সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইদানীং যখন-তখন বকে দিচ্ছে। এটা নিয়ে কথা বলতে চাই। সরকারপক্ষ শিক্ষকদের নতুন বেতন স্কেলে সুখের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার দাবি করছে। শিক্ষকেরা এই বক্তব্য মানতে পারছেন না। এ কারণে তাঁরা পেশাগত স্বার্থ ও মর্যাদা রক্ষার জন্য কয়েক মাস ধরে একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে আছেন। এই তো ব্যাপার। শিক্ষকেরা বলছেন নতুন কাঠামোতে তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং মর্যাদার দিক থেকে আরও নিচে চলে যাবেন। এর জবাবে শিক্ষকদের জেয়াফতের-খানা খেতে আসা মিসকিন বিবেচনা করার দরকার কী?
কিছু প্রশ্ন করা হচ্ছে, কিছু দাবি করা হচ্ছে। প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন, দাবিগুলো ঠিক থাকলে পূরণ করুন। কিন্তু তার বদলে যা দেওয়ার ছিল দেওয়া হয়ে গেছে, বেশি দেওয়াটা ভুল হয়েছে, এত বেশি না দিলেই ভালো হতো—এসব কেমন কথা? আর একটা ব্যাপার, বেতন বাড়ানো-টাড়ানোটা কি কেবল শিক্ষকদের জন্য? শিক্ষকেরা বেতনকাঠামোর কিছু না বুঝেই আন্দোলনে নেমেছেন বলে মনে করেন সামরিক ও গণতান্ত্রিক সরকারের অভিজ্ঞতাপুষ্ট অর্থমন্ত্রী। এখন জ্ঞানের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলে তো মহাবিপদ। সর্বসম্প্রতি বলা হয়েছে, সরকার যেটুকু মর্যাদা দিতে চাইছে তাতে না পোষালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা যেন বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে আমলা হয়ে যান। এটা বেশ একটা পাওয়া হলো বটে শিক্ষকদের। গত কয়েক মাসের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যাপারে নৈর্ব্যক্তিক জায়গা থেকে কথা বলছে না সরকার। অবশ্য সরকার জানে যে এতে কোনো অসুবিধা নেই। এত বকাবকির মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগপন্থী প্যানেলগুলোর জয়জয়কার হয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সাইজ করার বাসনা নানা মহলেরই আছে। সবার নাম এমনকি মুখে আনার সাহস পর্যন্ত আমাদের নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ডোবানোতে উচ্চশিক্ষা ব্যবসায় জড়িতদের স্বার্থ থাকতে পারে। আমাদের শিক্ষাকে নিজেদের স্বার্থের উপযোগী করে সাজাতে চাওয়া আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ থাকতে পারে। এ ছাড়া সবকিছুতে মাতব্বরির ফিকিরে থাকা কিছু কিছু মানুষের কু-অভ্যাসের একটি হচ্ছে যতভাবে সম্ভব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অপমান করা। কার্যকারণ সম্পর্ক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জায়গা থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে চাওয়ার ইচ্ছা, সময় বা সামর্থ্য এদের নেই। কিন্তু এদের সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের ধরন কেন মিলে যাবে? শিক্ষকদের দাবি অগ্রাহ্য করার পর্বে পর্বে সরকারের উচ্চমহল থেকে যেসব অপমানজনক কথাবার্তা বলা হচ্ছে, সেগুলো কায়েমি স্বার্থবাদীদের পক্ষে খুব ভালোভাবে যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মুখ খুললেই খুঁজে খুঁজে খারাপ উদাহরণগুলো টেনে বের করার চক্রান্তের সঙ্গে বর্তমান সরকারের কথাবার্তার মিল পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের শীর্ষমহলের কথাবার্তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়–বিরোধীদের সঙ্গে নিদারুণভাবে মিলে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে নয়, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এর মধ্যে জাতীয় স্বার্থের বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছি। সরকার বাহাদুর ব্যাপারটা খেয়াল করছে কি?
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা অমুক করেন তমুক করেন। কী করেন? ঠিক আছে, সমস্যা যেখানে আছে সেগুলো ঠিকঠাক করেন। কেউ মানা করছে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান, দলবাজিসহ নানা অনিয়মের কথাই ধরা যাক—এগুলো নিরসনে সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে এলে সাধারণ শিক্ষকেরা তাদের মাথায় করে রাখবেন। সেসব কিছু না করে শিক্ষকদের এখনকার দাবিগুলো ঠেকাতে এসব বিষয় টেনে আনাটা অবান্তর কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অথবা দুটোই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় দুরবস্থার সব দায় শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মানে কী? আর কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তো এমন করা হয় না! এ ধরনের প্রবণতা আমাদের কোনো গন্তব্যে নিয়ে যাবে না। সরকার বনাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ছে; দূরত্ব বাড়ছে। আন্দোলন থামানোতে অপমান-থেরাপি কাজ করবে না, এটা নিশ্চিত। তারপরে কী? আরও অপমান? শাস্তি? সম্ভাব্য ফলাফলটা কী?
ওত পেতে আছে নানামুখী সুযোগসন্ধানী শক্তি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অস্থিতিশীল ক্যাম্পাসের চেয়ে আর কোনো কিছুই আকর্ষণীয় নয় এদের কাছে। এদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া খুবই দরকার?
শিক্ষককে সৈয়দ মুজতবা আলীর লাট সাহেবের তিন ঠ্যাংওয়ালা কুকুরের বড়জোর একটি ঠ্যাংয়ের সমান বিবেচনার অসম্মানের কথা না হয় ভুলেই থাকলাম।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।