মতামত

শিক্ষার ভাষা—জীবনের ভাষা

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে না পারা একটি বড় সমস্যা। কিন্তু সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধানের উপায় কি বিবেচিত হচ্ছে?
ছবি : প্রথম আলো

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য ১০০ নম্বরের একটি বাধ্যতামূলক বিষয় রয়েছে। স্নাতকদের বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হতে হবে—এ যুক্তিতে বিষয়গুলো পাঠ্যতালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দুটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ১২ বছর ধরে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার পাঠ গ্রহণ করতে হয় সব শিক্ষার্থীকে। তারপরই কঠিন প্রতিযোগিতার বেড়া পেরিয়ে শুধু ‘মেধাবী’-দের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ হয়। এই মেধাবীরা ১২ বছরে কী শিখল? দ্বিতীয় প্রশ্ন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে ভাষার দক্ষতা যদি শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে না পারে, তবে ১০০ নম্বরের একটি বিষয় রেখে এই মৌলিক দক্ষতার ঘাটতি কতখানি পূরণ করা যাবে? ক্ষতি যে পোষানো যায় না, তার অহরহ প্রমাণ পাওয়া যায় কর্মজীবনে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্তদের যখন বাংলা বা ইংরেজি ভাষার দক্ষতা ব্যক্ত করার প্রয়োজন হয়।

বিশ্বব্যাংক পৃথিবীর নিম্ন আয়ের দেশগুলোর শিক্ষা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দারিদ্র্যের বিভিন্ন সূচকের সঙ্গে শিক্ষা-দারিদ্র্য নামে একটি সূচক যুক্ত করেছে। শিক্ষা–দারিদ্র্যের মাপকাঠি ধরা হয়েছে ১০ বছর বয়সে বা প্রাথমিক শিক্ষার সমাপ্তিতে কত শতাংশ মাতৃভাষায় (অথবা দেশের প্রধান ব্যবহারিক ভাষায়) নির্ধারিত পড়া ও লেখার দক্ষতা আয়ত্ত করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় অর্ধেকের বেশি (৫৬ শতাংশ) ছেলেমেয়ে এই দক্ষতা অর্জন করে না। বাংলাদেশের এই হার ৫৩। সরকারি উদ্যোগে শিক্ষার্থীর দক্ষতা যাচাইয়ের জরিপ থেকে এই হার নিরূপণ করা হয়েছে।

মাতৃভাষায় পড়া ও লেখার দক্ষতা শিক্ষা-দারিদ্র্যের মানদণ্ড ধরা হলো কেন? বিশ্বব্যাংকের যুক্তি পড়তে ও লিখতে পারা একটি ভিত্তিমূলক দক্ষতা—শিখতে শেখার দক্ষতা। এ দক্ষতা না থাকলে শিশু পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে না, ভাষা ছাড়া অন্য বিষয়গুলোও শিখতে পারে না। তারা ক্রমে পিছিয়ে পড়ে, শিশুদের বড় এক অংশ তখন ঝরে পড়ে। যারা টিকে থাকে, তারাও তখন আসলে কিছু শেখা বা বোঝার পরিবর্তে তোতাপাখির মতো মুখস্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। শিক্ষাবিদেরা আরও বলেন, শিশুর মনন, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তিশীলতার বিকাশের জন্য ভাষার দক্ষতা অপরিহার্য। মনের ভাবনার সুবিন্যস্ত প্রকাশ, কোনো বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণ, যুক্তির প্রয়োগে কোনো সমস্যার সমাধান—এ সবকিছুর জন্য ভাষার দক্ষতা প্রয়োজন। ব্রাজিলের বিশ্বখ্যাত শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরে যেমন বলেছেন, সাক্ষরতা শুধু শব্দ (ওয়ার্ড) পাঠ নয়, বরং বিশ্বকে (ওয়ার্ল্ড) পাঠ।

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে না পারা একটি বড় সমস্যা। কিন্তু সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধানের উপায় কি বিবেচিত হচ্ছে? সমস্যার মধ্যে আছে বাংলা ভাষা ও গণিতের মৌলিক দক্ষতাকে প্রাধান্য না দিয়ে অনেক বিষয়কে সমানভাবে দেখা। পাঠদানের মোট সময়ের স্বল্পতা এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে। অন্যান্য দেশে বছরে গড়ে এক হাজার ঘণ্টা পাঠদান করা হয়। বাংলাদেশে তা এই সময়ের অর্ধেকের কম।

আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ এক জনতোষণমূলক পদক্ষেপ হিসেবে ঘোষণা দেন, প্রথম শ্রেণি থেকে সব বিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াতে হবে। তদানীন্তন শিক্ষাসচিব মুজিবুল হকের কাছে শুনেছি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি শেখানোর শিক্ষক নেই এবং ব্যাপারটি প্রহসন হয়ে দাঁড়াবে—এসব যুক্তিতে কাজ হয়নি। বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে, সুতরাং সবাইকে ইংরেজি শেখার সুযোগ দিতে হবে। যদিও এ সিদ্ধান্ত প্রতারণার শামিল। এ ছাড়াও প্রাথমিক স্তরের সীমিত সময়ের বড় অংশ ইংরেজির জন্য ব্যয়ের অর্থ হচ্ছে বাংলা ও গণিতের জন্য যথেষ্ট সময় না দেওয়া।

এসব সমস্যার সঙ্গে আরেক বিপত্তি প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি পাঠ বাধ্যতামূলক করা। আশির দশকের আগে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি শুরু হতো এবং প্রাথমিক পর্যায়ে অক্ষর, সংখ্যা ও ছড়া-কবিতা দিয়ে ইংরেজির সঙ্গে পরিচয় করানো হতো। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির যোগ্য শিক্ষক দিয়ে ইংরেজি শেখানোকে উপযুক্ত সময় বলে বিবেচিত হতো।

আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ এক জনতোষণমূলক পদক্ষেপ হিসেবে ঘোষণা দেন, প্রথম শ্রেণি থেকে সব বিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াতে হবে। তদানীন্তন শিক্ষাসচিব মুজিবুল হকের কাছে শুনেছি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি শেখানোর শিক্ষক নেই এবং ব্যাপারটি প্রহসন হয়ে দাঁড়াবে—এসব যুক্তিতে কাজ হয়নি। বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে, সুতরাং সবাইকে ইংরেজি শেখার সুযোগ দিতে হবে। যদিও এ সিদ্ধান্ত প্রতারণার শামিল। এ ছাড়াও প্রাথমিক স্তরের সীমিত সময়ের বড় অংশ ইংরেজির জন্য ব্যয়ের অর্থ হচ্ছে বাংলা ও গণিতের জন্য যথেষ্ট সময় না দেওয়া।

জনতোষণ নীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি পদক্ষেপ নিলে তা থেকে পেছানো যায় না। তাই প্রাথমিকে ইংরেজি শিক্ষার যৌক্তিকতা বা প্রহসন নিয়ে কোনো আলোচনাই হয় না। সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, প্রাথমিকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ইংরেজির সংখ্যা, বর্ণমালা ও ছড়া-গানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে মাধ্যমিকে উপযুক্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও আধুনিক শিক্ষা উপকরণ দিয়ে ইংরেজি শেখানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিদ্যালয় শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত উচ্চমাধ্যমিকের শেষে বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থী বাংলা ও ইংরেজিতে যথার্থ দ্বিভাষিক দক্ষতা আয়ত্ত করবে।

সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য ইংরেজি শিক্ষার প্রশিক্ষণ আয়োজনের উদ্বোধনীতে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন জানান, সরকার প্রতিটি জেলায় ইংরেজি মাধ্যমের প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করবে। কোন যুক্তিতে, কাদের জন্য, কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা হচ্ছে, তা মোটেই বোধগম্য নয়। ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাজ ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসার। শিক্ষানীতিতে ও ব্যবস্থায় ইংরেজির স্থান কী হবে এবং কী অগ্রাধিকার দিতে হবে, সে বিবেচনা আমাদের সরকারকেই করতে হবে।

জীবন ও জীবিকার জন্য মাতৃভাষা বা দেশের প্রধান ভাষায় যথার্থ দক্ষতা অপরিহার্য। ফলপ্রসূ ও কার্যকর শিক্ষার জন্য মাতৃভাষার দক্ষতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। শিশু ও কিশোরদের মননশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য ভাষার দক্ষতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষা-দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের সূচনা হবে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে সব শিশুকে বাংলা ভাষায় দক্ষতা আয়ত্তের সুযোগ সৃষ্টি করা। মাধ্যমিকেও বাংলার দক্ষতা আরও সমৃদ্ধ করতে হবে এবং ইংরেজি দক্ষতার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের যুগে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অবস্থানের বিবেচনায় বাংলাদেশের সব শিক্ষিত তরুণকে বাংলা ও ইংরেজিতে দক্ষ হতে হবে। দ্বিভাষিক দক্ষতার এ লক্ষ্য সম্পূর্ণ অর্জনযোগ্য, যদি অগ্রাধিকার দিয়ে উপযুক্ত কৌশল গ্রহণ করে এগোনো যায়। দ্বিভাষিক দক্ষতার লক্ষ্য মাথায় রেখে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হবে বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তিবিষয়ক সব পাঠ্যপুস্তকে বাংলা পরিভাষার সঙ্গে ইংরেজি পদগুলোও বন্ধনীতে দিয়ে দেওয়া বা একটি বাংলা-ইংরেজি শব্দকোষ যুক্ত করা।

  • ড. মনজুর আহমদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইসিডি (প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ) নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান এবং গণসাক্ষরতা অভিযান কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান।