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষায় অভিগম্যতা হ্রাস করবে এবং শিক্ষা হবে তথাকথিত শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের একটি পণ্য, যা বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ একটি সমন্বিত শিক্ষা আইনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে দেশের চলমান কওমি মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমসহ বিদেশি পাঠ্যক্রমে পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের আলোচনায় দেশের একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এক শিক্ষকনেতার আলোচনা দেখছিলাম। সেখানে ওই শিক্ষকনেতা সরাসরি জাতীয় সংগীত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠানে তা গাইতে প্রকারান্তরে অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংগীত নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন আছে।’ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজ আমাদের এরূপ একটি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠান সেভাবে কোনো আইনি কাঠামো দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না।
একই কথা প্রযোজ্য বিদেশি পাঠক্রমনির্ভর ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর ক্ষেত্রে। অতিরিক্ত ফি নেওয়াসহ তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ থাকার পরও আইনি কাঠামোর দুর্বলতার কারণে তাদের যথাযথ কাঠামোর আওতায় আনা যায়নি।
ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই শহরভিত্তিক কিছু উচ্চবিত্তের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যেখানে দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ বা আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। ফলে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো গরিব বা এতিম শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির ধারক-বাহক আর বিদেশি পাঠক্রমনির্ভর ইংরেজি মাধ্যমগুলো শহুরে উচ্চবিত্তের এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠান দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশের পরিবর্তে সমাজে উগ্রতা তৈরি, অপসংস্কৃতির বিকাশ এবং মেধা পাচারের কাজ করছে। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে বিষয়টিকে একরকম উপেক্ষাই করা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সৃজনশীল জাতি তৈরির কথা বলা হয়েছে। সৃজনশীল শিক্ষার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সৃজনশীল শিক্ষক, সৃজনশীল পাঠক্রম এবং সৃজনশীল শিক্ষা উপকরণ। খসড়া শিক্ষা আইনে এসব বিষয় সেই গতানুগতিক ধারায়ই রয়ে গেছে। সত্যি বলতে, গাইড বই এবং কোচিং সেন্টার-নির্ভর শিক্ষার সুযোগ রেখে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখা আর অমাবস্যার রাতে চাঁদ দেখার চিন্তা অনেকটা একই রকম।
আমরা জানি না, করোনার এই অতিমারি কবে যাবে। তবে এটি সত্য যে করোনা-পূর্ববর্তী বিশ্ব হয়তো আমরা আর কখনোই ফিরে পাব না। এক বছরের অধিক সময় ধরে শিক্ষার্থীরা একরকম পড়ালেখার বাইরে। সুতরাং অতিমারিপরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হতে পারে, তার যৎসামান্য হলেও একটা ধারণা এই আইনে আনা যেত। কিন্তু খসড়া আইনে তার কোনো প্রতিফলন নেই।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-কে মূল ভিত্তি হিসেবে ধরে এবং বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খসড়া শিক্ষা আইনটি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষা আইনের মতো আমাদের দেশেও শিক্ষা আইনটিকে অধিকারভিত্তিক অ্যাপ্রোচে রূপান্তরিত করতে হবে, যাতে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তানেরা আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিনিয়োগ করবে। তা না হলে এটি শুধু একটি আইনই হবে কিন্তু আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক এবং সবার জন্য বৈষম্যহীন গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।
ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান: লেখক ও গবেষক
smostafiz_r@yahoo.com)