শিক্ষককে তো জুতার মালা পরানো কিংবা মেরে ফেলাই যায়!

নড়াইলে কলেজ অধ্যক্ষকে অপমান ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: প্রথম আলো

পরপর দুটো ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সাভারে দশম শ্রেণির এক ছাত্র ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে তার শিক্ষককে হত্যা করেছে। অন্যদিকে নড়াইলে এক কলেজ অধ্যক্ষকে পুলিশ এবং হাজারও মানুষের সামনে জুতার মালা গলায় পরতে হয়েছে। দুটো ঘটনা জানার পর নিজেকেই নিজে বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করেছি—দুই শিক্ষকের মধ্যে কার কপাল আসলে তুলনামূলক ভালো? সাভারের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের নাকি নড়াইলের শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের? আমার তো মনে হচ্ছে উৎপল কুমার সরকার মরে গিয়ে বরং বেঁচে গিয়েছেন। নইলে নড়াইলের শিক্ষক স্বপন কুমারের মতো বেঁচে থেকে বারবার হয়তো মরতে হতো তাঁকে!

আচ্ছা, স্বপন কুমার এখন আছেন কেমন? শুনেছি ওই ঘটনার পর তিনি নাকি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন! তাঁকে নাকি বেশ কয়েকবার জায়গা পরিবর্তন করতে হয়েছে। কারণ, তিনি আতঙ্কে আছেন! কোন অপরাধে জুতার মালা পরানো হলো? তাঁর অন্যায়টা কী ছিল? একজন শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এসেছে, তো তিনি অন্যান্য শিক্ষক, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। সেখানকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে খবর দিয়েছেন তিনি। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে পুলিশের হাতেও তুলে দেওয়া হয়। প্রথম আলোসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমগুলোতে ঘটনার এরকমই বর্ণনা জানতে পারছি আমরা।

আজকে নড়াইল এবং সাভারে দুই শিক্ষকের ভাগ্যে যা ঘটেছে, এর প্রেক্ষাপট আমাদের সমাজ অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছিল। এটি ছিল স্রেফ সময়ের ব্যাপার। ঠিক তেমনি এ দুটি ঘটনারও যদি কোনো শাস্তি না হয়; তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ভবিষ্যতে হয়তো এর চেয়েও ভয়াবহ দৃশ্য আমাদের দেখতে হতে পারে।

শিক্ষক স্বপন কুমার গলায় জুতার মালা পরে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশেই নির্বিকার পুলিশ সদস্যদের যে ছবি এবং ভিডিও আমরা দেখতে পেলাম। সেসব ছবি ও ভিডিও এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াল। অথচ এ নিয়ে কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তাহলে সেগুলো কী ভিনগ্রহ থেকে আসলো? অবশ্য বাংলাদেশ নামক দেশটি বোধ করি পৃথিবী নামক গ্রহেই নতুন করে ভিনগ্রহের জন্ম দিয়ে চলেছে! এখানে একজন শিক্ষককে হাজারো মানুষের সামনে জুতার মালা গলার পরে অপদস্থ হতে হয়। অথচ সেই সময় জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সব শীর্ষ কমর্কতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা বলছেন, স্বপন কুমারকে গলায় জুতার মালা পরানোর বিষয়টি নাকি তারা খেয়ালই করেননি! আরেক দশম শ্রেণির ছাত্র প্রকাশ্য দিবালোকে তারই এক শিক্ষককে ক্ষোভের বশে হত্যা করে দিব্যি বুক উঁচিয়ে স্থান ত্যাগ করতে পেরেছে।

এখন খবর প্রকাশ পাচ্ছে, এই ছাত্র নাকি ওই স্কুল কমিটির কেউ একজনের আত্মীয়। তাই কেউ সাহস পায়নি। আমাদের ‘সাহসও’ বড্ড বেশি হিসেবি। কেউ একজন প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা করে উধাও হয়ে যেতে পারছে। কেউ তাকে একটা কথা বলারও সাহস পাচ্ছে না। আবার দোষ না করেও অন্য আরেক শিক্ষককে জুতার মালা পরে থাকতে হচ্ছে। এই শিক্ষককে অবশ্য ‘সাহস’ করে পুলিশ সদস্যরাও জুতার মালা পরার হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি। তাদের এত ‘সাহস’ থাকবে কী করে! সব সাহস তো তখন ভর করেছে উত্তেজিত জনতার কাঁধে! এই উত্তেজিত জনতাকে অবশ্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি; যখন শিক্ষক উৎপল কুমারকে হত্যা করা হয়েছে। তখন দশম শ্রেণির ছাত্র একাই ওই শিক্ষককে হত্যা করে সবার সামনে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে।

আচ্ছা, যে ছেলেটা একজন শিক্ষককে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে পালিয়ে গিয়েছে; তার নিশ্চয় মা–বাবা আছে। এই মা–বাবার তো উচিত ছিল তাঁদের সন্তানকে নিজ হাতে পুলিশে দেওয়া। সেটা না করে তাঁরা কেন তাঁদের সন্তানকে পালাতে সাহায্য করলেন? যে ছাত্র তার নিজের শিক্ষককে হত্যা করতে পারে; সে যে তাঁর মা–বাবাকে হত্যা করবে না তার নিশ্চয়তা কী! তাহলে কেন এই মা–বাবা তাঁদের সন্তানকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন?

সাভারের ঘটনায় ওই মা–বাবা তাঁদের সন্তানকে যেভাবে আড়াল করার চেষ্টা করছেন, ঠিক তেমনটাই করছেন নড়াইলের প্রশাসন ও পুলিশ। সেখানে উপস্থিত থেকেও শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোর বিষয়টি তাদের অগোচরে হয়েছে বলে দায় এড়াতে চায়। এভাবে সব কিছু আড়াল করাই যায়, দায় এড়ানো যায় কিন্তু একটা সমাজে যখন ঘুণ ধরে; সেটি অবশ্য কোনো উপায়েই আড়াল করা সম্ভব নয়।

একজন শিক্ষকই কিন্তু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট, জজ-ব্যারিস্টার কিংবা আমলা তৈরি করেন। সেই শিক্ষকের মর্যাদা আসলে আমাদের সমাজে কোথায়? অতীতের ঘটনাগুলো কী আমরা দিব্যি ভুলে গিয়েছি? যখন এলাকার এমপি একজন শিক্ষককে চড় মেরেছিলেন এবং এ জন্য কোনো শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। যখন একজন শিক্ষককে সরকারি একজন বড় কর্তা বাধ্য করেছিলেন পা ধরে মাফ চাইতে। সে জন্যও কোনো শাস্তি হয়নি। আজকে নড়াইল এবং সাভারে দুই শিক্ষকের ভাগ্যে যা ঘটেছে, এর প্রেক্ষাপট আমাদের সমাজ অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছিল। এটি ছিল স্রেফ সময়ের ব্যাপার। ঠিক তেমনি এ দুটি ঘটনারও যদি কোনো শাস্তি না হয়; তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ভবিষ্যতে হয়তো এর চেয়েও ভয়াবহ দৃশ্য আমাদের দেখতে হতে পারে। এই লেখার শুরুতে এ জন্যই বলেছি, সাভারের শিক্ষক উৎপল কুমার মরে গিয়ে, বরং ভালোই করেছেন। যে সমাজ আমরা গড়ে তুলেছি; তাতে বেঁচে যাওয়া নড়াইলের ওই শিক্ষককে এখন হয়তো বেঁচে থেকে হাজারবার মরতে হবে।

ড. আমিনুল ইসলাম সিনিয়র লেকচারার ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগ।এস্তনিয়ান এন্টারপ্রেনারশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: aminulislam1255 @yahoo.com