ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী শালমারা নদী। নারী প্রগতির অগ্রপথিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মভূমি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ দিয়ে নদীটি প্রবাহিত। মিঠাপুকুরের ঘাঘট নদ থেকে উৎপন্ন হয়ে একই উপজেলায় ভাংনি ইউনিয়নের কাশীনাথপুর গ্রামে কাফ্রিখাল নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার, প্রস্থে স্থানবিশেষে প্রায় ১০০ মিটার। নদীটি ভাটিতে চমকা নামেও পরিচিত। উৎসমুখ অযত্নেœ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং অবৈধ দখলের কারণে অনেক স্থানেই নদীটি হাঁসফাঁস করছে।
শালমারা নদীর পাশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল অনেক উঁচু গড়। অনুমান করা যায়, কয়েক শ বছর আগে শালমারা নদীর প্লাবন থেকে জনপদকে রক্ষা করার জন্যই এ গড় নির্মাণ করা হয়েছে। মিঠাপুকুর উপজেলাতেই রাজা ভীম দ্বাদশ শতকে দীর্ঘ গড় নির্মাণ করেন। এই গড়ের সঙ্গে সেই গড়ের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, জানা যায়নি। স্থানীয় লোকজন এই শালমারা নদীর পাশে গড় কেটে কেটে সমতল ভূমি বের করে অবৈধভাবে দখলে নিয়েছেন। অনেকে নদী ভরাট করেছেন এ গড় কেটে। ১৯৪০ সালের সিএস নকশায় গড়ের অংশ চিহ্নিত করা আছে।
শালমারা নদী গ্রামের ভেতর নিস্তরঙ্গ শুয়ে আছে। কিন্তু তার পাড়ের গড়, নীলকুঠি, মাজার, শ্মশানঘাটসহ নানান অনুষঙ্গে যেন নদীর ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কান পাতলেও শোনা যাবে নদীর কথা।
নদীটি ব্রিটিশদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্রিটিশ কুঠি ছিল এ নদীর পাড়ে। যে স্থানে কুঠি ছিল, সেই স্থানের নাম কুঠিরপাড়। এখনো অনেক বড় বড় পাতলা ইট পাওয়া যায় সেই কুঠিরস্থলে। কয়েক দিন আগে আমি একটি ইট সংগ্রহ করে এনেছি কুড়িগ্রামের উত্তরবঙ্গ জাদুঘরে দেওয়ার জন্য। পুরোনো নদীর মতো এ নদীর তীরে কয়েকটি শ্মশান এখনো আছে। শীতলী পূজা হতো এ নদীর পাড়ে। এখনো নদীর পাড়ে ‘কাটারাম দরগা’ নামে একটি মাজার আছে। নদীপারের মানুষ ও নদীকর্মী শাহজালাল বলেন, ‘জনশ্রুতি আছে, সিলেট থেকে নৌপথে যাতায়াত করার সময়ে জনৈক পীর সেখানে মারা গেছেন। তাঁর নামে গড়ে ওঠা মাজারসংলগ্ন এলাকায় মহররম উপলক্ষে ২০-২৫ বছর আগেও অনেক বড় মেলার প্রচলন ছিল। এ নদীতে বেশ কয়েকটি ঘাট ছিল। নদীটি কাফ্রিখালে যে স্থানে মিলিত হয়েছে, সেখানেই ছিল বিশাল হাট। অনেক বড় বড় বাণিজ্যতরি আসত সেখানে। বংশপরম্পরায় এক প্রবীণ মাঝির সঙ্গে নদীর পাড়ে দেখা হয়েছিল। তিনি নিজেও সেখানে অনেক বড় ঘাট দেখেছেন, দেখেছেন পানির প্রবল প্রবাহ।
এ নদীর নামকরণের সঙ্গে শাল মাছের সম্পর্ক আছে। গজার মাছকে স্থানীয়ভাবে শাল মাছ বলা হয়। এ নদীতে প্রচুর শাল মাছ পাওয়া যেত। ৫০-৬০ বছর আগেও বন্দুক দিয়ে গুলি করে ভাসমান শাল মাছ মারার কথা নদীপারে বেশ প্রচলিত। অনেকে মেরেছেন, অনেকে দেখেছেন, অনেকে শুনেছেন। শালমারা নদীর নামে ‘শালমারা হাট’ আছে। সম্প্রতি রিভারাইন পিপলের শালমারা নদী সুরক্ষা কমিটির একটি সভা সেখানে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় এক মৎস্যজীবী গভীর আবেগের সঙ্গে বলছিলেন, ‘হামাক একটা শাল মাছের পোনা আনি দেওয়া যাইবে? এই নদীত আবার শাল মাছ হইবে। কত দিন হইল এই নদীর শাল মাছ নাই।’
সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে এ নদীর একটি অংশ ব্যক্তির নামে লিখিত হয়। এর বিরুদ্ধে আশির দশকেই গড়ে উঠেছিল আন্দোলন। সেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে আজিজার মেম্বার, আবুল হোসেন, আবু বক্কর, আতিয়ার রহমান ও শাহজালাল জেলও খেটেছেন। জেলে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আজিজার মেম্বার ও শাহজালালের সঙ্গে সম্প্রতি নদীর পাড়েই কথা হয়। শালমারা নদী সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক শাহজালাল বলেন, ‘জেলে গেছি এ নদীর জন্য। এখন নতুন করে আবারও আন্দোলন করছি। আমরা এ নদীর স্বাভাবিক রূপ দেখতে চাই। এর চেয়ে আর বেশি কিচ্ছু নয়।’
নদীর ভেতরে অনেকগুলো গভীর জলাশয় ছিল। সেগুলো নদীর ভেতরের বিল হিসেবে আখ্যায়িত। সেগুলো বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। বন্দোবস্ত দেওয়া নদীর জন্য কল্যাণকর হয়নি। নদীটি পায়রাবন্দ ও শালমারা এলাকার প্রায় ২০টি গ্রামের পানি বহন করত। এখন নদীটি সংকটাপন্ন।
এ নদীর ভেতরে অনেকগুলো গভীর জলাশয় ছিল। সেগুলো নদীর ভেতরের বিল হিসেবে আখ্যায়িত। সেগুলো বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। বন্দোবস্ত দেওয়া নদীর জন্য কল্যাণকর হয়নি। নদীটি পায়রাবন্দ ও শালমারা এলাকার প্রায় ২০টি গ্রামের পানি বহন করত। এখন নদীটি সংকটাপন্ন। পানি ঠিকমতো নেমে যেতে পারে না বলে অনেক জলাবদ্ধতা আছে। এ নদীর কয়েকটি ছোট শাখানদী আছে, যেগুলোর একটিও ভালো নেই। নদীটি সরকারি নথিপত্রে থাকলেও সরকারের নদীর তালিকায় এর নাম নেই।
চলতি বছরে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নদীটির প্রায় ১০ কিলোমিটার খনন করেছে। নদীপারের মানুষ স্বপ্ন দেখেন, আবার এ নদীতে প্রবাহ ফিরবে, অবৈধ দখল উচ্ছেদ হবে, নদীতে মাছ হবে, মুক্ত নদী থেকে বন্দোবস্ত বাতিল হবে, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক নদীটি বেঁচে থাকবে। আগামী বছর অবশিষ্ট ১০ কিলোমিটার তাঁরা খনন করবেন বলে জানা গেছে। প্রকৃত প্রস্থ মেপে খনন না করলে নদীটির সর্বনাশ হওয়ার আশঙ্কা আছে। প্রকৃত প্রস্থের চেয়ে অনেক সরু মাপে খনন করে দুই পাড়ে মাটি ফেললে নদীটি তার বৈশিষ্ট্য হারাবে।
শালমারা নদী গ্রামের ভেতর নিস্তরঙ্গ শুয়ে আছে। কিন্তু তার পাড়ের গড়, নীলকুঠি, মাজার, শ্মশানঘাটসহ নানান অনুষঙ্গে যেন নদীর ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কান পাতলেও শোনা যাবে নদীর কথা। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘নদী, তুমি কোন কথা কও?’ সেখান থেকেই এ লেখার শিরোনাম। নদীর আক্ষরিক কোনো ভাষা না থাকলেও কারও কারও কাছে যেন নদীর ভাষা আছে। কবির পক্ষে হয়তো সেই ভাষা বোঝা সহজ। তবে নদী যে কথা কয়, সেটি শালমারা নদীর ইতিবৃত্ত শুনলেই বোঝা যায়।
নদীটি স্থানীয় অসাধু ব্যক্তিরা অবৈধভাবে দখলের চেষ্টা করছেন। অনেকেই অবৈধভাবে মাঝেমধ্যে বালু উত্তোলন করছেন। মিঠাপুকুর উপজেলার ভূমি কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান নদীটি রক্ষায় ভূমিকা রাখছেন। স্থানীয় অনেকেই নদীটি নিজেদের নামে দাবি করছেন। ভূমি কর্মকর্তা সব অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন এই মর্মে যে নদী কখনো ব্যক্তির নামে হতে পারে না। দেশজুড়ে যখন ভূমি কর্মকর্তারা নদীকে ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত, তখন এই মিঠাপুকুরের ভূমি কর্মকর্তার নদী রক্ষার কাজ একটি দৃষ্টান্ত। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী এই শালমারা নদী রক্ষা করা আমাদের সবারই দায়িত্ব।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail.com