জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের তরফ থেকে স্কুল খুলে দেওয়ার আহ্বানের মধ্যেই সরকার করোনাজনিত বন্ধ দুই সপ্তাহ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের বিবেচনায় সবার নিরাপত্তার বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মিল না থাকলেও মনে হচ্ছে, এ মাসের শেষ সপ্তাহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাবে ও বাস্তবে ক্লাস হবে।
এর মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, পরীক্ষার ফল খুবই ভালো। সামগ্রিক বিচারে পাসের হার ৯৫। কিন্তু পরীক্ষা হয়েছে তিনটিমাত্র বিষয়ে, শ্রেণির মূল্যায়ন যুক্ত হলেও তার যাথার্থ্য নিয়ে সংশয়-সংকট রয়েছে। তদুপরি উচ্চশিক্ষার সোপান হিসেবে পরিচিত এ পরীক্ষা এত সংক্ষিপ্ত আকারে ও হালকাভাবে হওয়া উচিত কি না, তা গভীরভাবে ভাবার বিষয় বলেই মনে করি।
আমাদের মনে হয়, দীর্ঘ বন্ধের ফলে শিশু থেকে তরুণ—সব শিক্ষার্থীরই মনোদৈহিক সংকট বেড়েছে। এর একটি দৃষ্টান্ত হলো গত এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতাধিক আত্মহত্যার ঘটনা। আর বিভিন্ন সূত্রে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মারাত্মক শারীরিক-মানসিক অসুস্থতার খবর জানা যাচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঝুঁকি এবং বন্ধ রাখার পরিণতির মধ্যে কোনটি মন্দের ভালো সিদ্ধান্ত, তার বিচারই জরুরি। অভিজ্ঞতা বলছে, শিশুদের মধ্যে করোনার মারাত্মক পরিণতি খুবই কম। কিন্তু দীর্ঘ বন্ধের প্রভাব তাদের সবার জীবনে খুবই নেতিবাচক। ফলে মাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের টিকা জোরদার করে এবং সব শিক্ষকের দুই ডোজ নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত খোলাই হবে ভালো। এ প্রস্তাব সম্ভবত অধিকাংশ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আমরা বলব, করোনা পরিস্থিতির ওঠানামার মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার গুরুত্ব মাথায় রেখে টিকা কার্যক্রমের নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত সব দিক বিবেচনায় নিয়ে, বিশেষভাবে দেশের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই নিতে হবে। মনে রাখতে বলব, বর্তমান অবস্থায় দুই বছরে শিক্ষার সব পর্যায়েই যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তা ঠেকানো ও পুষিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার কথাও মাথায় রাখতে হবে।
এ কথা একটু বলে নেওয়া দরকার যে বন্ধের মধ্যে অনলাইন বা অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক যে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে, তা কোনোভাবেই বাস্তব ক্লাসের প্রাপ্তি মেটাতে পারেনি, তা পারার কথাও নয়। অনেকের পক্ষে এতে যুক্ত হওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। অনলাইন পদ্ধতির স্বাস্থ্যগত নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কেও সচেতনতা প্রয়োজন এবং এ ক্ষতির সঙ্গেও করোনার ঝুঁকির তুলনা করা যেতে পারে।
আমরা বলব, করোনা পরিস্থিতির ওঠানামার মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার গুরুত্ব মাথায় রেখে টিকা কার্যক্রমের নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত সব দিক বিবেচনায় নিয়ে, বিশেষভাবে দেশের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই নিতে হবে। মনে রাখতে বলব, বর্তমান অবস্থায় দুই বছরে শিক্ষার সব পর্যায়েই যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তা ঠেকানো ও পুষিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার কথাও মাথায় রাখতে হবে।
২.
বহু বছর ধরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার কথা আলোচিত হচ্ছে। এই শিক্ষা দিনে দিনে পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাই এ ব্যবস্থাও মুখস্থবিদ্যানির্ভর হয়ে গেছে। ফলে মৌলিক কিছু চিন্তার শক্তি এবং তা নিজের ভাষায় প্রকাশের দক্ষতা অর্জিত হয় না; বরং এ অবস্থায় যুক্তি বিবেচনার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চায় অগ্রসর হওয়ার কোনো চাহিদাও তৈরি হয়নি, সুযোগও নেই। এ এক বন্ধ্যা নিষ্ফল ব্যবস্থা। আর শিক্ষার গোড়া থেকেই নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করার অভ্যাস তৈরি হওয়ার ফলে এই শিক্ষার্থীরা সেই ধারাই উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যায়। তাতে উচ্চতর পর্যায়েও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা যতই মানসম্পন্ন প্রাণবন্ত আনন্দদায়ক শিক্ষার কথা বলি না কেন, তা এ ব্যবস্থায় মিলবে না।
অবশেষে এই বাস্তবতা থেকে সরে আসা এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি নতুন ব্যবস্থার পথে এগোচ্ছে। চলতি বছর এর পাইলটিং হচ্ছে নির্বাচিত ৬২টি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে। এই পদ্ধতি পুরোনো ধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যত দূর জানা গেছে, অতীতের শিক্ষককেন্দ্রিক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে এটি হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি। শিক্ষকের ভূমিকা হবে মূলত শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পথে এই অভিযাত্রার সহায়তাকারীর, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ফ্যাসিলিটেটর। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নির্ধারিত বিষয় থাকবে ১০টি। আর প্রতি বিষয়ে শ্রেণিভিত্তিক কয়েকটি যোগ্যতার মাপকাঠি থাকবে, যা বছরব্যাপী চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থী অর্জন করবে। এই অর্জনের পথ হবে শিক্ষার্থীর নানান অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতার পথ যেমন তারাও খুঁজে নেবে, তেমনি শিক্ষকও তাতে সহায়তা করবেন। শিক্ষার্থীদের সহায়ক পুস্তকে থাকবে মূলত যোগ্যতাভিত্তিক অভিজ্ঞতার কিছু নমুনা, যা ছাত্ররা অনুসরণ করবে। তবে যেহেতু অভিজ্ঞতা, তাই প্রত্যক্ষ কাজের মধ্য দিয়েই তাদের তা অর্জন করতে হবে। এই যাত্রাপথে পদে পদে সৃজনশীলতার চ্যালেঞ্জ থাকবে। তা-ই তাদের সামনের পথ পাড়ি দিতে প্রণোদনা জোগাবে। এভাবে ক্রমেই শিক্ষার্থীরা নিজের গরজে ও পথচলার আনন্দেই এগোতে থাকবে। একসময় পাঠক্রমে নির্ধারিত যোগ্যতাগুলোও অর্জিত এবং পাঠের অংশও পড়া হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, অনেকের মনে নিশ্চয় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, পরীক্ষার কী হবে, কীভাবে হবে পরীক্ষা? না, দশম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষার আগে গতানুগতিক ধারার পরীক্ষা আর থাকবে না, এর পরিবর্তে শ্রেণিকক্ষে কার্যক্রমের অব্যাহত মূল্যায়ন থাকবে। বছর শেষে এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ফলাফল পাবে। তাতে প্রত্যেকের বিষয়ভিত্তিক সবলতা-দুর্বলতার বিবরণীও লেখা থাকবে।
৩.
এটি যেহেতু একেবারে মৌলিকভাবে ভিন্ন বা নতুন যাত্রা হবে, তাই রাতারাতি পুরো শিক্ষাব্যবস্থা এর আওতায় আনা যাবে না। সংশ্লিষ্ট সবার প্রস্তুতি, অবহিতি, অভ্যস্ততার জন্য সময় নিতে হবে। শিক্ষকদের কেবল নতুন ধারা অবহিত বা জানাবোঝা হলেই চলবে না, পুরোনো পদ্ধতি ও অভ্যাস থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে কাজটা যতটা সহজ হবে, বড়দের জন্য তা হবে না। তাই তাদের সময় দিতে হবে। এ বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আগামী বছর পাইলট প্রকল্পের আওতায় শ্রেণি ও স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে হবে যাতে পরের বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত নতুন ব্যবস্থা চালু করা যায়।
এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ, যার প্রস্তুতিমূলক কাজ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড শুরু করে দিয়েছে বেশ আগেই। তবে গত সেপ্টেম্বরে প্রস্তাবিত এ ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করার পরই কাজ জোরেশোরে শুরু হয়েছে। এটুকু সময় প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত নয়, তাই এ বছর চার মাস ভিত্তিতে তিন কিস্তিতে সংশ্লিষ্ট সহায়ক গ্রন্থগুলো তৈরি ও সরবরাহ করা হবে। পাইলট প্রকল্পের জন্য তৈরি সহায়ক গ্রন্থগুলোও এক অর্থে পরীক্ষামূলক খসড়া, বাস্তবে প্রয়োগ করে এগুলোর চূড়ান্ত রূপ প্রদান করতে হবে। ফলে একতরফা সমালোচনার চেয়ে আগ্রহী মানুষ এবং শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শই এ পর্যায়ে কাজে লাগবে।
আমাদের বর্তমান গতানুগতিক ব্যবস্থা যে পাল্টাতে হবে, সে কথা বহুকাল ধরে আলোচিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে অনেক উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে, নতুন নতুন বিষয় ও পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল, এমনকি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ্যে প্রচলিত ধারণা হলো এখানে কেবল নতুন নতুন পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
আমরা বলব, এখন আর মেরামতি কিংবা গোঁজামিল দিয়ে কাজ হবে না। একটা নতুন কার্যকর ব্যবস্থাই চালু করতে হবে। নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। শুধু শেষে যোগ করব একটি কথা, এই ব্যবস্থা শিক্ষার এক মহা প্রকল্প, সরকার অবকাঠামো নির্মাণে যেমন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তেমনি আজ শিক্ষায়ও মহাপ্রকল্পের দাবি পূরণ জরুরি। অবকাঠামোর গুরুত্ব অনস্বীকার্য, কিন্তু সেই সঙ্গে মানতে হবে, যেকোনো দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানবসম্পদের উন্নয়ন। আজ বেশ কিছুকাল ধরে মানসম্পন্ন শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে। এখন সময় এসেছে তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণের এবং সেদিক থেকে নতুন রূপরেখায় পরিবর্তিত শিক্ষাক্রম ও পদ্ধতির প্রতি আশা নিয়ে তাকানো যায়।
আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক