মতামত

‘...শাস্তি তো আপনার হওয়া উচিত’

ঢাকার বেইলি রোডে বেপরোয়া গতির গাড়ি একটি রিকশাকে ধাক্কা দেওয়ার পর সেই ভিডিওচিত্র সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬-এর বিচারক সম্প্রতি অভিযুক্ত এক কিশোরের বাবার উদ্দেশে কথাগুলো বলেছেন। আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে বাংলাদেশের একজন আইনজীবী (পরে অ্যাটর্নি জেনারেল) প্রায় এ রকমই একটা বাক্য প্রয়োগ করেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত পূর্ব এশিয়ার এক রাষ্ট্রদূতকে। রাষ্ট্রদূতের নাবালক পুত্র স্কুল ছুটির পর চালককে পাশের সিটে বসিয়ে সে তার ক্যারিশমা দেখাচ্ছিল। তার খায়েশের বলি হন আমাদের এক সহপাঠী। শেষ পর্যন্ত আমাদের বন্ধুটি প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রতিবন্ধী হয়ে যান চিরতরে।

পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত কিশোর ১৯ নভেম্বর (শুক্রবার) রাজধানীর বেইলি রোড এলাকায় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে একটি রিকশাকে ধাক্কা দেয়। এতে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা ফখরুল হাসান, তাঁর পাঁচ মাসের শিশুপুত্র ও রিকশাচালক আনোয়ার ইসলাম গুরুতর আহত হন। ধাক্কা দিয়ে উধাও হয়ে গেলেও বিধিবাম। শুক্রবারের সেই ঘটনার একটা ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।তাতে দেখা যায়, তীব্রগতিতে ছুটে আসা একটি ব্যক্তিগত গাড়ির আঘাতে রিকশাচালক ও তাঁর আরোহীরা রাস্তায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছেন আর গাড়িটি দ্রুত চলে যাচ্ছে।


বিবিসির সংবাদকর্মী ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের কাছ থেকে জানতে পারেন, ধাক্কা দিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া গাড়িটি চালাচ্ছিল ১৫ বছর বয়সের এক কিশোর। সে রাজধানীর একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। অধিক ধনী আর ক্ষমতার অলিন্দে হেঁটে বেড়ানো মা-বাবার দুলালদের এ রকম ‘হিট অ্যান্ড রান’ কোনো নতুন ঘটনা নয়। এগুলো এখন এতই গা-সওয়া ঘটনা যে এসব হিট অ্যান্ড রানে কেউ মারা না গেলে বা একেবারে হাত-পা না ভাঙলে কেউ আর এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। বড়জোর জানটা ফেরত পাওয়ার জন্য সদকা দেয়, আল্লাহর শোকর আদায় করে। রাস্তায় চলাফেরার সময় দোয়াদরুদ পড়া বাড়িয়ে দেয়।

আরেকটি ঘটনায় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে (থার্সডে পার্টিফেরত কি?) রাজধানীর গুলশানে এক বেপরোয়া ব্যক্তিগত গাড়ি রিকশা ও অন্য একটি গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। এতে রিকশাচালকসহ দুজন আহত হন। গুরুতর আহত রিকশাচালককে গুলশানের শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান থানার ডিউটি অফিসার সংবাদকর্মীদের বলেন, দুর্ঘটনায় দুজন আহত হয়েছেন। এখনো কাউকে আটক করা যায়নি। ঘটনাস্থলে পুলিশের টিম রয়েছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই।

তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গুলশান-২-এর মোড়ে বেপরোয়া ব্যক্তিগত গাড়িটি হঠাৎ এসে একটি রিকশাকে ধাক্কা দেয়। এ সময় রিকশাচালক ও রিকশার আরোহী নারী সন্তানসহ পড়ে যান। সেখান থেকে বের হওয়ার সময় গাড়িটি আরেকটি ব্যক্তিগত গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে দ্রুত চলে যায়। এত রাতে যিনি এ রকম বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তাঁর গাড়ি চালানোর যোগ্যতা আর সেই যোগ্যতা অর্জনে বয়স নিয়ে প্রশ্ন করা যায়। সেটা কে করবে? রাতে যাঁরা টহলে থাকেন, তাঁদের নজর এড়িয়ে এ রকম ঘটনা হামেশাই ঘটছে। কারও মৃত্যু বা গুরুতর জখম না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কারও জন্যই ভালো নয়।

‘মিউচুয়াল’-এর পরামর্শ

অনেক সময় আপস-মীমাংসা বা ‘মিউচুয়াল’ করে ল্যাঠা চুকিয়ে ফেলার জন্য উৎসাহিত করার গল্প শোনা যায়। চলতি বছরের এপ্রিলে এক বিধিনিষেধের রাতে পাল্লা দিয়ে ছোটাছুটি করার সময় রাজধানীর গুলশান নিকেতন এলাকায় দুটি গাড়ির সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একটি গাড়ি সড়কের পাশে লাইটপোস্টে গিয়ে ধাক্কা দেয়। অন্যটির সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে যায়। এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ঘটনার পর পুলিশ সেখানে গিয়ে গাড়ি দুটি উদ্ধার করে। গাড়ি দুটির মালিকপক্ষ নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করায় এ ঘটনায় কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’

দণ্ডবিধির ২৭৯ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি জনসাধারণের ব্যবহৃত কোনো সড়কে বেপরোয়া বা অবহেলামূলকভাবে কোনো গাড়ি চালান, এর কারণে যদি মানুষের জীবন বিপদাপন্ন হয় কিংবা কোনো ব্যক্তির আহত বা জখম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে দায়ী চালকের জন্য শাস্তি অবধারিত। সাজা হিসেবে তিন বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। সর্বনিম্ন এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড রয়েছে। তাই আপসরফায় মুক্তির স্বাদ নিতে আর দিতে চায়ে সব পক্ষ।

আহত-নিহত না হলেই যে শুধু কথিত মিউচুয়ালের জন্য উৎসাহিত করা হয়, তা কিন্তু নয়। আহত-নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অথবা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মিউচুয়ালের অনেক উদাহরণ আছে। সেসব ভিন্ন আলোচনা।

কী কী কারণে কথিত ওই অভিভাবকের শাস্তি হওয়া উচিত

আদেশ হয়ে যাওয়ার পর অভিযুক্ত কিশোরের বাবা (সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী) আরও কয়েকজন আইনজীবী নিয়ে আদালতে উপস্থিত হয়ে জামিন চান ছেলের। বিচারক তাঁদের জানান, আদেশ হয়ে গেছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হোক। এরপর নাহয় আবার জামিন শুনানি হবে। এরপর আর কোনো কথা থাকে না। তার পরও বিচারক কিশোরের বাবার কাছে জানতে চান, ‘সে (কিশোর) কি লাইসেন্সসহ গাড়ি চালাচ্ছিল?’ জবাবে কিশোরের বাবা বলেন, ‘না। কাউকে না জানিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় সে।’

যেটা দিয়ে মানুষ হত্যা করা যায়, সেটার চাবি তার নাগালে রাখা আর বিষের বোতল শিশুর শিয়রে রাখা তো একই কথা। শিশুর জন্য বিপজ্জনক বা শিশুকে দুর্ঘটনায় ফেলতে পারে—এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার কথা শিশু অধিকার সনদের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে খুব ভালো করে বলা আছে। যে শিশু কোনো দিন গাড়ি চালায়নি, সে বাড়িতে নতুন গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে নিজের এলেম পরীক্ষা করতে বেইলি রোডের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদে ম্যালা করবে, তা কী করে হয়।

ছেলেকে ব্যাটা বানানোর কসরতে বাবা কি একেবারেই শামিল ছিলেন না? বয়স না হওয়া সত্ত্বেও এর আগে তাকে কোনো দিন ড্রাইভিং সিটে বসতে না দিলে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার ঘটনা খুবই বেমানান গপ্পো। এ রকম আরেক বিপজ্জনক কসরতের কথা কিছুদিন আগে পত্রপত্রিকায় রাষ্ট্র হয়েছিল। কোনো এক ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর নাবালক দুই শিশুকে সুন্দরবনে নিয়ে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সেটা আবার ভিডিও করে লোকসমাজে তাঁর সন্তানদের বীরত্বকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন জনাব ম্যাজিস্ট্রেট।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পিতা আরও একটা অপরাধ করেছেন। তিনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছেন। পুলিশের ভাষ্যমতে, অপরাধের পরদিন সকাল সাড়ে সাতটার দিকে কিশোর ও তার মাকে বাসে করে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে আবার চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গায় তার খালার বাড়িতে গিয়ে আত্মগোপনে থাকে। পরে দুই উপজেলার থানা-পুলিশের সহায়তায় ওই কিশোরকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ।

আইনের চোখে এসব কাজকে বলে গ্রেপ্তারে বাধাদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ২২৫-এ অপর ব্যক্তির আইনানুগ গ্রেপ্তারে বাধাদান বা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করলে এর জন্য শাস্তির কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো অপরাধের জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে আইনসংগতভাবে গ্রেপ্তারের কাজে বাধাদান করে বা বেআইনিভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, তবে সে ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।

সন্তানস্নেহে কাতর একজন আটপৌরে পিতা যেটা করতে পারেন, একজন উচ্চ আদালতের আইনজীবীর পক্ষে কি সেটা শোভা পায়? একদিন তো তিনিও বিচারপতি হতে পারেন। পথচারীরা কোথায় দাঁড়াবে?

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com