বন্ধু শাহ আলমগীরের সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয় তাঁর সিএমএইচে ভর্তি হওয়ার আগে। প্রেস ইনস্টিটিউটের একটি বইয়ের জন্য তাঁকে টেলিফোন করেছিলাম। তিনি বললেন, তাঁর শরীরটা একটু খারাপ, পিজিতে যাচ্ছেন কোনো রিপোর্ট নিয়ে। ইনস্টিটিউটে গেলে বইটি পাওয়া যাবে। এরপরই শুনলাম তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে তাঁর ছোট ভাই শাহ আজমকে টেলিফোন করলে তিনি বললেন, ‘এখন অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে, আপনি সকালে আসুন।’
পরদিন সকালে আজমকে টেলিফোন করলে জানান, ‘দাদাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।’ যখন গাড়ি নিয়ে সেনানিবাসের ভেতরে ঢুকছি, তখনই আজমের দ্বিতীয় ফোন। কথা বলতে পারছিলেন না, উচ্চ স্বরে কাঁদছিলেন। বুঝলাম শাহ আলমগীর আর নেই। সিএমএইচে গিয়ে দেখি তাঁর স্বজন, সুহৃদ ও সহকর্মীরা সবাই অপেক্ষা করছেন। কখন তাঁর মরদেহ আইসিইউ থেকে বাইরে নিয়ে আসা হবে। এ অপেক্ষা ভীষণ কষ্টের। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছিল।
কোনো মানুষই চিরদিন বাঁচে না। তাই বলে এত তাড়াতাড়ি আলমগীর চলে যাবেন, ভাবিনি। বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছিল না। তারপরও গত ডিসেম্বরে জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। নিয়মিত অফিসে যেতেন। কয়েক দিন আগে সিঙ্গাপুরে চেকআপ করিয়ে এসেছেন। ভেবেছিলাম, আলমগীর সুস্থ হয়ে আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবেন। স্ত্রী মায়া, ছেলে দীপ, পুত্রবধূ ও মেয়ে অর্চিকে নিয়ে ছিল তাঁর ছোট্ট সুখী সংসার। তাঁদের কাছে এবং আমাদের সবার কাছে তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
শাহ আলমগীর তাঁর কর্মক্ষেত্র প্রেস ইনস্টিটিউট, সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেসক্লাবকেও নিজের পরিবার ভাবতেন। প্রায় চার দশকের সাংবাদিক জীবন তাঁর। কিশোর বাংলা থেকে শুরু করে জনতা, বাংলার বাণী, আজাদ, সংবাদ হয়ে প্রথম আলো। এরপর তিনি চলে গেলেন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, দায়িত্বপূর্ণ পদে ছিলেন চ্যানেল আই, একুশে টিভি, মাছরাঙা ও যমুনা টেলিভিশনে। এসব সংবাদমাধ্যমে যাঁরা তাঁর সহকর্মী ছিলেন, যাঁরা তাঁর সাহচর্যে এসেছেন, তিনি সবাইকে আপন করে নিয়েছিলেন।
বিশেষ করে অনুজ সহকর্মীদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় সব সময় সোচ্চার ছিলেন আলমগীর। একবার একটি টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষের অন্যায্য খবরদারির প্রতিবাদে চাকরি থেকে ইস্তফাও দিয়েছিলেন। যেদিন শাহ আলমগীর মারা যান, সেদিন আবহাওয়া বৈরী ছিল। তারপরও শোকার্ত মানুষের ঢল নেমেছিল প্রেসক্লাবে। তাঁর এক তরুণ সহকর্মী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘আলমগীর ভাই ছিলেন আমাদের মাথার ওপর ছায়ার মতো। আজ সেই ছায়াটি সরে গেল।’
যমুনা টেলিভিশন ছাড়ার পর শাহ আলমগীর ফের সংবাদপত্রে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। দু-একটা জায়গায় কথাবার্তাও হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান। ২০১৩ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রেস ইনস্টিটিউট সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর নানা সীমাবদ্ধতা আছে, আছে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এসব মেনে নিয়েও তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে সাংবাদিকবান্ধব করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সময়ে প্রেস ইনস্টিটিউটের গবেষণা ও প্রশিক্ষণ—দুটোরই প্রসার ঘটেছে। শাহ আলমগীর সেখানে অনলাইন সাংবাদিকতা কোর্স চালু করেন। আগে থেকেই প্রেস ইনস্টিটিউটে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা কোর্স চালু ছিল। তাঁর সময়ই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি চালু হয়। প্রেস ইনস্টিটিউটে শহীদ সাংবাদিক কর্নার প্রতিষ্ঠা ও সাংবাদিক কল্যাণ তহবিল গঠনেও তাঁর উদ্যোগী ভূমিকা ছিল।
গেল শতকের সত্তর ও আশির দশকটি ছিল আমাদের স্বপ্ন দেখার ও স্বপ্ন দেখানোর সময়। একই সঙ্গে স্বপ্নভঙ্গেরও। ছাত্রসংগঠন, শিশুসংগঠন কিংবা সাংবাদিকতা—যেখানেই আমরা কাজ করেছি, একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। সমাজবাদী আদর্শের মধ্য দিয়ে গণমানুষের মুক্তি খুঁজেছি। সামরিক শাসনের কঠিন সময়ে সাংবাদিকতা পেশা ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে যে বন্ধুবৃত্তটি গড়ে ওঠে, তার অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিলেন শাহ আলমগীর। সেই বৃত্তে আরও যুক্ত হয়েছিলেন সাংবাদিক সুধীর কৈবর্ত দাস, প্রণব সাহা, সৈয়দ আজিজুল হক, সুশান্ত মজুমদার, সাইদুল হক, সাইফুল আমিন, দুলাল মাহমুদ, আহমেদ ফারুক হাসান, নান্টু রায় প্রমুখ। আশির দশকের মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংস্থা—আইওজের বাংলাদেশ চ্যাপটার গঠনকে কেন্দ্র করেও সাংবাদিকদের নিয়ে আরেকটি বলয় তৈরি হয়। সংবাদ সম্পাদক বজলুর রহমান এর কেন্দ্রে থাকলেও দাপ্তরিক ও যোগাযোগের মূল কাজটি করতেন মনজুরুল আহসান বুলবুল ও শাহ আলমগীর।
শাহ আলমগীর ছিলেন আমাদের চার দশকের বন্ধু ও সহযোদ্ধা। আমরা একসঙ্গে রাজনীতি করেছি, সংগঠন করেছি, সাংবাদিকতা করেছি। সেই সময়ে সাংবাদিকতা ছিল আরও বেশি অনিশ্চিত পেশা। সামরিক শাসক এরশাদের রোষানলে পড়ে একের পর এক পত্রিকা বন্ধ হচ্ছে। ১৯৮৪ সালে এরশাদের হঠাৎ খেয়াল হলো একটি পত্রিকা বের করবেন তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার করতে। দৈনিক জনতা। আরও অনেকের সঙ্গে শাহ আলমগীরও সেখানে যোগ দিলেন। কিন্তু কয়েক মাস যেতেই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। শাহ আলমগীর বেকার হলেন; এলেন বাংলার বাণীতে। ১৯৮৭ সালে এরশাদ বাংলার বাণী বন্ধ করে দিলে আমরা দুজনই বেকার হয়ে যাই এবং আলমগীরের চেষ্টায় আজাদ-এ ঠাঁই হয়।
বাংলার বাণী, আজাদ ও সংবাদ-এ আমরা দীর্ঘদিন সহকর্মী ছিলাম। দুর্ভাগ্য তিনটি পত্রিকায়ই বেতন-ভাতা অনিয়মিত ছিল। তখন দুজনই সদ্য বিয়ে করেছি। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে শাহ আলমগীরের বাড়তি দায়িত্ব ছিল। তাই অনিয়মিত বেতনের দৈনিকে চাকরি করার পাশাপাশি আমাদের সাপ্তাহিক পত্রিকায়ও খণ্ডকালীন কাজ করতে হয়েছে। শাহ আলমগীর কোনো পত্রিকায় গেলে চেষ্টা করেছেন, আমার জন্য জায়গা করে দিতে। আমিও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তাঁর জন্য। আশির দশকের শেষ দিকে এভাবেই আমরা সাপ্তাহিক ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। আমরা রাতের না হলেও দিনের খাবার ভাগ করে খেয়েছি। আসলে ‘বেকারির বা আধা বেকারির’ দিনগুলোতেই আমাদের বন্ধুত্ব গভীর হয়েছিল। আজ পেছনে তাকালে দেখি, যে রাজনীতি আমাদের একত্র করেছিল, সবার অগোচরে সে রাজনীতি হারিয়ে গেছে। স্বপ্নগুলো ধূসর হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্ব হারায়নি। হারাবে না কোনো দিন।
সমসাময়িক, পূর্ব ও উত্তর প্রজন্মের অনেক সাংবাদিকের প্রিয় সহকর্মী ও সুহৃদ ছিলেন শাহ আলমগীর। তিনি যেখানেই গিয়েছেন, পুরোনো বন্ধুদের কথা মনে রেখেছেন; যাঁকে যেভাবে সম্ভব তাঁর কাজের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। সহকর্মী থেকে সহমর্মী হয়েছেন। আমাদের নিত্য বিযুক্ত হওয়া ও বিযুক্ত করা এই সমাজে এটাও কম পাওয়া নয়।
বন্ধু শাহ আলমগীরের জন্য ভালোবাসা।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com