হতে পারত এটি বাংলাদেশের নারীর অর্জনের আরেকটি নতুন পথ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি। ঘটনাটির সূত্রপাত ২০১৪ সালে এবং সেটি হয়েছে বাংলাদেশের দিনাজপুরের ফুলবাড়ী। ফুলবাড়ী পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে তিনজন নারীর নাম প্রস্তাব করে উপদেষ্টা কমিটি এবং সেখানে প্যানেলের এক নম্বরে ছিলেন আয়েশা সিদ্দিকা। সেই কমিটির প্রতি বিশেষ সম্মান জানাচ্ছি এই কারণে যে তারা অন্তত প্রস্তাব পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য করেনি। সেখানে তিন সদস্যের ওই প্যানেল চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল।
প্রথম বাদ সাধে আইন মন্ত্রণালয়। সেই বছরেই ‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’— এই কারণ দেখিয়ে আইন মন্ত্রণালয় এই প্রস্তাবিত প্যানেল বাতিল করে। কিন্তু যিনি একটি নির্দিষ্ট পেশায় সামাজিকভাবে পুরুষ প্রাধান্যকে প্রশ্ন করেছিলেন নিজের যোগ্যতা দিয়ে এবং কমিটমেন্টের মাধ্যমে। ফুলবাড়ীর আয়েশার উদ্যোগ, আগ্রহ এবং যোগ্যতা একভাবে কড়া নেড়েছিল নারীর জন্য সামাজিকভাবে বন্ধ থাকা একটি পেশায়। তবে আয়েশার এত কিছুকে অগ্রাহ্য করে যখন আইন মন্ত্রণালয় ওই সিদ্ধান্ত দেয়, তখন সেটিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সেই আয়েশা।
কেন আয়েশা চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন? কারণ, আয়েশা জানেন বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮–এর (১) ধারা আনুযায়ী ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’ এবং একই অনুচ্ছেদর ধারা (২) ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’ বলে স্বীকৃতি আছে। শুধু তা–ই নয়, এই অনুচ্ছেদের (৪) নম্বর ধারাটিও আরও অধিক মনোযোগ দাবি করে যেখানে আছে ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না’। তার মানে এ ক্ষেত্রে ‘পজিটিভ’ ডিসক্রিমিনেশনেরও সুযোগ আছে।
কিন্তু এই বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে আমরা ভিন্ন বার্তা পাই, যা আসলে সমাজ আসলে নারীকে দেখে তারই একধরনের প্রতিছায়া দেখতে পাই। পত্রিকায় প্রকাশিত হাইকোর্টের রায়ে আছে ‘নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফেশনে থাকেন। সে ক্ষেত্রে মুসলিম বিবাহ হচ্ছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিয়ে পড়ানো মসজিদে হয়ে থাকে। ওই সময়ে নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না এবং তাঁরা নামাজও পড়তে পারেন না। সুতরাং বিয়ে যেহেতু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সেহেতু এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নারীদের দিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। এই পর্যবেক্ষণ দিয়ে হাইকোর্ট এ–সংক্রান্ত রিট মামলার ওপর জারি করা রুল খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) হতে পারবেন না।’
প্রথম কথা হলো, এটি স্পষ্টতই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি আইনের বিষয়ই। তবু কিছু কথা থাকে।
প্রাকৃতিক বিষয়কে ‘শারীরিক ডিসকোয়ালিফিকেশন’ ঘোষণা করে নারীর প্রতি বৈষম্য তৈরি করা হাইকোর্টের এই রায়ের পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানাই।
প্রথমত, সব কাজি বিয়ে পড়ান না। বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিয়ে পড়ান মৌলভি। কাজির মূল কাজ বিয়ে রেজিস্ট্রি করা। সেটিতে যাঁর দক্ষতা আছে, যোগ্যতা আছে, তিনি করতে পারবেন। তবে কাজি যদি মৌলভি হন কিংবা ধর্মীয় আচার ভালো জানেন, তিনি বিয়ে পড়াতে পারেন। এখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে কাজিই বিয়ে পড়াবেন। কাজির সঙ্গে বিয়ে পড়ানোর সম্পর্ক একেবারেই গৌণ।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ‘আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিয়ে পড়ানো মসজিদে হয়ে থাকে’ এই তথ্যের সূত্র কী। এটি আসলে খুব বেশি কারোরই অজানা নয় যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ বিয়েই পড়ানো হয় মেয়ের বাড়িতে। তর্কের খাতিরে ধরেই নিচ্ছি যদি মসজিদেই পড়ানো হয়, তাহলে যে যুক্তি দেখিয়ে নারী কাজি হতে পারবেন না বলে রুল দেওয়া হলো, ঠিক একই যুক্তিতে তাহলে বিয়ের কনেরও মসজিদে যেতে পারার কথা নয়।
তৃতীয় প্রশ্নটি ‘ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফেশন’ বা শারীরিক অযোগ্যতা প্রসঙ্গে। নারীর যে ক্ষমতায় একজন মানব সন্তান পৃথিবীতে আসে, সেটিকে কি ‘শারীরিক অযোগ্যতা’ বলা যাবে? পৃথিবীর অনেক দেশেই নারীর এই মাসিক চক্রকে সম্মানের চোখে দেখে এবং সেই সময়ে নারীর শারীরিক বিশ্রামের প্রতি মনোযোগ দিয়ে চাকরিতে বেতনসহ ছুটি দেন, অথচ আমরা সেটিকেই নেতিবাচকভাবে অযোগ্যতা হিসেবে হাজির করে নারীকে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবস্থান নিচ্ছি। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্য ২০০৩ সাল থেকে ইন্দোনেশিয়া কর্মজীবী নারীদের জন্য মাসে দুই দিন মাসিক চক্রজনিত ছুটির অনুমোদন আছে। জাপান, তাইওয়ানেও আছে এই নিয়ম। আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়াতে কর্মজীবী নারীরা ২০১৫ সাল থেকে মিনস্ট্রুয়াল লিভ পলিসির আওতায় ‘মাদারস ডে’ হিসেবে প্রতি মাসে এক দিন ছুটি পান। শুধু বাইরের দেশ কেন? আমাদের দেশেও আনঅফিশিয়ালি এর চর্চা আছে।
গত বছর আনসার একাডেমিতে একটি বিশেষ কোর্সে ক্লাস নিতে গিয়ে জানতে পারলাম, সেখানেও আনঅফিশিয়ালি এই চর্চা আছে। ‘ন্যাচারাল সিক’ নামে প্রচলিত এই চর্চায় সেখানে ট্রেনিংরত নারী আনসার অফিসাররা মাসে তিন দিন ‘ন্যাচারাল সিক’–এর আওতায় শারীরিক ট্রেনিং থেকে ছুটি পান। এর দোহাই দিয়ে তো কোথাও নারীর নিয়োগ বন্ধ হয়নি। বরং এই সব দিনে নারীর প্রতি পারিবারিক, সামাজিক এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহমর্মিতা বেড়েছে। এখন অনেক বাড়িতে ছেলে সন্তানেরাও বিষয়টির প্রতি সম্মান জানিয়ে মাকে বলে, ‘মা, আজ তোমার কাজে সহযোগিতা করি?’
তাহলে এ ক্ষেত্রে কেন এই সময়ে এসে হাইকোর্টের এই ধরনের সিদ্ধান্তের কথা শুনতে হবে।
যদি বিষয়টি এমন হতো যে নারীরা মাসিক সময়ে মসজিদে যেতে পারবেন না, বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে পারবেন না, অন্য সবকিছুই পারবেন—সেটিও হয়তো কিছুটা গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু প্রাকৃতিক বিষয়কে ‘শারীরিক ডিসকোয়ালিফিকেশন’ ঘোষণা করে নারীর প্রতি বৈষম্য তৈরি করা হাইকোর্টের এই রায়ের পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানাই।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail. com