‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন।’
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদ।
এবার উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হারে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। ছেলেদের পাসের হার ৭১ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং মেয়েদের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গড় পাসের হার ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। তবে জিপিএ-৫-এ ছেলেরা কিছুটা এগিয়ে আছেন। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪৭ হাজার ২৮৬ জন। ছেলে পরীক্ষার্থী ৭ লাখ ৩ হাজার জন। এর মধ্যে পাস করেছেন ৫ লাখ ৩ হাজার ৮২৮ জন। জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলের সংখ্যা ২৪ হাজার ৫৭৬ জন। মেয়ে পরীক্ষার্থী ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬২৯ জন। পাস করেছেন ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৪৪ জন। মেয়েদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২২ হাজার ৭১০ জন।
অন্যদিকে চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটিতেই মেয়েরা এগিয়ে ছিল। এসএসসিতে মেয়েদের পাসের হার ৮৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর ছেলেদের পাসের হার ৮১ দশমিক ১৩ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন। এর মধ্যে মেয়ের সংখ্যা ৫৩ হাজার ৪৮৪ জন। আর ছেলে ৫২ হাজার ১১০ জন।
জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে শিক্ষার হার ৭৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে নারীশিক্ষার হার ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর এই বয়সীদের মধ্যে পুরুষের শিক্ষার হার ৭৪ শতাংশ। এ হিসাবে নারীশিক্ষার হার পুরুষের চেয়ে ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের ভর্তির হার বর্তমানে ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে প্রাথমিকে মেয়েশিশু ভর্তির হার ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ছেলেশিশুদের ভর্তির হার আটকে আছে ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশে। নারীশিক্ষার উন্নয়নে যে ভারত বা প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো করছে, সে কথা স্বীকার করেছেন নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও।
কয়েক বছর ধরেই এসএসসি ও এইচএসসিতে মেয়েরা ভালো ফল করে আসছেন। কিন্তু এই ভালো ফল করা মেয়েরা কোথায় যান? তাঁরা কি এই সাফল্য পরবর্তী শিক্ষা ও কর্মজীবনে ধরে রাখতে পারেন? পরিসংখ্যান বলে পারেন না। ৩১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ পুরুষ প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৪৭৫, আর নারী ছিলেন ৬২১। ৩৪তম বিসিএসে পুরুষ ও নারী ছিলেন যথাক্রমে ১ হাজার ৪০০ ও ৭৭৫। অন্যান্য সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে ব্যবধানটা আরও বেশি। স্বীকার করতে হবে, পরীক্ষায় এগিয়ে থাকা মেয়েরা কর্মজীবনে খুব ভালো করছেন না। অনেকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকছেন বা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারি হিসাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলেশিক্ষার্থীর চেয়ে মেয়েশিক্ষার্থী বেশি। এরপরই মেয়েদের সংখ্যা কমতে থাকে। উচ্চমাধ্যমিকে ৪৭ শতাংশ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ৪০ শতাংশ কিংবা আরও কম।
মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে যেসব ছেলে বা মেয়ে ভালো ফল করেন, তাঁদের সবার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশোনা করা সম্ভব না-ও হতে পারে। ছেলেদের না পারার পেছনে আর্থিক অসচ্ছলতা মূল কারণ হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে দেশে ধর্মীয় নেতারা ফতোয়া দেন, মেয়েদের চতুর্থ শ্রেণির বেশি লেখাপড়ার প্রয়োজন নেই কিংবা মেয়েরা পড়াশোনা করলেও আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করতে হবে, সে দেশে মেয়েদের নিয়তই বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কেউ সেই বাধা অতিক্রম করতে পারেন, কেউ পারেন না।
এসএসসি বা এইচএসসির পর যেসব ছেলে পড়াশোনা করতে পারেন না, তাঁরা কোনো না কোনো কাজে লেগে যান। কিন্তু মেয়েদের পক্ষে সেটি সব সময় সম্ভব হয় না। আবার বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ভর্তি হয়েও অনেক মেয়ে নানা কারণে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। অনেক অভিভাবক ‘ভালো পাত্র’ পেলে পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। যেন ভালো পাত্র পাওয়ার জন্যই তাঁদের পড়াশোনা করানো হচ্ছিল। সাম্প্রতিক কালে শিক্ষাঙ্গনে নারী নিগ্রহের ঘটনাও মারাত্মক রূপ নিয়েছে। মেয়েদের সামনে এগোনোর পথে এটাও আরেকটি বাধা। ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত জাহান মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়েও নিজেকে সমৃদ্ধ করতে। কিন্তু মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা প্রথমে তাঁর ওপর যৌন নির্যাতন চালান। এরপর মেয়েটি সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে মামলা করলে তিনি ভাড়াটে লোক দিয়ে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন। তখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছিল। নুসরাত দুটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পেরেছিলেন। ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, দুটিতেই তিনি জিপিএ-৪ পেয়েছেন।
আমাদের সমাজে মেয়েদের চলার পথে পদে পদে বাধা। এ কারণে মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়লেও কর্মক্ষেত্রে তাঁরা পিছিয়ে আছেন। একসময় এনজিওতে বিপুল মেয়ে কাজ করতেন। এখন তাঁদের কার্যক্রমও সীমিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মবাজারে নারী আছেন ১ কোটি ৮২ লাখ। অন্যদিকে পুরুষের সংখ্যা ৪ কোটি ২৫ লাখ। শ্রমবাজারের বাইরে আছেন ৩ কোটি ৬১ লাখ নারী। কিন্তু কর্মবাজারের বাইরে থাকা পুরুষের সংখ্যা ৯৬ লাখ। পুরুষের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩ শতাংশ। আর নারীর বেকারত্বের হার ৭ শতাংশ। এটা ঠিক শিক্ষার বিপরীত।
জনপ্রশাসন, বিচারালয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ফলাও করে প্রচার করেন। কিন্তু উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা খুব বেশি এগিয়েছি বলা যাবে না। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেতুবন্ধ বাংলাদেশ। পশ্চিমে গেলে নারীর অনুন্নয়ন ও পশ্চাৎপদতা বেশি চোখে পড়ে। প্রথমে ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মেয়েরাও পিছিয়ে আছে। কিন্তু পুবের দেশগুলোতে নারীর উন্নতি ও সাফল্য অনেক বেশি। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা চীনে শতভাগ নারী কর্মজীবী। এসব দেশে অফিসে, মার্কেটে, গণপরিবহনে নারীর উপস্থিতি সমান সমান। কিন্তু ঢাকা শহরে কোনো সরকারি বা বেসরকারি অফিসে গড়ে ১০ শতাংশের বেশি নারী কর্মী পাওয়া যাবে না। উচ্চ পদে নারী কর্মীর অনুপাত আরও কম। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অনেকে গ্রামীণ ব্যাংক-ব্র্যাক মডেল কিংবা তৈরি পোশাকশিল্পে নিয়োজিত লাখ লাখ নারী শ্রমিকের উদাহরণ দেন। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নারীর শতকরা ৯০ জন দরিদ্র ও শিক্ষাবঞ্চিত। বেশির ভাগই দারিদ্র্যচক্রে বন্দী।
এসএসসি ও এইচএসসিতে মেয়েদের এগিয়ে থাকার খবরটি যেমন আমাদের আনন্দিত করে, তেমনি পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনে তাঁদের বেশির ভাগের অনুপস্থিতি ভীষণ পীড়া দেয়। প্রশ্ন জাগে, এই মেধাবী ও উজ্জ্বল মেয়েরা কোথায় হারিয়ে যান? আমাদের সমাজে নারীর সত্যিকার ক্ষমতায়ন হয়েছে নিচের তলায়। খেতে-খামারে, তৈরি পোশাকশিল্পে। মধ্যবিত্ত পরিবারের পুরুষ অভিভাবকদের বাসনা হলো যত দিন সংসারে সচ্ছলতা না আসে, তত দিন নারীরা কাজ করুন। সচ্ছলতা এলে তাঁদের আর বাইরের কাজ করার প্রয়োজন নেই। আবার উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন মনে করেন, তাঁদের তো টাকাপয়সার কোনো অভাব নেই। তাহলে মেয়েদের কেন চাকরি করতে হবে?
কিন্তু তাঁরা একবারও চিন্তা করেন না একজন নারী বা পুরুষ শুধু আর্থিক কারণে চাকরি করেন না। চাকরির সঙ্গে আর্থিক বিষয়টি নিশ্চয়ই জড়িত। তিনি তাঁর কাজের বিনিময়ে মজুরি পাবেন। স্বাবলম্বী হবেন। কিন্তু এসবের চেয়েও বড় পাওনা হলো তাঁর অধীত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে লাগানো। এটি কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়, একান্ত কর্তব্য।
কিন্তু পুরুষতন্ত্র নারীর সেই অধিকারটুকু স্বীকার করতে কুণ্ঠিত বলেই শিক্ষায় এগিয়ে থাকা মেয়েরা কর্মজীবনে পিছিয়ে যান, হারিয়ে যান।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com