প্রকৃত শিক্ষা সত্য শেখায়। শিশুশিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায়েই সত্য–মিথ্যা, ভুল–শুদ্ধ শনাক্ত করতে শেখে। শৈশবেই তারা মিথ্যা থেকে সত্যকে, ভুল থেকে শুদ্ধকে টিক (√√) চিহ্ন দিয়ে আলাদা করতে শেখে। সঙ্গে ক্রস (X) চিহ্ন দিয়ে মিথ্যা ও ভুলকে বাতিল করতে শেখে। বড় হতে হতে তারা যুক্তির পথ ধরে এগিয়ে সত্যে পৌঁছাতে শেখে। তারা সরল থেকে ক্রমান্বয়ে জটিল ও জটিলতর সোপান পেরিয়ে সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে শেখে গণিত থেকে। পাঠ্যক্রমের অন্যান্য বিষয়ের মাধ্যমেও শিক্ষার্থীরা সত্য চিনতে এবং কোনো সমাধানে পৌঁছাতে শেখে। এটাই শিক্ষার যাত্রাপথ, এ পথে তারা যে গন্তব্যে পৌঁছায়, সেটাই শুদ্ধ ও সঠিক।
কিন্তু সমস্যা হলো, শিশুর এই শিক্ষার সঙ্গে সমাজের শিক্ষার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকছে না। সেই ব্রিটিশ আমলে প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলশিক্ষার শুরুর সময় থেকেই সন্তানের ভবিষ্যৎ স্বার্থ নিয়ে আকুল বাবারা (অধুনা মায়েরাও) স্কুলে ভর্তির সময় জন্মতারিখ ন্যূনপক্ষে এক বছর কমিয়ে মিথ্যা জন্মতারিখ তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। এই মিথ্যা এতই গা-সওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে কেউই এটা গায়ে মাখে না। অতিধার্মিক বাবা বা শিক্ষকও ভাবেন—শিশুটির ভবিষ্যতের চাকরি শুরু বা অবসরের ক্ষেত্রে একটু বাড়তি সুবিধা পেলে ক্ষতি কী। কিন্তু এভাবে গোড়া থেকেই শিশু বাস্তব জীবনে সত্যের সঙ্গে মিথ্যার গোঁজামিল বা সত্যের ওপরে মিথ্যারই জয় দেখতে থাকে। ইদানীং জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং জন্মসনদ স্কুলে ভর্তি হতে প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনেক অভিভাবক টিসির সময় বা এমনিতেই বছরের কোনো এক সময়, সম্ভবত কোনো বাস্তবজ্ঞানী হিতৈষীর পরামর্শে, শিশুর নতুন জন্মতারিখ রেকর্ড করতে চান। অবশ্যই আগেরটির চেয়ে বয়স কমিয়ে। তাদের এমন কাজের পেছনে কাজ করে সেই দুই শ বছরের মিথ্যা চর্চার অভ্যাস। এই চাহিদার ব্যাপকতা ও তীব্রতার কারণে দেখা যাচ্ছে টাকা খরচ করলে নতুন একটি সনদ তৈরি করে নেওয়া অসম্ভব নয়।
শিশু বড় হতে হতে দেখতে পায় কোনো দোকানদারই পণ্যের সত্য দাম বলেন না, তাঁরা একটু বাড়িয়ে বলেন, আর তার মা–বাবা বা সঙ্গী বড়জন অনেকটা কমিয়ে আরেকটি দাম বলেন। দর-কষাকষির এই অভিজ্ঞতা পণ্যের প্রকৃত দাম নিয়ে শিশুমনে একটা হেঁয়ালি তৈরি করে। সমাজে
সত্য-মিথ্যা, ভুল-শুদ্ধ, ন্যায়-অন্যায় নিয়ে সর্বক্ষণ হেঁয়ালি তৈরি হয়ে চলছে। স্বভাবতই শিশুর পক্ষপাত থাকে নিজের মা–বাবা আপনজনদের প্রতি।
তাতেই সে আশ্বস্ত ও স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আর বাস্তবতার চাপে একসময় শিশু আপনজনদের অনুকূলে সত্যকে জলাঞ্জলি দিতে শেখে, শেখে মিথ্যার সঙ্গে আপস করে নিতে। এই চালাকি তার শৈশবের সারল্য ও সততার অনেকটাই কেড়ে নেয়। এটা একটা সর্বনাশা পরিণতি।
শিশু গণিত বা সংগীত থেকে যে যুক্তিপরম্পরার স্বাচ্ছন্দ্যে অভ্যস্ত হয়, তার বিপরীত চিত্র দেখতে পায় পথে নেমে যানবাহনের চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে। সে দেখতে পায় সেখানে প্রত্যেক চালকের প্রাণপণ চেষ্টা থাকে যেকোনো উপায়ে আগে যাওয়ার বা এগিয়ে যাওয়ার। এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত চালকদের উত্তেজিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, এমনকি খিস্তিখেউর, মারপিটও তাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়। এসব বিশৃঙ্খলা ও গা-জোয়ারি মনোভাবের ধকল শরীরের মতো তাদের মনের ওপরও পড়ে। কিন্তু এ-ই যখন নিয়মে দাঁড়িয়ে যায়, প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে, তখন নিরুপায় শিশুমন এর সঙ্গে চলতে, আপস করতে বাধ্য হয়। তার মনের শৃঙ্খলাবোধ, যুক্তিপরম্পরার অকাট্যতার বোধ ও সর্বোপরি ন্যায়-অন্যায় বোধ ক্ষুণ্ন হতে থাকে।
বাজারে, অফিসে, বাড়িতে, হাসপাতালে, পথে, এমনকি ঘরে তাকে শুধু অনিয়ম-বিশৃঙ্খলাই সইতে হয় না, বড় হতে হতে সে আরও দেখে সত্য-মিথ্যা বা ভুল-শুদ্ধ কিংবা ন্যায়-অন্যায় নয়, নিজের ও স্বজনের সুবিধারই অগ্রাধিকার। তার চোখে দেখা সত্য অবলীলায় অস্বীকৃত বা ধামাচাপা পড়ে থাকতে, অন্যায় কাজ করে ক্ষমতাবান কিংবা বেপরোয়া মানুষদের পার পেয়ে যেতে দেখে দেখে তার মূল্যবোধের চেতনা গুলিয়ে যায়, চরিত্র বা নৈতিকতার শক্ত জমিন তৈরি ব্যাহত হয়। মূল্যবোধ সমাজবাস্তবতার চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে থাকে। আমরা সবাই জানি, রাজনীতিতে একটু ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কথা বলার রেওয়াজ আছে, বিশেষত মেঠো বক্তৃতায়। কিন্তু যেখানে ব্যক্তিগত লাভের চিন্তাই প্রধান,ÿ ক্ষমতাবানেরা ভোগ করে বিপুল ÿক্ষমতা, সেখানে মূল্যবোধগুলো হেঁয়ালির নিচে পথহারা, সেখানে তোষামোদেই কাজ দেয়। চাটুকারী ভাষার তোড়ে ক্রমেই সত্য থেকে বাস্তবতা দূরে সরে যাচ্ছে। আর যে সমাজে রাজনীতির ভূমিকা ব্যাপক ও প্রবল, সেখানে এ রকম অসত্য-বাস্তবতার প্রকোপ থেকে শিশুমনও রেহাই পায় না। তাদের শিক্ষার্থী-মানসের বিভ্রান্তি বাড়তে থাকে। এসবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুমানস। তার সহজাত সারল্য ও সততার পুঁজি গোড়াতেই স্রোতের মতো খরচ হয়ে যেতে থাকে। মূল্যবোধের পুঁজি হারিয়ে ফতুর হওয়ার কারণে একটু বড় হতেই তার শিশুসুলভ মানস গভীর সংকটে পড়ে যায়।
এভাবে দোটানার মধ্যে কাটে যে জীবন, তার সত্য-মিথ্যা, ভুল-শুদ্ধের নিরপেক্ষ বোধ ক্রমে ভোঁতা হয়ে যেতে থাকে। সে বরং এই চালাকিও শেখে যে নিজের ও নিজেদের সুবিধাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং তা দিতে হবে যেকোনো মূল্যে। এভাবে আমাদের সমাজের ভোঁতা মূল্যবোধ গুরুত্ব হারিয়ে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এই বাস্তবতায় কোনো বিষয়ই বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার উপাদান নয়, শিক্ষার্থী-শিক্ষক উভয়ের লক্ষ্য তো এক: পরীক্ষা আর জিপিএ–৫। তার জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বাজি ধরতে, সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে পিছপা হয় না অনেকে। এরই জের ধরে আমরা পরীক্ষা ঘিরে নকল থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো নানা অপরাধ ঘটতে দেখেছি। এসব প্রতিরোধের জন্য নানা কৌশল, কঠোর আইন, কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হলো। হয়তো তাতে ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না, বা সেগুলো কমবে, কিন্তু সমাজের মিথ্যা—কখনো ডাহা মিথ্যা, কখনো ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে অতিকথনের মিথ্যা—সে তো দূর হচ্ছে না। শিশুর সঠিক মানসগঠনের সংকট তো থেকেই যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার ঘোষণা দিয়েই জ্ঞানভিত্তিক, মেধাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। সবাই নিশ্চয় বুঝি জ্ঞানের সঙ্গে সত্যের সম্পর্ক নিবিড়। নানা ভুলভ্রান্তি, মিথ্যা ধারণা ও বিশ্বাসের আবরণ সরিয়ে শিক্ষা মানুষকে সত্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে। তাই প্রশ্ন হলো, মিথ্যার আড়াল তৈরি করার অভ্যাস বজায় রেখে জ্ঞানের পথে এগিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? আমাদের মনে হয় সম্ভব নয়। মিথ্যার অপ্রতিহত রাজত্ব চলতে পারছে বলেই মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, অধিকার রক্ষার গুরুত্ব মূল্য পাচ্ছে না। নানাভাবে প্রতিদিনের জীবন গ্লানিময় হয়ে উঠছে।
সব সমাজেই কিছু মিথ্যা, কিছু অতিকথনের মিশেল থাকে, কিন্তু সমাজ সংকটে পড়ে যায় যদি তা মাত্রা ছাড়িয়ে সত্যকে আড়াল ও অকেজো করে ফেলে। আমরা সে রকম একটা সংকটে পড়েছি। কিন্তু এ নিয়ে উদাসীন বা নিশ্চেষ্ট থাকার উপায় নেই। কারণ, বর্তমান ব্যবস্থায় উচ্চ ডিগ্রিধারী দক্ষ কর্মী কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব হলেও সমাজের মানবিক সংকট পিছু ছাড়বে না। দুর্নীতি, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ ক্রোধ, অসহিষ্ণুতা, স্বার্থান্ধতা, স্বজনতোষণ ইত্যাদি শুধু কঠোর আইন ও তার কঠোরতর প্রয়োগে দূর হবে না। ক্রসফায়ারে ‘অপরাধী’ মেরেও এসব ব্যাধি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না; চালাকির বা অপরাধের রকমফের ঘটতে পারে মাত্র।
আসল প্রতিষেধক হলো শিশুকে সৎ থাকা ও সত্য বোধের পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য না করা। শিশু যদি এটাই শেখে যে সত্য-মিথ্যা, ভুল-শুদ্ধ, ন্যায়-অন্যায় পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি বিষয়, তা কেবল পরীক্ষার খাতায় কাজে লাগে, কিন্তু বাস্তবের সত্য-মিথ্যা ভিন্ন, তাহলে শিক্ষার্থী তার শিক্ষাকে কেবল পরীক্ষার বিষয়ই ভাবতে শিখবে, জীবনের শিক্ষা আলাদা বলে জানবে। এমন মানসিকতা প্রকৃত শিক্ষার্থী তৈরি করে না, যার নজির আমরা উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে অজস্র দেখছি। এমন সমাজ প্রকৃত জ্ঞানচর্চার উপযোগী নয়, এ অভিজ্ঞতা সর্বস্তরের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট সবার কমবেশি হচ্ছে।
শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কেবল নানা কর্মসূচি প্রণয়ন করলে হবে না, প্রকৃত শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ তৈরির কাজকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
আবুল মোমেন, কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক