ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তিতে সব শিক্ষার্থীর জন্য স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন একটি যুগান্তকারী ঘটনাই বলা চলে। এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাধুবাদ জানাই। এটি বাংলাদেশের বিমা খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের সব খাতের ব্যাপক উন্নতি হলেও বিমা খাতের, বিশেষ করে স্বাস্থ্যবিমার চিত্র খুবই করুণ। অথচ এই খাতে রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। এ খাতের উপযুক্ত বিকাশ হলে ব্যাংকিং খাতের চেয়েও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। সারা পৃথিবীতে বিমা একটি অত্যন্ত সম্মানজনক পেশা। কিন্তু বাংলাদেশে এই পেশা অত্যন্ত অবহেলিত এবং সামাজিক মর্যাদায়ও এর কোনো স্থান নেই। বিমা মানেই এ দেশের মানুষের কাছে প্রতারণা ও হাস্যরসের উৎস। এর দায় একদিকে যেমন বিমা কোম্পানিগুলোর, অন্যদিকে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থারও। এই বিশাল নেতিবাচক ধারণা কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, তা নিয়ে গবেষণার একপর্যায়ে মনে হলো উদ্ভাবনী উপায় ছাড়া প্রচলিত প্রচার-প্রচারণা দ্বারা মানুষকে বিমায় আকৃষ্ট করা যাবে না। বিমাশিল্পকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কিছু অ্যাম্বাসেডর দরকার, যাদের আগে বিমার স্বাদ আস্বাদন করাতে হবে। আর এ জন্যই প্রথমে বেছে নেওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিমার আওতায় আনতে পারলে একদিকে যেমন তাঁদের স্বাস্থ্যের ব্যয় নির্বাহ করা সহজ হবে, অন্যদিকে তাঁরা বিমা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবেন। ফলে কর্মক্ষেত্র এবং তাঁদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের জন্য স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনে উৎসাহী হবেন তাঁরা। আজকের শিক্ষার্থীই ভবিষ্যতে দেশের সব স্তরে নেতৃত্ব দেবেন। ফলে সমাজের সব মানুষের জন্য ২০৪১ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনের পথ সুগম হবে। আর এই প্রত্যাশা নিয়েই ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের তিন শতাধিক শিক্ষার্থীকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় এনে দেশে বিমাশিল্প উন্নয়নের একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করা হয়। এর প্রস্তুতি পর্ব থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্য অনুষদের তৎকালীন ডিন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন।
এটি চালুর পরপরই স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগ এবং ইনস্টিটিউটকে চিঠির মাধ্যমে তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালুর অনুরোধ করা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে উপাচার্যদের এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে অনুরোধ করে চিঠি প্রেরণ করা হয়। প্রথমেই সাড়া দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ। এ বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান নাজমা বেগম স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের বিমা চালুর প্রস্তুতি পর্বের বিভিন্ন প্রোগ্রামে এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ফলে অর্থনীতি বিভাগ স্বল্প সময়ে প্রস্তুতি নিয়ে ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য বিমা চালুর ঘোষণা দেয়, যদিও তা এক বছর পর চালু হয়। ওই অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য মো.আখতারুজ্জামান প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তিতে সব শিক্ষার্থীকে বিমার আওতায় আনা হবে মর্মে এক সাহসী ঘোষণা দেন। আর এই ঘোষণাকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার বীজতলা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আমরা আশা করি, বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনও এ বিমা কার্যক্রম সফল করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পাশে এসে দাঁড়াবে। আর এভাবে সম্মিলিত প্রয়াসে এ বিমা শতভাগ সফল হোক। এর আর্কিটেক্ট হিসেবে এটাই আমার প্রত্যাশা।
পরবর্তী সময় ইতিহাস বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান আহমেদ আবদুল্লাহ জামাল তাঁর বিভাগের পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য ২০১৮ সালের মার্চ মাসে এ বিমার প্রচলন করেন। পরবর্তী সময় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগসহ বেশ কিছু বিভাগ তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য এই বিমা কর্মসূচি চালু করে। বিগত ডাকসু নির্বাচনের প্রাক্কালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সব শিক্ষার্থীর জন্য স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়। ফলে ছাত্রলীগের নির্বাচনী ইশতেহারে স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনের বিষয়টি স্থান পায়। এসব ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২০২০ সালের জুন মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর জন্য স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনের লক্ষ্যে মাননীয় কোষাধ্যক্ষকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করে। আর এ কমিটির সম্মানিত সদস্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের আন্তরিকতায় সব শিক্ষার্থীর জন্য এই স্বাস্থ্যবিমা চালু হলো, যা এক কথায় যুগান্তকারী।
তবে স্বাস্থ্যবিমা বিষয়ে গত দুই দশকের গবেষণা এবং নিজ হাতে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে বিমা সুবিধা প্রদান করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। আর এই চ্যালেঞ্জকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারলে একদিকে যেমন যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ইতিহাসে স্মরণীয়-বরণীয় হবে, অন্যদিকে যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে এই বিমা প্রবর্তন করা হলো, তা সফল হবে। আর তা না করতে পারলে ভবিষ্যতে বড় পরিসরে স্বাস্থ্যবিমা চালুর স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ধূলিসাৎ হবে, যা নিশ্চয়ই যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি চায় না। তাই এর জন্য কিছু প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। প্রথমটি হলো, বিমার আওতায় কী কী সুবিধা রয়েছে ও কীভাবে তা পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ব্যাপকভাবে সচেতন করা।
উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট কর্তৃক বিমা চালুর পর বিমা দাবির উপযুক্ত বেশ কিছু শিক্ষার্থী বিমা দাবি থেকে বিরত থাকেন। পরবর্তী সময় তাঁদের বোঝাতে সক্ষম হই যে এটি তাঁদের অধিকার ও শিখনের অংশ। যদিও কোভিড-১৯-এর জন্য পরিস্থিতি হয়তো অনেকটা পাল্টেছে, তবুও কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে এবং কীভাবে তা পাওয়া যাবে এ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দরকার। আর এর জন্য প্রতিটি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের উদ্যোগে এক বা একাধিক সেশন আয়োজনের পাশাপাশি একজন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা যেকোনো সময় বিমাসম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারেন। পাশাপাশি অনুষদ ভবনগুলো, টিএসসিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অস্থায়ী বুথ খোলা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যানার, পোস্টার, লিফলেটসহ এসব বুথে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োজিত করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানে সব সময় প্রস্তুত। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট ওয়েবপেজে এ-সংক্রান্ত অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট আপলোড করা যেতে পারে। পাশাপাশি এ-সংক্রান্ত একটি অ্যাপ তৈরি করা যেতে পারে। এসব কাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যমুনা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে সর্বাত্মকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
সারা পৃথিবীর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, স্বাস্থ্যবিমা থেকে সাধারণত মুনাফা অর্জন করা যায় না। আর শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্প প্রিমিয়ামের এই বিমা থেকে তো নয়ই। তাই আমরা মনে করি যমুনা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি মুনাফার জন্য নয় বরং বিমাশিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ব্রত নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। তাই শিক্ষার্থীদের বিমা দাবির জন্য উপযুক্ত অনলাইন সিস্টেম তৈরি করা দরকার, যাতে কোনো শিক্ষার্থী বিমা দাবির প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হন। অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিমা সুবিধা প্রদানের সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি হলো ‘ক্যাশলেস’ পদ্ধতি চালু করা অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা তাঁদের বিমা সুবিধার লিমিট শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের পকেট থেকে কিছুই খরচ করবেন না। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল সরাসরি বিমা কোম্পানির কাছে বিল দাবি করবে। এই সুবিধা চালু থাকলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য খরচের অর্থায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না।
অন্যদিকে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি পার্চেজার হিসেবে দর-কষাকষির মাধ্যমে সেবা মূল্য কমিয়ে আনতে পারবে। ফলে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি উপকৃত হবেন। তাই যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির উচিত নেতৃস্থানীয় ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মতো ঢাকা শহরের কমপক্ষে মধ্যম ক্যাটাগরির কিছু হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া, যাতে শিক্ষার্থীরা ক্যাশলেস সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হন। তবে পাশাপাশি সনাতনী রিইমবার্সমেন্ট পদ্ধতি চালু থাকা দরকার, যাতে শিক্ষার্থীরা তাঁদের পছন্দমতো হাসপাতাল থেকে সেবা নিতে পারেন এবং ছুটিতে নিজ এলাকায় বা অন্য কোথাও গেলে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে বিমা দাবি পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে।
আশা করি, যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে এই বিমা কার্যক্রমকে সফল করে তুলবে। আর এ কাজে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট সর্বদা আপনাদের পাশে থাকতে প্রস্তুত আছে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনও এ বিমা কার্যক্রম সফল করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পাশে এসে দাঁড়াবে। আর এভাবে সম্মিলিত প্রয়াসে এ বিমা শতভাগ সফল হোক। এর আর্কিটেক্ট হিসেবে এটাই আমার প্রত্যাশা।
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়