‘শিক্ষাবিদ’ বলে একটি সম্মানজনক অভিধা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রায়শ এই অভিধায় ভূষিত হন। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন কোন অবদানের জন্য কোন ব্যক্তি এই সম্মানজনক অভিধা পেতে পারেন, তার কোনো নির্দিষ্ট শর্ত নেই। এমনকি শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাবিজ্ঞানী বা শিক্ষাতত্ত্ববিদ যে আলাদা বিষয়, তারও ভিন্নতাজ্ঞাপক মাপকাঠি নেই। ফলে শিক্ষাবিদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয় সবাইকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য শিক্ষাবিজ্ঞানীদের। এঁরা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন বা পরিমার্জন করেন, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন নীতিমালা তৈরি করেন, শিখন-শেখানোর উপকরণ—বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেন, শিখন-শেখানোর কৌশল নির্ধারণ করেন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নীতিমালা তৈরি করেন। এ ছাড়া শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করাও শিক্ষাবিজ্ঞানীদেরই দায়। অর্থাৎ শিক্ষাবিজ্ঞানীরা একটি দেশের মানসম্পন্ন শিক্ষার দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। আর জাতীয় পর্যায়ে অপরিসীম দুর্ভাগ্য আর সহকর্মীদের কাছ থেকে বিপুল সম্মান নিয়ে ৮৫ বছর বয়সে বিদায় নিলেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিক্ষাবিজ্ঞানের পুরোধা পুরুষ মুহাম্মদ আবদুল জব্বার—আমাদের প্রিয় জব্বার স্যার।
মুহাম্মদ আবদুল জব্বার ১৯৩১ সালে ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, আনন্দ মোহন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যয়ন করেন। ১৯৫২-৫৩ সালে রসায়নে অনার্স-মাস্টার্স করলেও গোটা জীবন তিনি কাটিয়ে দেন শিক্ষাবিজ্ঞান চর্চায়। এর জন্য তাঁকে বিটি (বিএড) করতে হয়েছে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে (১৯৫৬) এবং ১৯৬১ শিক্ষায় এমএ করতে হয়েছে আমেরিকার নর্দার্ন কলরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৪২ বছর অসাধারণ নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
১৯৭৫ সালের ২৫ অক্টোবর ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটির তিনি ছিলেন সদস্যসচিব। অধ্যাপক মুহম্মদ শামস-উল হক ছিলেন এই কমিটির চেয়ারম্যান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সহকর্মীদের হত্যার পর যে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যেখানে স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী সরকারগুলো পাকিস্তানি আদর্শের দিকেই ফিরে গিয়েছিল। সেই সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের মৌল আদর্শগুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে প্রতিফলিত হয়নি। কিন্তু মুহাম্মদ আবদুল জব্বারের তত্ত্বাবধানে যে রিপোর্ট প্রণীত হয়, সেখানে একজন শিক্ষাবিজ্ঞানী হিসেবে শিক্ষাতত্ত্বের আদর্শকে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছেন।
১৯৭৭ সাল থেকে এই কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। এ সময় সদস্যসংখ্যা ছিল ৫১। ১৯৮৬ সালে পরিমার্জিত যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয় তারও সদস্যসচিব ছিলেন জব্বার স্যার। ১৯৯৩ সালে শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, সেখানে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি তৈরি করা হয়। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন মুহাম্মদ আবদুল জব্বার আর সদস্যসচিব ছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ আলী। দীর্ঘদিন পর জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে ২০১১ সালে যখন প্রাক্-প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও পরিমার্জনের বিপুল কর্মযজ্ঞ গ্রহণ করা হয়, তখন মুহাম্মদ আবদুল জব্বার অশীতিপর বৃদ্ধ। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, পুরো কর্মযজ্ঞের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বিপুল সেই কর্মযজ্ঞের সময় আমরা এই শিক্ষাবিজ্ঞানীর অভিভাবকত্বের আশ্রয় থেকে কখনোই বঞ্চিত হইনি। তাঁর বিস্ময়কর পাণ্ডিত্য, অসাধারণ প্রজ্ঞা ও সহনশীলতা, সহকর্মীদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ পুরো কর্মযজ্ঞটিকে আনন্দময় করে তুলেছিল।
মুহাম্মদ আবদুল জব্বার কত বিষয়ে যে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন, তার ইয়ত্তা নেই। বিশেষ করে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন বা পরিমার্জন, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন নীতিমালা, শিখন-শেখানোর উপকরণ—বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, শিখন-শেখানোর কৌশল নির্ধারণ এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নীতিমালা ও শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন-কৌশল বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। কিন্তু তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্য তাঁকে কখনোই অহংকারী করে তোলেনি। অধিকন্তু তিনি নিরহংকারী মানুষ এবং সাধারণের চেয়েও সাধারণ। প্রাচীন ঋষিদের মতো তিনি অতিসাধারণ ও সহজ-সরল জীবনযাপন করে গেছেন। কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে তিনি বিনয়ের সঙ্গে এতটাই দৃঢ়তার পরিচয় দিতেন যে আত্মম্ভরি লোকজনও সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর যুক্তি মেনে নিতেন।
হ্যাংলা-পাতলা আর ছোটখাটো এই মানুষটিকে প্রথম দেখায় শ্রদ্ধাভক্তি করার কারণ ছিল না। একটি ছাতা আর একটি কাপড়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে কুঁজো হয়ে তিনি হাঁটতেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে উত্তরা থেকে পাবলিক বাসে চড়ে তিনি চলে আসতেন মতিঝিলে অবস্থিত ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ ভবনে। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যত ধরনের কর্মকাণ্ড চলে, তার প্রায় প্রতিটিতেই তিনি অংশ নিতেন। কোনো রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া শুধু তাঁকে টেলিফোনে জানালেই হতো। অসাধারণ সময়নিষ্ঠ এই মানুষটি যথাসময়ে এসে উপস্থিত হতেন। পথের ঝক্কিঝামেলার অজুহাত দিতেন না কখনোই। শারীরিক অসুস্থতার কথাও আমরা শুনিনি।
অনুষ্ঠানে তিনি কখনোই মুখর হয়ে উঠতেন না। বরং খুব মনোযোগের সঙ্গে আলোচকদের কথা শুনতেন। তাঁর যদি মনে হতো আলোচনা ঠিকভাবে এগোচ্ছে না কিংবা কোনো আলোচক সঠিক বলছেন না, তাহলে বিনয়ের সঙ্গে বলতেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, ঠিকই আছে সব। তবে...।’ এই বলে তিনি তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। ‘তবে’ বলে যখন তিনি শুরু করতেন, তখন আমরা বুঝে যেতাম যে আমাদের ধারণা মোটেই ঠিক নয়। ছোট-বড়, দক্ষ-অদক্ষ, অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ সবাইকে তিনি সম্মান করে কথা বলতেন। কারও বক্তব্যকে তিনি ছোট বা গুরুত্বহীন বলে মনে করতেন না। বাংলাদেশের শিক্ষাবিজ্ঞানের জগতে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তার জন্য তিনি অনেক সম্মান, মর্যাদা ও স্বীকৃতি পেতে পারতেন। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে সেই স্বীকৃতি তিনি পাননি।
এই মহান ব্যক্তির তিরোধানে শিক্ষাবিজ্ঞান চর্চার একটি জ্ঞানভান্ডার হারিয়ে গেল, যা আর কখনোই ফিরে আসবে না।
ড. সরকার আবদুল মান্নান: সদস্য, এনসিটিবি।
drsharkaramannan@yahoo.com