মতামত

শিক্ষকের রহস্যজনক মৃত্যু ও হঠকারী কুয়েট প্রশাসন

অধ্যাপক সেলিম হোসেনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষকদের প্রতিবাদ সমাবেশ
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া কুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীর সঙ্গে গতকাল বিকেলে টেলিফোনে কথা হলো। শিক্ষক মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যু ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না যে কর্তৃপক্ষ এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে দেবে। দুপুর সাড়ে ১২টার সময় আমাদের জানানো হয় বিকেল চারটার মধ্যে হল ছাড়তে হবে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট চার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮০০ মেয়ে। ছেলেরা যেকোনো জায়গায় থাকতে পারেন। কিন্তু মেয়েরা কোথায় যাবেন? অনেকেই চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। একসঙ্গে বাসে–ট্রেনেও এত টিকিট পাওয়া যায় না। ফলে যাঁরা টিকিট পেয়েছেন, তঁারা খুলনা ত্যাগ

করতে পেরেছেন। যঁারা পাননি, খুলনার স্থায়ী বাসিন্দা সহপাঠী ছাত্রীদের বাড়িতে রাতের জন্য আশ্রয় নিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ একটু সদয় হলে মেয়েদের এ রকম সমস্যায় পড়তে হতো না।’

ওই শিক্ষার্থী আরও জানান, ‘করোনার কারণে ১৯ মাস বন্ধ থাকার পর আমরা মাত্র ১৫ দিন ক্লাস করেছি। এরপরই গত মাসে দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। কুয়েটের দুই ছাত্র আত্মহত্যা করেন। একজন পাশের রেলস্টেশনে, আরেকজন খুলনায় তাঁর বাসায়। এ কারণেও এক সপ্তাহ ক্লাস বন্ধ ছিল। এরপরই ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেনের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর আমরা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছিলাম না।’

মঙ্গলবার মৃত্যুর খবর পৌঁছাতেই পুরো ক্যাম্পাসে শোকের ছায়া নেমে আসে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে সমাবেশ করেন। মৃত্যুর রহস্য উদ্‌ঘাটনের দাবি জানান। তাঁর মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী, তঁাদের ক্যাম্পাস থেকে চিরতরে বহিষ্কার ও বিচার দাবি করেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল। শিক্ষকেরা সিদ্ধান্ত নেন, দোষী ব্যক্তিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তঁারা একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখবেন। শিক্ষার্থীরাও সিদ্ধান্ত নেন, দোষী ব্যক্তিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ক্লাস ও পরীক্ষায় ফিরে যাবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দেন।

বৃহস্পতিবার সিন্ডিকেটের সভা সিদ্ধান্ত ছাড়া মুলতবি হয়ে যায়। সবাই আশা করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নেবে, যাতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে না এবং সেলিম হোসেনের মৃত্যুর রহস্যও উদ্‌ঘাটিত হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করেই ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুয়েট বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের বিকেল চারটার মধ্যে হলত্যাগের নির্দেশ দিল। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষক সেলিম হোসেনের মৃত্যুরহস্য উদ্‌ঘাটনে যে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল, সেই কমিটির দুজন তদন্তকাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। শিক্ষক হয়ে একজন সহকর্মীর মৃত্যুরহস্য উদ্‌ঘাটনে তঁারা রাজি নন। তঁারা কি স্বেচ্ছায়, না কারও চাপে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? কর্তৃপক্ষ গতকাল রাত পর্যন্ত নতুন কমিটি করেনি। তদন্ত কমিটিই যদি না হয়, সত্য বেরিয়ে আসবে কীভাবে?

এর আগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়। যার মধ্যে ছিল: তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে জমা দেওয়া, তদন্ত কমিটির সদস্য পরিবর্তন করে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা, তদন্ত কমিটির সদস্যদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং তাঁদের সদস্যদের তালিকা নোটিশ বোর্ডে টাঙানো। দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন তাঁরা। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁদের আজীবন ছাত্রত্ব বাতিলসহ বহিষ্কার, নিহত শিক্ষকের পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া, প্রতিটি হলের সব অংশ সিসিটিভির আওতায় আনা এবং প্রতিটি বিভাগের শিক্ষকদের নিরাপত্তায় সিকিউরিটি গার্ড নিযুক্ত করতে প্রশাসনের কাছে দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা এবং শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের ঘোষণা দিয়ে কর্তৃপক্ষ পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। অতীতেও দেখা গেছে, কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অঘটন ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণাকে সহজ সমাধান হিসেবে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী সিন্ডিকেট সভা শুরু হওয়ার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন। তঁারা পাঁচ দফা দাবিতে উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

মঙ্গলবার বিকেলে অধ্যাপক সেলিম হোসেনের মৃত্যুর পর অভিযোগ আসে, ওই দিন সকালে কুয়েট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের লাঞ্ছনা ও অপদস্থের শিকার হওয়ার পর তিনি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। এ-সংক্রান্ত কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সাদমান নাহিয়ানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী ক্যাম্পাসের রাস্তায় ড. সেলিম হোসেনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন, তর্কবিতর্ক করছেন। পরে তাঁরা তাঁকে অনুসরণ করে তড়িৎ প্রকৌশল ভবনে শিক্ষকের ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশ করেন। তাঁরা প্রায় আধা ঘণ্টা কক্ষের ভেতর অবস্থান করে বেরিয়ে যান। পরে অধ্যাপক সেলিম বের হয়ে বাসায় যান।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের খাদ্য ব্যবস্থাপক (ডাইনিং ম্যানেজার) নির্বাচন নিয়ে কয়েক দিন ধরে ছাত্রলীগ নেতারা প্রভোস্ট ড. সেলিম হোসেনকে চাপ সৃষ্টি করছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরে ছাত্রলীগ নেতারা ওই শিক্ষকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং হুমকি দেন। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সরকারি চাকরি পাওয়ার পর কুয়েট ছাত্রলীগ সভাপতি দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় বিভিন্ন হল ও সুযোগ-সুবিধার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান।

এদিকে ছাত্রলীগ নেতা সাদমান নাহিয়ান গতকাল দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি “কুচক্রী মহল” নোংরা রাজনীতিতে লিপ্ত হয়েছে। ওই শিক্ষকের মৃত্যুকে রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।’

মৃত্যুর পর সেলিম হোসেন সম্পর্কে অনেক তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। বিশেষ করে তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা। চার ভাইবোনের সংসারে বাবাকে সহায়তার জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি দোকানেও কাজ করতেন। ফল বিক্রি করতেন। সেলিম হোসেন ২০০০ সালে কুষ্টিয়ার বাঁশগ্রাম ইউনাইটেড বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কুমারখালী উপজেলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন তিনি। ২০০২ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে স্টার নম্বর নিয়ে পাস করেন।

এরপর কুয়েটে ভর্তি হন। পড়াশোনা শেষে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর বৃত্তি নিয়ে জাপানে এক বছর এবং পরে অস্ট্রেলিয়ায় চার বছর পড়াশোনা করেছেন। তিনি ছিলেন কুয়েটের একমাত্র ক্রিপ্টোগ্রাফিতে পিএইচডি করা অধ্যাপক। তাঁর ওপর ভিত্তি করে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে একটি নতুন ল্যাব তৈরির পরিকল্পনা ছিল।

মাত্র ৩৮ বছর বয়সে আমরা এ রকম একজন মেধাবী শিক্ষককে হারালাম। তাঁর এই অকালমৃত্যু কেবল পরিবার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি নয়; পুরো বাংলাদেশের ক্ষতি। শিক্ষার অপূরণীয় ক্ষতি। কেন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এসে তাঁরই শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হলো? কেন অপমানিত হতে হলো? তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো ড. মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যুরহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে কি না?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com