শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে শিক্ষাক্রম তৈরি এবং তা পরিমার্জন করা হয়। শিক্ষাক্রমের সব উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য এর ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন জরুরি। উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষাক্রমকে তিনটি প্রধান ধাপ অতিক্রম করতে হয়। যথা: ১) প্রত্যাশিত, ২) বাস্তবায়িত এবং ৩) অর্জিত শিক্ষাক্রম।
শিক্ষাক্রম যতবার পরিমার্জন করা হয়, ততবারই এর উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্যে কমবেশি পরিবর্তন আনা হয়। এসব পরিবর্তন সম্পর্কে শিক্ষাক্রম বিশদ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের ভালোভাবে অবহিত করতে হয়। পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের অর্জনে সহায়ক শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া বর্ণনা করে শিক্ষক-নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগে শিক্ষকদের শিক্ষাক্রম প্রশিক্ষণ দিলে এবং শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের ‘পাঠ্য’ শিক্ষক-নির্দেশিকা সরবরাহ করা হলে শিক্ষাক্রমের আকাঙ্ক্ষার ডাইল্যুশন বা ‘সিস্টেম লস’ বহুলাংশে কমিয়ে আনা যায়।
বর্তমান যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে আগের উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রমে বিধৃত উদ্দেশ্যাবলির ওপর প্রধান তিনটি উপাদান অতিরিক্ত যুক্ত হয়েছে; যথা: ১) মাস্টারি লার্নিং (শিক্ষণীয় বিষয়ের পুরোটা শেখা), ২) শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় সব শিক্ষার্থীর বিচিত্র চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং ৩) শিখনকালীন অবিরত মূল্যায়নের মাধ্যমে সব শিক্ষার্থীর প্রয়োজনমতো নিরাময় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার এসব শর্ত মেনে চললে এই স্তরে ‘সিস্টেম লস’ অনেক কমানো সম্ভব। এর জন্য শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এমন হতে হবে যাতে শিক্ষক প্রত্যেক শিক্ষার্থীর চাহিদার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে সব কটি আবর্তনেই বেশ যত্নের সঙ্গে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করা হলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রম প্রাথমিক স্তরে ১৯৭৮ সালে বাস্তবায়ন শুরু করা হয় শিক্ষকদের শিক্ষাক্রমের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত না করিয়েই; ১৯৮০ সালে শুধু শিক্ষক প্রশিক্ষক ও পরিদর্শকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শিক্ষকদের কাছে নির্দেশিকা পৌঁছায় ১৯৮১ সালে।
সেবার নিম্নমাধ্যমিক বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তকে ‘এসো নিজে করি’ শীর্ষক পরীক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষাকে অনুসন্ধানমূলক করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দিয়ে বাস্তবায়ন শুরু (১৯৮১) করায় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষাগুলো সম্পাদন করতে পারছিল না। এতে শিক্ষার অংশীজনেরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। পরের দুই বছরে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়; কিন্তু প্রতিবাদের ঝড় সামলাতে সরকার এত দিনে ব্যবস্থাটি বাতিল করে পাঠ্যপুস্তকে পরীক্ষার (প্রথমে ঊহ্য রাখা) সম্ভাব্য ‘ফলাফল’ ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয় আবর্তনের শিক্ষাক্রম প্রাথমিক স্তরে ১৯৯১ এবং মাধ্যমিক স্তরে ১৯৯৬ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়। সে বছরই জুন মাসের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম বিস্তরণ প্রশিক্ষণ হয়। বাস্তবায়নের যৌক্তিক প্রক্রিয়া পুরোপুরি না হলেও সেবার অনেকটা অনুসৃত হয়েছিল।
দেশে তৃতীয়বার শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করা হয় ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’-এর মতো উত্তম নীতিমালার আলোকে ২০১১- ১২ সালে। কিন্তু একসঙ্গে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক তাড়াহুড়ো করে রচনা করে শিক্ষক-নির্দেশিকা তৈরি ও শিক্ষাক্রম বিস্তরণ প্রশিক্ষণের আগেই শুধু পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নয় শ্রেণির শিক্ষাক্রম একসঙ্গে বাস্তবায়ন শুরু করায় তা খুব কমই ফলপ্রসূ হয়েছে।
আদর্শ প্রক্রিয়া পুরোপুরি অনুসরণ করলে প্রাক্-প্রাথমিকসহ ১৩ বছরের শিক্ষাক্রম নিচ থেকে প্রতিবছর এক শ্রেণি করে ওপর দিকে বাস্তবায়ন করতে থাকলে একটি আবর্তন শেষ করতে ১৩ বছর লাগার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথম থেকে দ্বিতীয় এবং দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় আবর্তনের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সময়ের ব্যবধান ছিল যথাক্রমে ১৩ থেকে ১৫ ও ১৭ বছর। অথচ মাত্র ৭ থেকে ৮ বছর পর ২০১৯-২০ সালে সব স্তরের শিক্ষাক্রম পুনরায় পরিমার্জন করা হচ্ছে। ২০২১ সালের শুরুতে প্রথম, দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রচলিত রীতি অনুসরণে বিভিন্ন বিষয়-কমিটির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের কাজ শেষ করা হয়েছে। কিন্তু প্রাক্-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন স্থগিত রয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক স্তরটি যুক্ত করা হয়েছে প্রাথমিক স্তরের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির জন্য। সুতরাং এই প্রস্তুতিপর্ব বাদ রেখে প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণিতে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চেষ্টা যুক্তিসংগত নয়।
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন শুরু হয়েছে একটু পরে। পাঁচ থেকে ছয় মাস ধরে কাজটি করা হচ্ছে এক রহস্যাবৃত প্রক্রিয়ায় এখনো বিষয়-কমিটি গঠন না করে। এর মধ্যে দেশ করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ায় সময়মতো পরিমার্জন শেষ করে শুধু পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশই অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছে। অধিকন্তু এই স্তরের শিক্ষাক্রম প্রথমবারের মতো যোগ্যতাভিত্তিক করায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের এই ধারা সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত না করে বাস্তবায়নে গেলে ফলপ্রসূ না হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমসহ যেকোনো পরিবর্তন বাস্তবায়নের প্রধান তিন ধরনের কৌশল আছে। যথা: ১) যৌক্তিক গবেষণামূলক, ২) রীতিসিদ্ধ প্রশিক্ষণমূলক এবং ৩) শক্তি প্রয়োগে বাধ্যকর কৌশল। প্রথম কৌশলটি সেখানেই কাজ করে, যেখানে কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নকারীরা যথেষ্ট জ্ঞানী ও নির্ভরযোগ্য; তাঁরা উদ্দিষ্ট দলের ওপর গবেষণা করে যৌক্তিক উপায়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেন। বাংলাদেশে দ্বিতীয় কৌশলটি প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়; কিন্তু অধিকাংশ সময় প্রশিক্ষণ দেরিতে শুরু করে, বাস্তবায়নকারীদের সবার কাছে পৌঁছার আগেই শেষ করে দিয়ে শুধু আদেশবলে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করা হয়।
এবার পরিমার্জন আগেভাগে শুরু করায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ফলপ্রসূ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০০৫ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের আওতায় রচিত পাঠ্যপুস্তক এখনো চালু রয়েছে। সুতরাং আমরা তাড়াহুড়ো করে মাত্র আট বছরের মধ্যে ২০২১ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চেষ্টা না করে বরং প্রাথমিক স্তরের শুরুতে প্রাক্-প্রাথমিক যুক্ত করে এবং সব স্তরে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক-নির্দেশিকা একই সঙ্গে রচনা ও প্রকাশ করে, শিক্ষাক্রম বিস্তরণ প্রশিক্ষণ দিয়ে ২০২২ সাল থেকে শিক্ষাক্রমের ফলপ্রসূ বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যেতে পারি।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা, শিক্ষাক্রম গবেষক এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সদস্য।