গত কয়েক মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যায় আমরা যখন মানসিকভাবে অস্থিরতা বোধ করছিলাম, তখন ঘটল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা। এ ঘটনা আমাদের বেশ বিচলিত করেছে। ঘটনাটি বেশি আলোচিত হয়েছে। কারণ, এটি ঘটেছে দেশসেরা ‘তকমা’ পাওয়া সেরা প্রতিষ্ঠানের একটিতে, যে স্কুলের প্রতি ঢাকা শহরের বেশির ভাগ অভিভাবকের আগ্রহ রয়েছে, প্রত্যাশা থাকে মেয়েটিকে এই স্কুলে ভর্তি করানোর। এই স্কুলে পড়াও নাকি অনেক মর্যাদার। এই স্কুলে ভর্তি হতে এবং না-হতে পারার মধ্য দিয়ে অনেকের মর্যাদার উত্থান-পতন নির্ভর করে। কারণ, জিপিএ ফাইভের নিশ্চয়তা মেলে এবং তার সঙ্গে নিশ্চিত হয় আরও একটি বাড়তি মর্যাদার পালক। সে কারণেই যে মেয়েটি অন্য স্কুলে হয়তো দ্বিতীয় শ্রেণি কিংবা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে, তাকেও ভিকারুননিসার গন্ধ গায়ে মাখতে অভিভাবকেরা এক-দুই বছরের ক্ষতির তোয়াক্কা না করে ভর্তি করান প্রথম শ্রেণিতে। কারণ, এটি ভিকারুননিসা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভর্তি হতে হয় এই স্কুলে।
এই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভিকারুননিসা বেশ কয়েক দিন উত্তপ্ত ছিল, আরও বেশি উত্তপ্ত ছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। স্কুলটির শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে পরীক্ষা বর্জন করে বিক্ষোভ করেছে। জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই ঘটনা এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে দেরি না করেই সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। বর্তমানে এই আন্দোলন স্থগিত। বিদ্যালয়টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তিন শিক্ষককে। একজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করার পর জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে আসলে কী দাঁড়ায়? বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমই কিছুটা একপেশে সংবাদ পরিবেশন করেছে বলে মনে হচ্ছে। আসলে এ ঘটনার জন্য কি শুধু সেই দিনের এক ঘণ্টার একটি ঘটনা দায়ী? আমি বিশ্বাস করি, এই ঘটনার জন্য আমাদের, পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্রের মতাদর্শিক শ্রেণি, স্তরায়ণ এবং পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাপনা দায়ী।
অনেক দিন ধরেই কথাবার্তা হচ্ছে শিক্ষকদের আচরণ নিয়ে। এটি হয়তো একদিকে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষক-বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত থাকা রোমান্টিক মিথ থেকে সরে এসেছে জনগণ। আজ যে শিক্ষকদের কর্তৃত্ব এবং শাসনের রূপ নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলছি, আমরা একবারও কি ভাবছি এই শিক্ষকদের, এই আচরণকে এই আমরাই প্রশ্নাতীতভাবে বৈধ করেছি। এ ঘটনার আগে আমাদের মনে কি কখনো এসেছে যে ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষকদের আচরণ ‘খারাপ’ এবং সেই স্কুলে আমার মেয়ে ভর্তি করাব না। না, আমরা করিনি। কারণ, আমরা বনেদি স্কুলে মেয়ে ভর্তি করাতে পারাকেই অন্যতম বিজয় হিসেবে মনে করেছি।
অভিভাবক হিসেবে আমরা সন্তানের বয়স তিন-চার বছর পার না হতেই তার ওপর মানসিক চাপ তৈরি করি যে তাকে ‘ভালো’ স্কুলে ভর্তি হতে হবে। তাকে পরীক্ষায় প্রথম হতে হবে। অন্য শিক্ষার্থীর থেকে কম নম্বর পেলে আমরাই তার দিনরাতের ঘুম হারাম করে দিই। তার মাথায় চড়িয়ে দিই জিপিএ ফাইভের ভার। বাচ্চাদের কাঙ্ক্ষিত শৈশব ছেঁটে ফেলে, আমরা তাদের প্রতিযোগী হিসেবেই নাম লেখাই।
আমাদের শৈশব ছিল শিক্ষকদের বেতে মোড়ানো। পরিবারের বাইরে শিক্ষার্থীদের শাসনের একমাত্র অধিকার ছিল শিক্ষকদের। শিক্ষকদের মার কিংবা বকাঝকা পরিবার কখনো ভিন্নভাবে অনুবাদ করেনি। কারণ, তখন অভিভাবকদের আবদারই ছিল ‘মাইরা শুধু হাড্ডিই রাইখেন’-জাতীয়। এই বেত-যুগে আমরা কখনো আত্মহত্যার কথা চিন্তা করিনি। হয়তো তখন আমাদের চিন্তার আরও অনেক ক্ষেত্র ছিল। সেই ছোট বয়সে রাগ হলেও সেই শিক্ষকের কথা এখনো শ্রদ্ধাসহ মনে পড়ে। বেতের যুগ এখন আর নেই। শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন বন্ধে আইন হয়েছে। তবে এই আইন যে সবাই অক্ষরে অক্ষরে মানছে এমনটি নয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, টিসির কোনো বিধান নেই। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আইনি কাঠামোতে সেটি আছে এবং শুধু এই প্রতিষ্ঠানেই নয়, ঢাকা শহরের অনেক স্কুলেই এটির চর্চা আছে। তাহলে মন্ত্রণালয়ের তদারকির মধ্যেও ফাঁক আছে নিশ্চয়ই কিংবা ‘খ্যাতি’র কারণে এই স্কুলের আইনি ভেতরকার আইনকানুন নিয়ে তদন্ত হয়নি। আজ সব বিষয়ই একসঙ্গে হয়েছে।
শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর মৃত্যু মেনে নেওয়া খুবই কষ্টের, সেটা বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়—যেখানেই ঘটুক না কেন এবং সেটির সঙ্গে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায় থাকলে সেটি নিশ্চিতভাবেই মর্মান্তিক। তবে অনেক গণমাধ্যমে ঘটনার একপক্ষীয়ভাবে উপস্থাপন ভিন্ন কিছু ভাবার সুযোগ দেয়। শিক্ষার্থী-শিক্ষকের বিরাজমান দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
আমার কাছে মনে হয়, শুধু শিক্ষকদের শাস্তি দিয়ে এ ধরনের ঘটনা কমানো সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে বরং ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে; যেখানে শিক্ষার্থীরা অন্যায় করলেও শিক্ষকেরা শুধরে দিতে ভয় পাবেন, পাছে সে আত্মহত্যা কিংবা অভিযোগ করে! শিক্ষার্থী-শিক্ষক-প্রতিষ্ঠান এই তিনের আরও বেশি ঘনিষ্ঠ কার্যকর যোগাযোগ থাকা গুরুত্বপূর্ণ। টিনএজ শিক্ষার্থীদের আবেগ, অনুভূতির পাশাপাশি মানবিক ও যুক্তিবাদী হিসেবে তৈরি করতে কীভাবে প্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবকেরা একসঙ্গে কাজ করতে পারেন, সে দিকটি নিয়ে ভাবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় এখনই।
জোবাইদা নাসরীন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
zobaidanasreen@gmail.com